একবিংশ শতাব্দীতে ভিক্ষু সংঘের সামনে চ্যালেঞ্জ।
[লঙ্কা ডেইলি নিউজ থেকে অনুবাদ করেছেন - উপতিষ্য ভিক্ষু]
ভেন. বোধি ভিক্ষু
সংঘ - পরিপূর্ণ ভিক্ষু এবং ভিক্ষুণী যাঁরা- তাঁরা হচ্ছেন বিশ্বে একমাত্র বুদ্ধের দৃশ্যমান প্রতিনিধি; আড়াই হাজার বছর ধরে মানব জাতির মাঝে বৌদ্ধ ধর্মকে টিকিয়ে রেখেছেন বুদ্ধ প্রদর্শিত পথে - ভিক্ষু বানানো এবং তাঁদেরকে ধর্ম বিনয়ে সুপ্রশিক্ষিত করার মাধ্যমে, যা বৌদ্ধ ধর্মকে এখনো পর্যন্ত টিকে থাকতে নিশ্চিত করেছে। ত্রিরত্নের(বুদ্ধরত্ন, ধর্মরত্ন, সংঘরত্ন) অস্তিত্ব এভাবে ভিক্ষু সংঘের উপর নির্ভর করে যাঁরা তৃতীয় রত্ন, আর্য সংঘ বা উন্নত চরিতত্রের অধিকারী সন্ন্যাসী সম্প্রদায় এবং যাঁরা লোকোত্তর পরম সত্যকে উপলব্ধি করেছেন। বুদ্ধ প্রতিষ্ঠিত এ মহান সংঘ আজ ২৫০০ বছরেরও অধিক সময় ধরে টিকে আছে, যা বিখ্যাত রোম সাম্রাজ্যের ব্যাপ্তিকালের চেয়েও বেশি, চীনা সম্রাট সব রাজবংশ চেয়ে দীর্ঘতর, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের চেয়ে অধিককাল। এবং এই টিকে থাকা কোন প্রকার বিধ্বংসী মারনাস্ত্র অবলম্বন ছাড়া, স্বীয় আর্থিক সম্পদ ছাড়া, সৈন্যবাহিনী ব্যতীত, নিছক জ্ঞান এবং পুণ্য শক্তির মাধ্যমে। যাইহোক, এই টিকে থাকা যে চলতেই থাকবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই, কিংবা এটা মানব জাতির মাঝে যে অত্যাবশ্যক এবং গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার ধারা অব্যাহত রাখবে তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। এই টিকে থাকা এমন একটি কাজ যা সংঘের সদস্য যারা সেই নবীন প্রজন্মের ভিক্ষু ভিক্ষুণীদের উপরেই নির্ভর করছে, এবং এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একারণে যে বৌদ্ধ ধর্মের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে সংঘের ভবিষ্যতের উপর।
আমরা জানি যে মহান সংঘ সর্বদা নিজের অস্তিত্বের ধারা অব্যাহতভাবে বজায় রেখে এসেছে গৃহীসমাজের সাথে নিবিড় মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে। এ দু‘য়ের মাঝে সম্পর্ক পারস্পরিক নির্ভরশীলতা এবং সহযোগিতার এক অনন্য নিদর্শন। প্রথাগত বৌদ্ধ ধর্মে দায়কসমাজ সংঘ সদস্যদের অপরিহার্য বিষয়গুলি যোগান দিয়ে এসেছে - বস্ত্র, বাসস্থান, অন্ন, চিকিৎসা এবং অন্যান্য বিষয়িগত সমর্থন - যেখানে সংঘ সদস্যরা ধর্মের জন্য জীবন উৎসর্গ করার মাধ্যমে দায়কসমাজকে স্বধর্ম শিক্ষা দিয়েছে। ধর্মের বাহক সংঘকে টিকে থাকতে হলে এই সম্পর্কের কিছু একটা রুপ বজায় রাখতে হবে। কিন্তু সমাজে যে নূতন পরিবর্তনের গতিময়তা এসেছে দ্রুত তাতে করে এই সম্পর্কের ধরণেও পরিবর্তন আসছে অনিবার্যভাবে।
দায়ক সমাজ আর ভিক্ষু সমাজের সম্পর্কের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হচ্ছে উত্তরণ পর্ব, এটি প্রথমত প্রথাগত সমাজ ব্যবস্থা থেকে আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় এবং তারপরে প্রযুক্তি নির্ভর সমাজ ব্যবস্থায় উত্তরণ। এই পরিবর্তনের একটি স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শিল্প উত্পাদনের উপর গুরুত্বরোপ থেকে তথ্য আহরণ ও বিতরণের দিকে গুরুত্ব দেয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি। এই পরিবর্তন ইতিমধ্যে পাশ্চাত্য সমাজব্যবস্থায় স্থান করে নিয়েছে এবং বিশ্বের প্রায় সকল দেশের অগ্রগামী সমাজের বিভিন্ন স্তরে দেখা যাচ্ছে। এটা এখন আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে আমরা শিল্পযুগ থেকে তথ্যযুগে অগ্রসর হচ্ছি; অন্যভাবে বললে বলতে হয় উৎপাদনভিত্তিক সভ্যতা থেকে জ্ঞানভিত্তিক সভ্যতায়। এ তথ্য-ঘন(information-intensive) সমাজে উত্তরণ সংঘ আর দায়কদের মাঝে বিদ্যমান সম্পর্কের প্রকৃতি আমূলভাবে বদলে দেবে এবং এই নতুনত্ব সংঘের সামনে চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেবে ধর্মের প্রাসঙ্গিকতার(প্রয়োজনীয়তার) নব্য সমাজব্যবস্থায় সংরক্ষণ করতে। আমি এখানে নিজেকে ভবিষ্যদ্বক্তা হিসেবে দাবী করছি না, এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে বিস্তারিত বলার ক্ষমতাও রাখি না, কিন্তু বর্তমান সময়ের পরিবর্তনের প্রবণতা(trends) বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতে সংঘের সামনে যেসমস্ত সম্ভাব্য গুরুত্বপূর্ণ চ্যলেঞ্জসমূহ আসতে পারে সেসব নিয়ে একটি চিত্র আঁকতে চেষ্টা করবো।
১। উচ্চ শিক্ষার ভূমিকাঃ তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে একটি দেশের জনসংখ্যার উচ্চ হার এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা লাভ করছে। মানুষ এখন অতীতে যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি তথ্য ও জ্ঞানভান্ডারে প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছে এবং জাগতিক বাস্তবতা এমনকি বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে তাদের বোঝার ক্ষমতা আগের তুলনায় অনেক গভীর(sophisticated)। তারা প্রত্যাশা করে ধর্মকে সেই মানদন্ডে মেপে যাচাই করার যা তারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে অর্জন করেছে এবং এক্ষেত্রে তারা প্রশ্নহীন ভক্তি শ্রদ্ধায় ভিক্ষুদের দেয়া দেশনাসমূহ আগের ঐতিহ্যগত নিয়মের মত আর গ্রহণ করার পক্ষপাতী নয়। প্রশ্ন ও অনুসন্ধান করার শিক্ষায় তারা প্রশিক্ষিত এবং এই একই বিচার পদ্ধতি তারা বৌদ্ধ ধর্মকে জানার ও গবেষণার ক্ষেত্রে প্রয়োগে পক্ষপাতী। অতএব ভিক্ষু এবং ভিক্ষুনীদেরকে তাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। তাঁরা দায়কদের কাছ থেকে এতসহজে বশ্যতা পাবেন আশা করতে পারে না; তাঁদেরকে বৌদ্ধ ধর্মের সুধা যথার্থ, প্রাণবন্ত ও পরিষ্কারভাবে বিশ্লেষণের মাধ্যমে শ্রদ্ধা অর্জন করতে হবে। একারণে ভিক্ষু এবং ভিক্ষুণীদেরকে প্রধানত বৌদ্ধ ধর্মসহ অন্যান্য বিষয় যা পরোক্ষভাবে বৌদ্ধ ধর্মের সাথে সম্পর্ক রয়েছে, যেমন- আধুনিক দর্শন সাহিত্য, মনোবিজ্ঞানসহ অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভ করতে হবে। বাস্তবিকপক্ষে এসব জাগতিক জ্ঞান বুদ্ধ ধর্মের মত সুগভীর লোকোত্তর জ্ঞানের সাথে সমন্বয় করা সুকঠিন বিষয়; তবুও এর একটা বিহিত করতে হবে তাঁদের যাঁরা মানব মুক্তির জন্য ধর্মের প্রচার ও প্রসারের সাথে জড়িত।
২। প্রকাশনার ভূমিকাঃ এটা নিবিড়ভাবে দায়ক সমাজের সেই অংশের সাথে সম্পর্কিত যারা উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পায়। লেখনির ব্যবহার বুদ্ধ ধর্মকে সেই খ্রীস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে নব রুপে রুপান্তর ঘটিয়েছে; এবং বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে শুরুতে ছাপাখানা ও বাণিজ্যিক প্রকাশনা আরো অগ্রগামী করেছে। বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন দিক নিয়ে এখন একেবারে সাধারণ থেকে গুরুগম্ভীর জ্ঞানের বই ইংরেজিসহ বহু ভাষায় শত শত পাওয়া যায়। এভাবে এখন একজন ধর্মের শিক্ষার্থী বুদ্ধ ধর্মের উপর ইচ্ছা করলে ব্যাপক জ্ঞান আহরণ করতে পারে বই পড়ার মাধ্যমে। মাইক্রো কম্পিউটার বুদ্ধ ধর্ম জানার বা গবেষণার ক্ষেত্রে আরও বিপ্লব নিয়ে এসেছে। যেকোন পরিশ্রমী ধর্ম শিক্ষার্থী এখন ইচ্ছে করলে তার নোটবুক কম্পিউটারের মাধ্যমে ত্রিপিটকসহ সমগ্র ধর্মীয় গ্রন্থাগার সংরক্ষণ করতে পারে তার হার্ড ড্রাইভে। ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে তারা এখন বৌদ্ধ ধর্মের বিশাল জ্ঞান-ভান্ডারে প্রবেশ করতে পারে এবং বৌদ্ধ ধর্মের প্রত্যেক বিষয়ের উপর ভার্চূয়াল আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে পারে বিভিন্ন গ্রুপে। এভাবে বৌদ্ধ ধর্মের গ্রন্থগত জ্ঞানের সুবিধা এখন কেবল আর ভিক্ষুদের জন্য সীমাবদ্ধ নয় এবং বৌদ্ধ ধর্ম গ্রন্থ ও আলোচনার জন্য কাউকে বৌদ্ধ মঠের(monastery) উপর নির্ভরশীল হতে হয় না যা আগে ঐতিহ্যগত বৌদ্ধ সংস্কৃতি ক্ষেত্রে ছিল। বৌদ্ধ ধর্মের উপর পড়াশুনা এখন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে করা যায় এবং সেখানে অনেক অসামান্য গৃহী পন্ডিত ব্যক্তি বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শনের উপর বিভিন্ন বিশেষায়িত ক্ষেত্র নিয়ে উচ্চ মার্গের গবেষণা করে যাচ্ছেন। এখন এটা একটা প্রশ্ন হয়ে দাড়িয়েছে যে আমাদের তাহলে গেরুয়া বসনধারী ভিক্ষু হিসেবে কি দেওয়ার বা করার আছে। এক্ষেত্রে আমি বলবো যে গৃহী বিজ্ঞ ব্যক্তিদের সাথে প্রতিযোগিতা করা আমাদের কাজ নয়। আমাদেরকে নিশ্চিতভাবেই বৌদ্ধধর্মের পাণ্ডিত্যপূর্ণ জ্ঞান যথাসম্ভব নির্ভরযোগ্য উৎস হতে নিরন্তর অনুসন্ধান করতে হবে এবং এক্ষেত্রে প্রয়োজনে গৃহী বিজ্ঞ ব্যক্তিদের থেকেও শিখতে হবে। কিন্তু বৌদ্ধ মঠের জীবন(Buddhist monastic life) যা দেয় তা হচ্ছে বুদ্ধ ধর্মের শিক্ষাসমূহকে অনুশীলন করার সুযোগ, ত্রিরত্নের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে ভক্তি ও শ্রদ্ধাসহগতভাবে গ্রন্থগত জ্ঞান আহরণ ও তা জীবনে প্রত্যক্ষ প্রয়োগের ক্ষেত্র। আমাদেরকে পাণ্ডিত্যপূর্ণ জ্ঞানকে অনুশীলনের সাথে একীভূত করতে হবে; বোধের জ্ঞানগত ক্ষমতাকে শ্রদ্ধা ও প্রতিশ্রুতির সাথে অনুশীলনে নিয়ে আসতে হবে। অনুশীলন না করে কেবল পান্ডিত্য অর্জনের জন্য জ্ঞান আহরণ করা আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়; সে সাথে উচিত নয় বুঝার জ্ঞানগত ক্ষমতাকে( intellectual understanding) উপেক্ষা করে বা পরিষ্কার ধারণা না নিয়ে অন্ধভাবে পালন করা।
৩। জনসংখ্যা স্থানান্তরঃ উচ্চ শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে গ্রাম থেকে শহরাঞ্চলে বহু মানুষ স্থানান্তরিত হচ্ছে এবং একারণে শহর সম্প্রসারিত হচ্ছে। শহুরে জীবনের বর্ধিত চাপ এবং টেনশন জীবনকে বিষিয়ে তুলে, সেকারণে মানুষের মাঝে ধর্মের প্রয়োজনীয়তা আগের চেয়ে অনেক বেশি অনুভূত হবে ঠিক যেমনি অসুস্থ মানুষের ওষুধের প্রয়োজনীয়তা বেশি সুস্থ মানুষের চেয়ে। এটা প্রয়োজন যে সংঘ তাদেরকে সদ্ধর্ম দেশনা দিবে যাতে করে তারা তাদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যাগুলো পরিষ্কার এবং বাস্তবসম্মত উপায়ে মোকাবেলা করতে পারে সে সাথে জাগতিক অস্তিত্বের সত্য প্রপঞ্চগুলো উপলব্ধি ও মানবিক মনস্তত্ত্বের অর্ন্তদৃষ্টি লাভ করতে পারে। কিন্তু একি সাথে আমি এটাও পরিষ্কার করে বলতে চাই যে আমরা যেন ধর্মকে ”সহজগ্রাহ্য” বা ”সহজবোধ্য” করতে গিয়ে তাকে সংশোধিত(বিকৃত) বা লঘু করে না ফেলি। দায়কদের ইত্যকার অভিজ্ঞতা ও পটভূমির উপর জোর দিয়ে ধর্মকে আধুনিক মতবাদ এবং ধারণক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে এমনভাবে উপযোগী করে নিতে হবে যাতে করে তাদের সহজে বোধগম্য হয়। এটা ধর্মের সেই দিকটির উপর দায়ক সাধারণের বিশ্বাস বা আস্থা উৎপন্ন করবে যা তাদের অভিজ্ঞতাভিত্তিক বোধের বাইরে। এই বিশ্বাস তাদের মাঝে উৎপন্ন হওয়ার পর আমাদের উচিত তাদেরকে আর্য সত্যের আরো গভীর উপলব্ধির দিকে নিয়ে যাওয়া।
৪। মানসিক প্রশিক্ষণের ভূমিকাঃ ধর্ম কেবল জ্ঞানগত ও ব্যবহারিক নৈতিকতার দিক দিয়ে মানুষকে সন্তুষ্টি দেবে না বরং সম্যক চিন্তা(সমাধি) চর্চার মধ্য দিয়ে মানুষকে মুক্তির পথে পরিচালিত করবে। এটাই বৌদ্ধ ধর্মকে অন্যান্য ধর্ম থেকে আধ্যত্মিক ভাবাদর্শগতভাবে পৃথক করেছে; সুখ দুঃখের ক্ষেত্রে মনের(নাম) কেন্দ্রিয় ভূমিকার উপর গুরুত্বারোপ করে এবং মনের প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহারিক ও বাস্তবসম্মত পদ্ধতির সন্ধান দেয়। সেই জন্য বহু মানুষের কাছে ধর্মে প্রবেশপথের গুরুত্বপূর্ণ “দরজা”(door of entrance) হচ্ছে সমাধি চর্চা(practice of meditation)। এটা তাদের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিশেষ ”দরজা” যারা অবৌদ্ধ বা অন্য ধর্ম(মতাদর্শ) থেকে এসেছেন যা বিশেষ করে পাশ্চাত্য দেশে দেখা গেছে। কিন্তু এটা সেসব জন্মগত বৌদ্ধদের জন্যও ”দরজা” হিসেবে কাজ করে যারা বৌদ্ধ ধর্মকে বিজ্ঞানের পটভূমি(scientific backgrounds) থেকে দেখার চেষ্টা করেন এবং সংশয়বাদী(skeptical) ও অনুসন্ধীৎসু মনমানসিকতা লালন করেন। আমি মনে করিনা সমাধিই একমাত্র উত্তর হতে পারে এবং এক্ষেত্রে আমি যথেষ্ট সতর্ক সেইসব পাশ্চাত্য ধ্যান শিক্ষকদের ব্যাপারে যারা কেবল সমাধিকে(ধ্যান) গ্রহণ করে বাকি সব ধর্মীয় বিশ্বাস এবং বৌদ্ধ মতবাদকে প্রত্যাখান করেন। আমার মনে হয় একটি ভারসাম্যপূর্ণ পদ্ধতি প্রয়োজন; একটি ত্রয়ী ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা যা শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস, বুদ্ধের শিক্ষার গবেষণা এবং ধ্যানানুশীলন উপর ভিত্তি করে হবে। বিশ্বাস আবেগকে সুপথে পরিচালিত করে, পড়াশুনা বা গবেষণা সম্যক দৃষ্টিভঙ্গী উৎপন্ন করে এবং সমাধি বা ধ্যান প্রশান্তি ও অর্ন্তদৃষ্টি আনে। আজকাল অনেক মানুষ ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে ধ্যান করার মাধ্যমে। তারা যখন ধ্যানের মধ্য দিয়ে বাস্তব ফল পায় তখন ধর্মের প্রতি তাদের আগ্রহ জাগে এবং তারা ক্রমান্বয়ে বৌদ্ধ মতবাদ আত্মস্থকরণের দিকে অগ্রসর হয়, ধর্ম গ্রন্থ বা বুদ্ধের শিক্ষাসমূহ অধ্যয়ন করে এবং এভাবে তাদের মাঝে বিশ্বাস, শ্রদ্ধা, ভক্তি জন্মালাভ করে এমনকি অনেকেই আবার সন্যাসী বা গেরুয়া জীবন বেছে নেয়।
৫। সংঘ যখন চ্যালেঞ্জ উপস্থাপন করবেঃ এতক্ষণ আমি কিছু উপায় বা পদ্ধতির কথা বললাম যা মহান সংঘ একবিংশ শতাব্দির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অবলম্বন করতে পারে। কিন্তু এখানে অতিরিক্ত আরেকটি পয়েন্ট আমি নির্দেশ করতে চাই যে সংঘের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মিশন কেবল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা নয় বরং একটি মোক্ষম পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া। সংঘকে তাই আধুনিক যুগোপযোগী হয়ে দাঁড়াতে হবে এবং নিজস্ব চ্যালেঞ্জ উপস্থাপন করতে হবে। আধুনিক বিশ্ব অন্ধভাবে ইন্দ্রিয় সুখভোগের উন্মত্তটাই আবর্তিত হচ্ছে; অথচ সংঘ হচ্ছে নারী ও পুরুষের সমবায়ে গঠিত এমন একটি সমাজ যাঁরা সকল প্রকার ইন্দ্রিয় সুখভোগের লালসা থেকে মুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গ করেছে। তাঁদের শান্তশিষ্ট আচার-ব্যবহার ও অন্তঃস্থিত প্রশান্তির দ্বারা তারা অন্যকে এই মেসেজ দিতে পারে যে প্রকৃত সুখ সীমাহীন ভোগ প্রবণতায় নয় বরং আত্ম ও ইন্দ্রিয় বাসনা দমনের মধ্যেই নিহিত। আধুনিক বিশ্ব এই ভিত্তিতে প্রত্যায়িত যে সুখ অর্জিত হয় সম্পদ ও ক্ষমতা অর্জনের দ্বারা অথচ সংঘ এই প্রত্যায়ে প্রতিষ্ঠিত যে প্রকৃত সুখ লাভ হয় সরল জীবন যাপন দ্বারা, স্বেচ্ছা দারিদ্র বা ত্যাগ এবং আধ্যত্মিক উন্নয়নের মাধ্যমে। এভাবে ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীরা অন্যকে চ্যালেঞ্জ করবে যে প্রকৃত সুখ বা শান্তি নিহিত থাকে বরং নিতান্ত সাধারণ ও সরল জীবন যাপনের মধ্যে, সম্পদ ও ক্ষমতার জন্য সীমাহীন লোভ বা তৃষ্ণা কমিয়ে আনার মাঝে। এভাবে তাঁরা প্রকৃত সুখ ও শান্তির উপায় হিসেবে আত্মচর্চা ও আত্মনুসন্ধানের দিকটি শক্তিশালী চ্যালেঞ্জ আকারে তুলে ধরবে। আধুনিক বিশ্ব অন্তহীনভাবে সন্তুষ্টির জন্য নিত্য নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের দিকে মনোযোগী হচ্ছে, কারণ এটা মনে করা হচ্ছে যে নূতন কিছু মানেই ভালো কিছু। সংঘ প্রাচীন ঐতিহ্যগুলো সম্মান ও সুসংরক্ষণ এবং অতিরিক্ত সুবিধার ভারে ভারাক্রান্ত না হয়ে সরল জীবন যাপনের দিকে মনোযোগী । এ উপায়েই সংঘ অন্যকে আহবান করে মিতব্যয়ী জীবন বেছে নিতে, যা প্রাচীন সেসবের প্রতি শ্রদ্ধা করতে এবং প্রাকৃতিক পরিবেশকে সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখতে। আধুনিক বিশ্বে বিভিন্ন জাতিগত ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর লোকদের মধ্যে সহিংসতার মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, যারা বিশ্বাস করে বল প্রয়োগের দ্বারা তাদের সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু বুদ্ধের অহিংসা নীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সংঘ এই প্রত্যয়ে আস্থাশীল যে সহিষ্ণুতা, গঠনমূলক আলোচনা, সমঝোতা ইত্যাদি প্রয়োজন মানবজাতির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য। এভাবেই সংঘ মানুষকে চ্যালেঞ্জ জানাবে পারস্পরিক বোঝাপরা, সহিষ্ণুতা, এবং মৈত্রীময় উদারতার দ্বারা যাবতীয় সমস্যার সমাধান করতে। পারমার্থিক ধর্মকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার মাধ্যমে সংঘ আমাদের সকল প্রচেষ্টাকে নিষ্পত্তির চ্যালেঞ্জ করবে এবং বিশ্বে একটি সুখকর অবস্থানের সন্ধান দেবে; সে সাথে চ্যালেঞ্জের মাধ্যমে মানুষকে বুঝাবে যে সর্বোচ্চ প্রজ্ঞা এবং আমাদের চূড়ান্ত মুক্তি জাগতিক বিষয় আশয়ের বাইরে।
৬। অন্ত:করণের ধ্বনিঃ এখানে আমি একটি বিশাল চ্যালেঞ্জের কথা বলব যা বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় সংঘ মুখোমুখী। বর্তমানে বিশাল ভয়ানক একটি সমস্যা হচ্ছে যে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে অমানুষিক নিষ্পেষণ এবং অন্য অসংখ্য মানুষের উপর অবর্ণনীয় হুমকি সৃষ্টি। জাতিগত দ্বন্দ-সংঘর্ষ থেকে ভয়ঙ্কর ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের কথা আমরা স্মরণ করতে পারি যার পরিণতি স্বরুপ নারী ও শিশুসহ বহু নিরাপরাধ মানুষের মৃত্যুর তালিকাকে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করেছে। আমরা সেসব জালিম সরকারগুলোর দুঃশাসনের কথা স্মরণ করতে পারি যেখানে বিভিন্ন সময় নিরাপরাধ নাগরিকদের জেলে পুরা হয়, অত্যাচার ও নিপীড়ন করা হয় এবং নিরন্তর ভয়ের মধ্যে রেখে তাদের অপশাসন মানতে বাধ্য করা হয়। আমরা ধারণা করতে পারি ধনী-দরিদ্রের মধ্যে এবং সমৃদ্ধ জাতি ও অনগ্রসর জাতিসমূহের মধ্যে অনাকাঙ্খিত ব্যবধান। সেই সব বুভুক্ষিত রোগসমূহ নিয়ে ভাবতে পারি যেগুলো লক্ষ লক্ষ হতদরিদ্র মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে অথচ সেগুলো কত সহজে যৎসামান্য খরচে দূরীভূত করা যেত। সে সকল লক্ষ লক্ষ অসহায় নারীর কথা স্মরণ করতে পারি যারা দেহব্যবসা করতে বাধ্য হচ্ছে, এমনকি কতকক্ষেত্রে পরিবারের দারিদ্রতার কারণে এ কাজ বেছে নিতে হচ্ছে তাদের। আমরা জানি প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি ডলার ব্যয় করা হয় অতিশয় ধ্বংসাত্মক ক্ষমতাসম্পন্ন অস্ত্র তৈরির পিছনে অথচ বিশ্বের অর্ধেকের কাছাকাছি জনসংখ্যা এখনো প্রতিদিন নূন্যতম বেঁচে থাকার মত পুষ্টিকর খাদ্য জোগাতে হিমশিম খাচ্ছে। এবং পরিশেষে আমি সেই লাগামহীন দিকটি নিয়ে বলতে চাই যেখানে পরিবেশকে প্রতিনিয়ত আমরা অধঃপতনের দিকে নিয়ে যাচ্ছি - আমাদের পানি, বায়ু, মাটি, খাদ্য ইত্যাদি - ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে কোন চিন্তাভাবনা না করেই। আমার দৃষ্টিতে, এটা হচ্ছে সংঘের কাজ বৌদ্ধ ধর্মের পবিত্র অন্তঃকরণের ধ্বনি হিসেবে এক্ষেত্রে সেবা করে যাওয়া।
অর্থাৎ সংঘ - অন্ততপক্ষে প্রসিদ্ধ অগ্রগামী সংঘসদস্য ভান্তেদের উচিত বৌদ্ধ ধর্মের নৈতিক মূল্যবোধের দৃষ্টিতে এসব সুবিশাল, ধ্বংসাত্মক ও ভয়ঙ্কর সমস্যা যা মানবজাতি আজ সম্মুখীন, মোকাবেলার নীতি পদ্ধতি তুলে ধরা বা সুপরিশ করা।
আমরা কেবল মঠ জীবনের(monastic life) সৌভাগ্যময় মুহূর্তগুলোকে উপভোগ করার মধ্য দিয়ে জীবন কাটাতে পারি না। আমাদেরকে অবশ্যই সে সকল কোটি কোটি নিপীড়িত মানুষের পক্ষে অসহায় মানবতার মহান মৈত্রী ও করুণার মুখপাত্র হতে হবে যারা নিজেদের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরার সুযোগ পাচ্ছে না এবং ঐ সকল অশুভ ও হিংস্র শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে যাদের কারণে পৃথিবী গ্রহজুড়ে মানবতা আজ ভুলুন্ঠিত, জীবন সংকটাপন্ন। সময় ফুরিয়ে যাওয়ার আগে আমাদেরকে সত্যের বাণী প্রচার করতে হবে এবং এটা হতে হবে মানুষের লোভ, দ্বেষ, মোহ জীবনকে ধ্বংস করার আগেই। দলকানা রাজনীতির ভাবাবেগে ভেসে যাওয়ার আগেই আমাদেরকে লড়াই শুরু করতে হবে ন্যায় দিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, সত্য দিয়ে মিথ্যার বিরুদ্ধে, মৈত্রী দিয়ে হিংস্রতার বিরুদ্ধে, জ্ঞানালোক দিয়ে অবিদ্যার বিরুদ্ধে।
এসকল চ্যালেঞ্জের সাথেই সংঘ মুখোমুখী হতে যাচ্ছে একবিংশ শতাব্দীতে।
[২০০২ সালে তাইওয়ানের সিন্চুতে অবস্থিত ফুয়েন বুদ্ধিস্ট ইন্টিস্টিউটে দেয়া বক্তব্য থেকে সংক্ষেপিত।]
বিঃদ্রঃ লেখাটি মুলত অনুবাদ করেছি ভিক্ষু সংঘের উদ্দেশ্যে। তবে দায়ক সাধারণও পড়ে উপকৃত হতে পারেন। কেউ যদি যৎসামান্যও উপকৃত হয় লেখাটি পড়ে তাহলে আমার পরিশ্রম সার্থক মনে করবো। ভবতু সব্ব মঙ্গলম।
No comments
Post a Comment