উল্টো যাত্রায় পার্বত্য চট্টগ্রাম

সরকারি সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি নাগরিক সমাজ ও হিউম্যান রাইটস ফোরামের     


হঠাৎ করেই পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি উল্টোপথে যাত্রা শুরু করেছে। জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভীর অল্প দিনের ব্যবধানে দুটি বৈঠকের মাধ্যমে পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকতা আসছিল। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক একটি সভার সিদ্ধান্ত সব উল্টে দিয়েছে।
গত ৭ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত ওই সভায় পার্বত্য চট্টগ্রামে ইউএনডিপির উন্নয়ন প্রকল্প পরিবীক্ষণ, সেখানকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সমন্বিত অভিযান পরিচালনা, দেশি-বিদেশি নাগরিকদের পার্বত্য অঞ্চল ভ্রমণ ও কোনো পার্বত্য অধিবাসীর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করাসহ আরও কতিপয় বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ আরোপের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব নিয়ন্ত্রণ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের আগের সময়ের চেয়েও কঠিন বলে সরকারি-বেসরকারি সংশ্লিষ্টরা বলেছেন।
সভার কার্যবিবরণীতে দেখা যায়, সভার শুরুতে স্বরাষ্ট্রসচিব মোজাম্মেল হক খান বলেন, বিজিবির একটি রিপোর্টের ভিত্তিতে এবং আইনশৃঙ্খলা উন্নয়ন ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে অদ্যকার সভা আহ্বান করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নে যে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়, তার জবাবদিহি নেই বললেই চলে। পার্বত্য জনপদে ইউএনডিপি ও অন্যান্য এনজিও যেসব উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে, তা তদারক করা দরকার।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমা প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের এসব সিদ্ধান্ত পার্বত্য চুক্তির বিরোধী, বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন। এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি চুক্তিপূর্ব অবস্থায় ফিরে যেতে পারে।
গত মাস দুয়েকের মধ্যে গওহর রিজভী ও সন্তু লারমার মধ্যে একবার চট্টগ্রামে ও আরেকবার রাঙামাটিতে বৈঠক হয়। দুটি বৈঠকেরই আলোচ্য বিষয় ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ নিরসন। গওহর রিজভী ভূমি বিরোধ নিরসনে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার সরকারি উদ্যোগের কথা জানিয়েছিলেন। তাতে সন্তু লারমা সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছিলেন, এটিই পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান সমস্যা। এই সমস্যার নিরসন হলে পার্বত্য চুক্তির প্রধান মৌলিক বিষয়টির নিষ্পত্তি হবে।
ওই দুটি বৈঠকের পর পার্বত্যবাসীর মধ্যে কিছুটা স্বস্তি দেখা যায়। চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে ১ মে থেকে যে কঠোর আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছিল, তা পরিবর্তনের কথাও ভাবতে শুরু করেছিল তারা।
সরকারের এসব সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় নাগরিক সমাজের নেতারা বলেছেন, সরকারের বিধিনিষেধ দেশের সংবিধান, মৌলিক মানবাধিকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পরিপন্থী। বিধিনিষেধ প্রত্যাহার না করলে হাইকোর্টে রিট করা হবে বলে জানানো হয়েছে।
গতকাল বুধবার সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে এক আলোচনায় সরকারের বিতর্কিত সিদ্ধান্তগুলো প্রত্যাহারের দাবি করা হয়। সাংবাদিক-লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদের সভাপতিত্বে এতে বক্তব্য দেন মানবাধিকার কর্মী হামিদা হোসেন, ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পংকজ ভট্টাচার্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের সদস্য ইফতেখারুজ্জামান ও সারা হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেজবাহ কামাল ও হাফিজুর রহমান কার্জন, সাংবাদিক আবু সাঈদ খান প্রমুখ।
এ ছাড়া গতকাল সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নাগরিকদের মৌলিক অধিকার নিয়ন্ত্রণে সরকারের নতুন সিদ্ধান্ত অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ। ১৯টি মানবাধিকার সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ওই ফোরামের আহ্বায়ক ও পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের কো-চেয়ার সুলতানা কামাল স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে সামগ্রিক বিষয় ব্যাখ্যা করে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্য সাংসদ, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
কী সিদ্ধান্ত সরকারের: স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, গত ৭ জানুয়ারির সভাটি আসলে একটি আন্তমন্ত্রণালয় সভা। সেখানে স্বরাষ্ট্র ছাড়াও পররাষ্ট্র ও পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
ওই সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গত ১০ বছরে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৬ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয়ে যেসব উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে, তার ফলাফল জানতে চাওয়া হয়েছে। এখন থেকে ওই অঞ্চলে ইউএনডিপির সব কার্যক্রম বিশেষভাবে পরিবীক্ষণ করারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকায় ইউএনডিপির একজন নির্ভরযোগ্য কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের কাছ থেকে এ রকম কোনো অনুরোধ গতকাল বুধবার পর্যন্ত তাঁরা পাননি। তবে তাঁদের সব প্রকল্প সরকারি অনুমোদনক্রমে গ্রহণ ও সরকারের সঙ্গে এক প্রকার যৌথ উদ্যোগে বাস্তবায়ন করা হয়। এ-সংক্রান্ত সব তথ্যও সরকারের কাছে আছে।
সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, দেশি কিংবা বিদেশি কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা পার্বত্য অঞ্চলে ‘উপজাতীয়দের সঙ্গে’ সাক্ষাৎ কিংবা বৈঠক করতে চাইলে সেখানে স্থানীয় প্রশাসন, বিজিবি বা সেনাবাহিনীর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে।
গতকাল নাগরিক সমাজের আলোচনায় প্রবীন রাজনীতিক পংকজ ভট্টাচার্য বলেন, প্রশাসনের লোকের উপস্থিতিতে দেখা-সাক্ষাৎ, কথা-বার্তার এই ব্যবস্থা জেলখানায় প্রচলিত। তাহলে কি ধরে নেওয়া যায় যে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামকেও জেলখানা হিসেবে বিবেচনা করছে!
সভায় একজন নারী বলেন, অনেক পার্বত্য নারী ও বাঙালি পুরুষ বিয়ে করেছেন। তাঁদের একত্রে বসবাসের ক্ষেত্রে সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হবে কীভাবে। শান্তি বাহিনী যুদ্ধরত অবস্থায়ও পার্বত্য চট্টগ্রামে এমন বিধিনিষেধ ছিল না।
সরকারের আরেকটি সিদ্ধান্ত হচ্ছে, কূটনীতিক ছাড়া কোনো বিদেশি পার্বত্য চট্টগ্রামে যেতে চাইলে এক মাস আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করবেন। সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে মন্ত্রণালয় অনুমতি দেবে। এরপর সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক বা পুলিশ সুপারের কাছে সংশ্লিষ্ট বিদেশি নাগরিক সেখানে তাঁর উপস্থিতি ও ভ্রমণসূচি জমা দিয়ে ভ্রমণ করবেন। আর কূটনীতিকদের সেখানে যেতে হবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমতি সাপেক্ষে।
আরেকটি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিবিরোধী সশস্ত্র সংগঠন ও স্থানীয় সন্ত্রাসী গ্রুপের চাঁদাবাজি, খুন, অপহরণ, মাদকদ্রব্য ও অস্ত্র চোরাচালান রোধে সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, আনসারের সমন্বয়ে যৌথ অভিযান চালানো হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির চারটি অধ্যায়ের ৭২টি ধারার অধিকাংশ বাস্তবায়িত হলেও আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমা তা স্বীকার করেন না। উপজাতীয় নেতাদের বিরোধিতার কারণে গত ২২ বছরেও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন করা যায়নি।

তথ্যসূত্র : প্রথমঅালো

No comments

Theme images by 5ugarless. Powered by Blogger.