চীনের জনসম্পদ ও বাংলাদেশের জনসম্পদের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা (১ম পর্ব)

সপ্তাশ্চার্য চীনের প্রাচীর
পুলক কান্তি বড়ুয়া
দুর্গম মৃত্যুযাত্রায় বাংলাদেশের যে সম্পদ কাতরায় বেঁচে থাকার আকুতি নিয়ে, সেই একই সম্পদ বদলে দিল চীন কে, করে তুলল অর্থনৈতিক পরাশক্তি। কিন্তু কিভাবে? চীন থেকে ঘুরে এসে karunews24.com এর উপদেষ্টা পুলক কান্তি বড়ুয়া, লিখেছেন সেই অজানা কথা। আজ প্রকাশিত হলো ধারাবাহিক লেখার প্রথম পর্ব:
একশো কোটির বেশী যে দেশের লোকসংখ্যা, সেই দেশে আজ আরও লোক প্রয়োজন। সম্প্রতি দেশটি সংবিধান পরিবর্তন করে, এক সন্তানের পরিবর্তে দুটি সন্তান জন্ম দেয়ার অধিকার দেয়া হয়েছে, পূর্বে মহানগর সমূহে কোনো দম্পতি এক সন্তানের বেশী নিয়ে বাস করতে পারত না, মফস্বলে দুটি নিতে পারতেন আর এই আইন কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় পুরো চীনে। গত তিরিশ বছরে এই বিপুল জনসংখ্যা কে চীনের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নিয়মানুবর্তী এক জাতিতে পরিনত করে গড়ে তুলেছেন। জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে পরিনত করতে প্রথমেই তারা গড়ে তুলেছে শক্তিশালী যোগাযোগ ব্যবস্থা, দূরত্ব কে হাতের মুঠোয় নিয়ে, জনগনের উপর প্রয়োগ করেছে নিয়ম, নির্দিষ্ট আয় ব্যতীত কেউই শহরে থাকতে পারবে না, সকালে শহরে আসবে, কাজ করবে, কাজ শেষে ফিরে যাবে নিজের মফস্বল শহরে।
সরকার প্রশস্ত ও সুন্দর রাস্তা বিশ্ব ব্যাঙ্কের লোন দিয়ে তৈরী করে, টোল ব্যবসা করে উল্টো এখন বিশ্বব্যাংককে লোন দিচ্ছে চীন

দুই তিনশ মাইল দূরত্ব এক/দুই ঘন্টার বিষয়, নামমাত্র পরিবহন খরচ হওয়ায় সবাই সেই নিয়ম সাদরে গ্রহণ করেছে। প্রায় সকল সাধারণ মানুষ, আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রো রেল বা ডেকার লম্বা বাস ব্যবহার করে, শহরের ভিতর অবস্থানকারীরা সাইকেল, মোটর সাইকেল, কার ব্যবহার করেন। কিন্তু কার ব্যবহার করতে হলে প্রতিরাস্তায় টোল দিতে হয়, সরকার প্রশস্ত ও সুন্দর রাস্তা বিশ্ব ব্যাঙ্কের লোন দিয়ে তৈরী করে, টোল ব্যবসা করে উল্টো এখন বিশ্বব্যাংককে লোন দিচ্ছে চীন, শুধু তাই নয় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বি.ও.টি (বিল অপারেটিং সিস্টেম) এর নতুন ধরনের ব্যবসার প্রবর্তন করেছে চীন, আমাদের ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন ও প্রস্তাবিত পুরো ঢাকা শহরের উপর একই পদ্ধতিতে ওরা ফ্লাইওভার নির্মান করতে চায় কোনো পয়সা না নিয়েই। তিরিশ বা চল্লিশ বছর ওরা টোল আদায় করে, খরচ ও লাভ তুলে নেবে। তবে ওরা করতে চাইলেও আমাদের সরকার নানা কারণে করতে দিতে পারে না। এর মধ্যে শক্তিশালী কারণ বিশ্বব্যাংকের লোন ব্যবসা ও সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতি। বাকি অন্য কারণ গুলো অন্য কোনো লেখায় লিখব, মূল বিষয়ে ফিরে আসি, চীনে প্রত্যেক জনগনের নির্দিষ্ট আইডি কার্ড থাকা বাধ্যতামূলক, সকলের বেতন, খরচ, যাতায়াত, বাজার, চিকিৎসা, ক্যাশ করা, এমনকি সিনেমা দেখা সব আইডি কার্ডের মাধ্যমে করতে হয়। ফলে একটি সেন্ট্রাল মনিটরিং সিস্টেমে প্রত্যেক নাগরিক সরকারের নজরদারিতে থাকে। প্রত্যেক মানুষের আয় অনুসারে নির্দিষ্ট মান থাকে, সেই মানের বাইরে সে চাইলেও খরচ করতে পারে না। শহরে ইন-আউট সবই আইডি কার্ডের মাধ্যমে সেন্ট্রাল নজরদারিতে কম্পিউটার সফটওয়ার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

ফলে শহরে কেউ কোনো অপরাধ কার্যক্রম করলে সহজে পালাতে পারে না, তা ছাড়া পুরো শহর সেন্ট্রাল সিসি ক্যামেরায় মনিটরিং করা হয়। রাস্তাঘাট যখন নিরাপদ হয়ে উঠে তখন নারী পুরুষ একই মাত্রার শ্রমজীবী হয়ে উঠে। ভয়হীন জনগণ তখন কর্মী ও আনন্দপ্রিয় জাতিতে পরিনত হয়। চীনের জনগণ দুটি বিষয়ে প্রকাশ্যে আলাপ আলোচনা করতে পারে না, তাহলো ধর্ম ও রাজনীতি। এটি একটি গর্হিত ও নিষিদ্ধ বেআইনি আলোচনা হিসাবে ওরা মনে করে। রাষ্ট্রের আইন এই বিষয়ে সকল নাগরিক কে শিক্ষা দিয়েছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তায় আগে ইংরেজি ভাষা নিষিদ্ধ ছিল, কিন্তু বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যেক সম্মান শ্রেনীর ছাত্র কে ইংরেজি বাধ্যতামূলক শিখতে হয়। এখন চীনা জনসম্পদ ওরা দেশের বাইরে কারিগরী এক্সপার্ট হিসাবে, বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে পাঠাচ্ছে, ফলে পৃথিবীজুড়ে ওরা বৈদেশিক শ্রমবাজার থেকে শুধু জনসম্পদের দ্বারা আমাদের সারাবছরের বার্ষিক বাজেটের চারগুন টাকা আয় করে। কারণ ওদের জনসম্পদ কে ওরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাত্রায় দক্ষ করে তুলেছে। ওদের শিক্ষা ব্যবস্থায় স্কুল জীবনেই কোনো না কোনো কারিগরী বিদ্যা হাতে কলমে শিখতে হয়। ফলে স্কুল শেষ করা বালকটি একজন দক্ষ জনশক্তি হয়ে উঠে। ইচ্ছে করলেই সে যে কোনো কারখানায় যোগদান করতে পারে। চীনে কোনো অদক্ষ জনশক্তি নেই বললেই চলে।

ওদের দেশে ধর্ষণ ও সরকারী ব্যক্তির দুর্নীতির শাস্তি আপিল ছাড়াই মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু হত্যাকারীর শাস্তি কারণ বিবেচনায় নানা মেয়াদের।

আমাদের দেশের মত গতর খাটানো শ্রমিক নেই, ফলে সারাদেশের জনগণ হয়ে উঠেছে মূল্যবান জনসম্পদ। ওদের দেশে ধর্ষণ ও সরকারী ব্যক্তির দুর্নীতির শাস্তি আপিল ছাড়াই মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু হত্যাকারীর শাস্তি কারণ বিবেচনায় নানা মেয়াদের। এই সাধারণ পর্যবেক্ষণ থেকে বলতে পারি, বর্তমান সরকারের সামনে তেমন একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, যাকে ব্যবহার করে ডিজিটাল সরকার পারে রূপকল্প ২১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে আগামী ৫ /৭ বছরের মধ্যে সিঙ্গাপুর, মালেশিয়ার মত এক উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করতে।
নিরুৎসাহিত করতে হবে মেধাবীদের সরকারী চাকরি, সরকার প্রজেক্ট ভিত্তিক বেশিমূল্যে মেধাবীদের নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে নিয়োগ দেবে, সারা জীবন লালন পালন করার আত্নঘাতী পদ্ধতি থেকে ধীরে ধীরে সরে আসতে হবে

আর তার জন্য সরকার কঠোর স্বৈরাচারী হয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ, ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি বন্ধ, সকল সেকেন্ডারী শিক্ষার সাথে যে কোনো একটি ব্যবহারিক কারিগরী শিক্ষা বাধ্যতামূলক, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, এই ক্ষেত্রে পদ্মা সেতুর মতো শক্ত অবস্থান নিয়ে চীনা বিনিয়োগ নিশ্চিত করা, যানজট নিরসনে দেশে বিশেষত মহানগরগুলোতে জরুরি অবস্থা জারি ও সেনা মোতায়েন, মহানগর গুলোতে সেন্ট্রাল ওয়েব ক্যামেরা স্থাপন, দুর্নীতির শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, মহানগরে বসবাসের ক্ষেত্রে রেজিষ্ট্রেশন প্রথা, মহানগরের আশেপাশের মফস্বলগুলোতে বসবাসের বিধান করা, হাজার হাজার গড়ে উঠা ফ্ল্যাটগুলো আবাসিক হোটেল বা ডর্মিটরিতে পরিনত করে ট্যাক্স নির্ধারণ করা, একলাখ টাকা ট্যাক্স প্রদানকারীরা শহরে বাসা বা ফ্ল্যাট কিনে থাকতে ও ব্যক্তিগত কার ব্যবহার করতে পারবে, অন্যরা নয়, যারা বানিয়ে ফেলেছে তাদের আবাসিক হোটেল মোটেল এর ব্যবসা করে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে ভুমিকা রাখতে হবে, সেইসাথে কিনে ফেলা কারগুলোকে ট্যাক্সিক্যাব বানিয়ে কর্মসংস্থান, জনপরিবহনের স্বল্পতা পূরণ, সরকারের ট্যাক্স প্রাপ্তি ও নিজের অর্থনৈতিক রোড ম্যাপে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের আমদানি নিষিদ্ধ করে, গ্রামে গ্রামে ছোট ছোট শিল্প উদ্যোক্তা বীমাপলিসির  মাধ্যমে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় করতে হবে। এই ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের মেধাবী ও সাংগঠনিক ছাত্রদের বাছাই করে সুযোগ ও বাধ্যতামূলক উদ্যোক্তা তৈরী করতে হবে, নিরুৎসাহিত করতে হবে মেধাবীদের সরকারী চাকরি, সরকার প্রজেক্ট ভিত্তিক বেশিমূল্যে মেধাবীদের নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে নিয়োগ দেবে, সারা জীবন লালন পালন করার আত্নঘাতী পদ্ধতি থেকে ধীরে ধীরে সরে আসতে হবে। বৃদ্ধ বয়সের নিরাপত্তা জাতীয় সঞ্চয়পত্রের পেনশন স্কিম দেবে, সরকার নয়।

(চলবে)
তথ্যসূত্র: karunews24.com

No comments

Theme images by 5ugarless. Powered by Blogger.