ভূমির লড়াইয়ে আর কত প্রাণ যাবে!

জোবাইদা নাসরীন, মঙ্গল কুমার চাকমা, সৌরভ সিকদার, দীপায়ন খীসা, পাভেল পার্থ 

আবারও রক্তাক্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম। পার্বত্য চুক্তির এক যুগ পরেও পাহাড়ে সংঘাত থামেনি। দফায় দফায় তৈরি হওয়া ভূমি কমিশন এখন পর্যন্ত কোনো কাজ করতে পারেনি। সেই ভূমি বিরোধকে কেন্দ্র করে রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে এক মাস ধরেই উত্তেজনা বিরাজ করছিল। মূল ঘটনা ১৯ ফেব্রুয়ারি রাতে শুরু হলেও ২০ ফেব্রুয়ারিতে সেটি চরম আকার ধারণ করে। ২০ ফেব্রুয়ারি দিনভর গোলাগুলি চলে। আদিবাসীরা জানায়, তারা অগ্নিসংযোগে বাধা দিতে গেলে সেনাবাহিনী গুলি ছোড়ে। ফলে তাদের গ্রাম থেকে সরে যেতে হয়। আর এই সুযোগে বাঙালিরা লুটপাট চালায় এবং তাদের বাড়িঘরে আগুন দেয়। এ ঘটনায় চারজন নিহত হয়েছেন বলে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। তবে আদিবাসীদের দাবি, এ ঘটনায় সাতজন নিহত হয়েছেন (সূত্র: প্রথম আলোয় ২১ ফেব্রুয়ারি)। মানুষ মারা গেছে, বাড়িঘর পুড়ে ছাই হয়েছে, জনশূন্য হয়ে পড়েছে লোকালয়, আতঙ্কে আছে মানুষ; সেগুলোই মানবতার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ। পাহাড়িদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জবরদখল নিয়ে আর কতজন প্রাণ হারাবে?
পার্বত্য অঞ্চলের অনেকটাই দুর্গম এলাকা বাঘাইছড়ির সাজেক ভূমি সমস্যার কারণে একটি আতঙ্কিত জনপদ। এ বছরের ২২ জানুয়ারি আবার উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। ঘটনার সূত্রপাত, দুজন পাহাড়িকে সেনাবাহিনী আটক করলে ‘সচেতন নারী কমিটি’ নামে স্থানীয় একটি নারী সংগঠনের কর্মীরা তাঁদের ছিনিয়ে আনে। পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনী গ্রামে গিয়ে নারীদের মারধর করে। এতে আটজন নারী আহত হন। এ ঘটনার সূত্র ধরে ২৪ জানুয়ারি বাঘাইহাট উচ্চবিদ্যালয়ের ২৮ জন ছাত্রসহ দুজন শিক্ষককে সেটেলার বাঙালিরা অবরুদ্ধ করে রাখে। গত ২৫ জানুয়ারি বাঙালিরা কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী হামলার আশঙ্কায় ভাইভাইছড়া, এমএসপাড়া ও হাজাছড়া নামক তিনটি পাহাড়ি গ্রাম জনশূন্য হয়ে পড়ে। ২০০৮ সাল থেকেই সাজেকের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
সবাই কম-বেশি জানে যে পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেকগুলো সমস্যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সমস্যা হলো ভূমি বিরোধ। ২০০৮ সালের আগে সাজেকে ভূমি বিরোধ ছিল না তা কিন্তু নয়। তবে যখন বলা হলো যে দীঘিনালা-বাঘাইছড়ি সড়কের উভয় পাশের তিন কিলোমিটারের মধ্যে বাঙালিরা এবং এর পরে পাহাড়িরা বাস করবে, তখন থেকেই পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টাতে থাকে। স্থানীয় অধিবাসীদের মতে, এরপর বাঙালিরা পাহাড়িদের বাগানকেন্দ্রিক জমি দখলের চেষ্টা শুরু করে। এতে বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। এরই জের ধরে ২০ এপ্রিল সাতটি গ্রামের ৭৮টি বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ঘটনা শুধু এখানেই থেমে ছিল না। ১৯৯৯ সালে ৪ এপ্রিল এই বাঘাইহাটে একই ধরনের হামলায় একজন আদিবাসী নারী ধর্ষণের শিকার হন এবং ৫২ জন পাহাড়ি আহত হন।
পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি সমস্যার নিষ্পত্তি একটি বড় বিষয়। বারবার এটিকে কেন্দ্রীয় আলোচনায় আনা হলেও কোনো অজ্ঞাত কারণে সেটি সঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না, যার ফলে এটিকে কেন্দ্র করেই ঘটছে বিরোধ। পার্বত্য চুক্তির মধ্য দিয়েই ভূমি কমিশন গঠনের পটভূমি তৈরি হয়েছে। তাই চুক্তি মোতাবেক কমিশনকে তার কর্মপদ্ধতি পরিচালনা করতে হবে। পার্বত্য চুক্তির ঘ খণ্ডের ২ নং ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে ‘সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর ও বাস্তবায়ন এবং উপজাতীয় শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উপজাতীয় উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের পর সরকার এই চুক্তি অনুযায়ী গঠিতব্য আঞ্চলিক পরিষদের সাথে আলোচনাক্রমে যথাশীঘ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জরিপ কাজ শুরু এবং যথাযথ যাচাইয়ের মাধ্যমে জায়গা-জমিসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করতঃ উপজাতীয় জনগণের ভূমির মালিকানা চূড়ান্ত করিয়া তাহাদের ভূমি রেকর্ডভুক্ত ও ভূমির অধিকার নিশ্চিত করিবেন।’ এখানে উল্লেখ্য, ভূমি কমিশন আইনের ২০টি ধারার মধ্যে ১৯টি বিষয়ই পার্বত্য চুক্তির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই চুক্তির সঙ্গে ভূমি কমিশন আইনের যেসব দিক সাংঘর্ষিক রয়েছে, সেগুলো আগে সংশোধন করে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করতে হবে।
যদিও গত ৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনের এক সভায় কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি খাদেমুল ইসলাম চৌধুরী ঘোষণা দেন যে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে ভূমি জরিপের পন্থা ও পদ্ধতি ঠিক করে ১৫ অক্টোবর ’০৯ থেকে শুরু করে আগামী ২০১০ সালের মার্চের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জরিপ সম্পন্ন করা হবে (ডেইলি স্টার, ৯ সেপ্টেম্বর,২০০৯)। যে সভার মাধ্যমে ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান এ ঘোষণা দেন, সেই সভায় আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান বা প্রতিনিধি, পার্বত্য জেলা পরিষদের (রাঙামাটি ও বান্দরবান) প্রতিনিধি ও সার্কেল চিফদের অনুপস্থিতিতে গৃহীত সিদ্ধান্ত কতটুকু গ্রহণযোগ্য ও বিধিসম্মত হয়েছে, তা নিয়ে পাহাড়ি জনগণের মধ্যে সংশয় ও উত্কণ্ঠা রয়েছে। কারণ পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক গঠিত ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের অন্যতম সদস্য হিসেবে উল্লিখিত প্রতিনিধিরাও রয়েছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক আন্তর্জাতিক কমিশন গত আগস্ট মাসে তৃতীয়বারের মতো পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর করে সেখানকার স্থানীয় প্রশাসন, রাজনৈতিক দল ও পাহাড়ি-বাঙালি উভয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মতবিনিময়ের পর চিহ্নিত সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য সরকারের কাছে কয়েকটি সুপারিশ পেশ করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: (১) ভূমি কমিশন প্রথমে বিরোধপূর্ণ সব ভূমির মালিকানা-সংক্রান্ত দাবি-দাওয়ার একটি ডেটাবেইজ প্রস্তুত করবে এবং ভূমির দাবিদারদের হাতে ফরম তুলে দেবে, যাতে করে ভূমির দাবিদাররা প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো সেখানে লিপিবদ্ধ করে কমিশনকে সরবরাহ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে ভূমি কমিশন আর্থিক ও কারিগরি সহায়তার জন্য ইউএনডিপির মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তা নিওয়া যেতে পারে বলে উল্লেখ করে। (২) যেসব ভূমির ওপর দ্বৈত মালিকানা রয়েছে, সেসব জটিলতা নিরসনে ভূমি মালিকানার আপেক্ষিক অগ্রাধিকার নির্ধারণের জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম প্রণয়ন করা এবং (৩) শরণার্থী পুনর্বাসনবিষয়ক টাস্কফোর্স, ভূমি কমিশনের মধ্যে কাজের বিভাজন ও পারস্পরিক সমন্বয়ের জন্য জরুরি ভিত্তিতে সরকারি দিকনির্দেশনা প্রণয়ন করা।
ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা এবং কর্তৃত্ব নিয়েও সরকারকে পুনর্বিবেচনায় বসতে হবে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সব সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহারের কথা থাকলেও, এখনো বহু সেনা ক্যাম্পই রয়েছে। সরকারকে ভাবতে হবে, যখন আদিবাসীদের বিপরীতে সেনাবাহিনী এবং বাঙালির অবস্থান এক হয়ে যায়, তখন এই সরকারের অবস্থান নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। আমরা মনে করি, সাজেকের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত, বিচার হওয়া উচিত। সাজেকে বসবাসরত আদিবাসীদের মনে নিরাপত্তার আশ্বাসটুকু ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। কীভাবে আনবে, সেটি সরকার বিবেচনা করুক।
লেখকেরা শিক্ষক, গবেষক ও মানবাধিকারকর্মী।
সূত্র: প্রথম আলো, | তারিখ: ২৩-০২-২০১০

No comments

Theme images by 5ugarless. Powered by Blogger.