পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩ হাজার ৯১১ একর ভূমি দখল, সমতলের ৩০০ আদিবাসীর দেশত্যাগ

 ২০১৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রায় ৩,৯১১ একর ভূমি সরকারি ও বেসরকারি ব্যক্তি কর্তৃক অধিগ্রহণ বা দখল করা হয়েছে এবং সেখানে আরো ৮৪,৬৪৭ একর ভূমি জবরদখল ও অধিগ্রহণের জন্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এছাড়া বছরব্যাপী ১০২টি আদিবাসী পরিবার নিজেদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের শিকার হয়েছে এবং সমতলের প্রায় ৩০০ আদিবাসী দেশত্যাগ করেছে।

এছাড়া গতবছর ভূমিদস্যু এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের সেটেলাররা আদিবাসীদের উপর ৭টি সাম্প্রদায়িক হামলা করেছে এবং তাদের বাড়ি ও সম্পত্তি লুট করেছে। ৭জন আদিবাসী নারীসহ  মোট ১৫ জন আদিবাসীকে হত্যা করা হয়েছে এবং অন্তত ১২৬জন আদিবাসীকে শারিরীকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। গতবছর কমপক্ষে ১২২ জন আদিবাসী নারী ও শিশু যৌন ও শারীরিক সহিংসতার শিকার হয়। শুধুমাত্র নারীদের উপর কমপক্ষে ৭৫টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, অভ্যন্তরীন উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনসহ চুক্তির মূল বিষয়গুলো গত ১৭ বছরেও বাস্তবায়ন করা হয়নি। সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতি সরকার দিলেও এখন পর্যন্ত এব্যাপারে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।

বাংলাদেশের আদিবাসীদের মানবাধিকার রিপোর্ট ২০১৪ এর প্রকাশ ও মোড়ক উন্মোচন উপলক্ষে শুক্রবার সকাল ১১টায় দি ডেইলি স্টার ভবনের তৌফিক আজিজ খান সেমিনার হলে আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ও মানবাধিকার রিপোর্টের অন্যতম একজন সম্পাদক পল্লব চাকমা এসব তথ্য তুলে ধরেন।

কাপেং ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন রবীন্দ্রনাথ সরেন এর সভাপতিত্বে মোড়ক উন্মেচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ও আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল। সম্মানিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন হাজেরা সুলতানা এমপি; বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং। স্বাগত বক্তব্য রাখেন কাপেং ফাউন্ডেশনের ভাইস চেয়ারপার্সন চৈতালী ত্রিপুরা এবং সঞ্চালনা করেন কাপেং ফাউন্ডেশনের হিরন মিত্র চাকমা। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ান ও অক্সফামের সহযোগিতায় কাপেং ফাউন্ডেশন প্রতিবছরের ন্যায় আদিবাসীদের মানবাধিকার বিষয়ক বার্ষিক এই রিপোর্ট প্রকাশ করেছে।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে সুলতানা কামাল বলেন, সমতল এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় আমি নিজে আদিবাসীদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সরেজমিনে দেখে এর সত্যতা পেয়েছি। তবে আশঙ্কা করতেই হয় যে আদিবাসীদের উপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর কোন বিচার হবে কিনা। শুধু তাই নয় যারা আদিবাসীদের জন্য কাজ করে তাদের উপরও কোন ধরনের হামলা হলে সেটিরও বিচার হবে কিনা সন্দেহ থেকেই যায়।

তিনি পার্বত্য চট্ট্রগাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এবং সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান।

হাজেরা সুলতানা এমপি বলেন, আদিবাসীদের জীবন ভূমিকে নিয়েই। এখন যেভাবে আদিবাসীদেরকে জমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে তাতে করে তারা কিভাবে বাঁচবে? সরকার পার্বত্য চুক্তির বিভিন্ন ধারা বাস্তবায়ন করছে, কিন্তু ভূমি বিষয়টা বাদ দিয়ে সরকারের কোন উন্নয়ন কার্যক্রম নিয়ে লাভ হবেনা। তিনি ভূমি বিষয়ে আন্তরিকভাবে কাজ করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

তিনি আরো বলেন, আদিবাসীদের জীবন প্রকৃতি নির্ভর হলেও ইকো পার্কের নামে, পর্যটন কেন্দ্রের নামে  তাদেরকে নিজ বসতভিটা, জমি-জায়গা থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। তিনি এর বিরুদ্ধে সকলকে কাজ করার আহ্বান জানান এবং আদিবাসীর প্রতি মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচারের দাবি জানান।

সঞ্জীব দ্রং বলেন, যে কোন ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে দেশের সংখ্যালঘূ, আদিবাসী মানুষদের প্রতি নির্যাতন-নিপীড়ণের ঘটনা বেড়ে যায়। বছরের শুরু থেকে আদিবাসীদের উপর একর পর এক সহিংসতার ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। আজকে আমরা আদিবাসীরা আমাদের উপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো প্রকাশ করছি। রাষ্ট্র নিশ্চয় এগুলো ইতিবাচকভাবে দেখবে এবং আদিবাসীদের মানবাধিকার রক্ষার ব্যবস্থা নিবে।

সভাপতির বক্তব্যে রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন, আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধারা এখন দেশত্যাগ করছে। কখন একজন মুক্তিযোদ্ধা দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়? আদিবাসীদের উপর এভাবে নির্যাতন নিপীড়ণ চললে আগামীতে আরো অনেক আদিবাসী দেশত্যাগ করবে বলে তিনি শঙ্কা প্রকাশ করেন। আদিবাসীদের প্রতি মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার এবং অপরাধীদের দায়মুক্তির সংস্কৃতি থেকে সরকার এবং  প্রশাসনকে বের হয়ে এসে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানান।

বাংলাদেশের আদিবাসীদের মানবাধিকার বিষয়ক রিপোর্ট ২০১৪ এর সম্পাদনা করেছেন প্রফেসর মংসানু চৌধুরী ও কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা। মানবাধিকার রিপোর্টের কন্ট্রিবিউটর হিসেবে কাজ করেছেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহ সাধারণ সম্পাদক বিনোতাময় ধামাই; বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সদস্য পার্বতী রায়; কাপেং ফাউন্ডেশনের প্রকল্প সমন্বয়কারী বাবলু চাকমা; আদিবাসী মানবাধিবার ডিফেন্ডার নেটওয়ার্কের সদস্য সায়ন দেওয়ান; জাতীয় আদিবাসী পরিষদের তথ্য ও গবেষনা সম্পাদক মানিক সরেন; আদিবাসী মানবাধিবার ডিফেন্ডার নেটওয়ার্কের সদস্য অন্ময় কিরন চাকমা; বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সদস্য সিলভিয়া খিয়াং ও কাপেং ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা মঙ্গল কুমার চাকমা।

এছাড়াও রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশে বাঙালি ছাড়াও ৫৪টির অধিক আদিবাসী জাতি বসবাস করলেও সংবিধান এসব নৃতাত্ত্বিক, ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক সংখ্যালঘুদেরকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার আদিবাসীদেরকে “উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়” হিসেবে অভিহিত করেছে। সেই সাথে বাংলাদেশের জনগণকে জাতি হিসেবে বাঙালী পরিচিতি প্রদান করার ফলে এসব আদিবাসী জাতিসমূহকেও ‘বাঙালি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অধিকন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখিত ‘আদিবাসী’ শব্দটির পরিবর্তে ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়ে নির্বাচনী ইশতেহারে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ আদিবাসীদেরকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও ট্রাইবাল হিসেবে অভিহিত করেছে।

তথ্যসূত্র: আদিবাসী নিউজ

No comments

Theme images by 5ugarless. Powered by Blogger.