রাঙ্গামাটিতে ফের সংঘর্ষ শহরে কারফিউ জারি
হিমেল চাকমা, রাঙ্গামাটি:
১৪৪ ধারার মধ্যে রাঙ্গামাটিতে আবারো সংঘর্ষ হয়েছে। এতে আহত হয়েছে অন্তত ৪
জন। গতকাল রোববার বিকেল ৫টার দিকে বনরুপা শহরে এই ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি
নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে প্রশাসন সন্ধ্যা ৭টায় শহরে কারফিউ জারি করে।
রাঙ্গামাটি পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ বিষয়টি নিশ্চিত করেন। স্থানীয়রা
বলেন, বিকেল ৫টার দিকে বনরুপা শহরের পাহাড়ি অধ্যুষিত দোকানগুলোতে এক
ব্যক্তি আগুন লাগাতে গিয়ে দোকানদাররা তাকে ধাওয়া দেয়। পাহাড়িরা মারছে মারছে
বলে দৌড় দিয়ে বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা গেলে সেখানে বাঙালিরা প্রতিরক্ষা গড়ে
তুললে শুরু হয় ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে
গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে। এ খবরে পুরো শহরে
উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। প্রশাসনের বৈঠক পণ্ড: এ সময় জেলা প্রশাসনের সম্মেলন
কক্ষে রাঙ্গামাটির সার্বিক পরিস্থিতি ও কিভাবে স্বাভাবিক করা যায় এই নিয়ে
বৈঠক চলছিল। নির্বাচিত এমপি উষাতন তালুকদার, সংরক্ষিত মহিলা এমপি ফিরোজা
বেগম চিনু, রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা, জেলা
প্রশাসক সামসুল আরেফিন, জোন কমান্ডার লে. কর্নেল মালিক সাম্স উদ্দিন
মুহাম্মদ মঈন, পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ, সদর উপজেলা চেয়ারম্যান অরুন
কান্তি চাকমা, রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ এবং জেলার গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা
উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক চলাকালে সংঘর্ষের খবর আসলে নিরাপত্তা বাহিনীর
গুরুত্বপূর্ণ কর্তাদের মোবাইলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবস্থা নেয়ার
নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু তবুও চারদিকে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে বৈঠকের কোনো
সিদ্ধান্ত ছাড়া একে একে সবাই উঠে যান।
ভুতুড়ে শহর রাঙ্গামাটি: গত ১০ জানুয়ারি জেএসএস সমর্থিত পিসিপির ১ দিনে অবরোধে পরিবর্তন হয়েছে রাঙ্গামাটি। রাঙ্গামাটি এখন পরিণত হয়েছে ভুতুড়ে শহরে। সন্ধ্যা ৭টায় প্রশাসন শহরে কারফিউ জারি করে। থেমে থেমে বেজে উঠছে কারফিউ ঘোষণার মাইক। মাঠে রয়েছে অতিরিক্ত সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ। ভয় আতঙ্কে ঘর থেকে বের হচ্ছে না মানুষ। সন্ধ্যা হতেই রাঙ্গামাটি শহর পরিণত হচ্ছে ভুতুড়ে নগরীতে। শুরু হচ্ছে একের পর এক গুজব। শুরু হয় ডাকাডাকি। সাইরেন বাজিয়ে সেখানে ছুটছে পুলিশের গাড়ি।
রাঙ্গামাটির হঠাৎ এই পরিবর্তন ভাবিয়ে তুলেছে সবাইকে। আগামী ৩০ এপ্রিল চুক্তি বাস্তবায়নের আল্টিমেটাম, ১ মে থেকে জেএসএস সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় ওরফে সন্তু লারমার অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা ভাবিয়ে তুলেছে পার্বত্যবাসীকে। তারা বলছেন, একদিনের পরিস্থিতি সামাল দিতে নড়েচড়ে বসতে হয়েছে প্রশাসনকে। অসহযোগ আন্দোলনে কি হবে তা নিয়ে এখন জনমনে নানান প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভের বহির্প্রকাশ। এই অঞ্চলকে নিয়ে সরকারকে ভাবতে হবে। এখানে আদিবাসীদের বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনযাপন। তাদের রয়েছে প্রথাগত আইন সংস্কৃতি। এর জন্য ১৯৯৭ সালে হয়েছে পার্বত্য শান্তি চুক্তি। কিন্তু দীর্ঘ ১৮ বছরেও চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়া, ভূমি বিরোধকে জিইয়ে রাখা, আদিবাসীদের প্রথাগত আইনকে ভঙ্গ করে একের পর এক আদিবাসীবিরোধী কর্মসূচি নেয়ায় তাদের মধ্যে ক্ষোভ জমেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান মানবকণ্ঠকে বলেন, আজকে রাঙ্গামাটিতে যে পরিবেশ সৃষ্টি হলো তা অনেক আগে আমরা আশঙ্কা করেছিলাম। এ জন্য আমরা সরকারের কাছে বারবার অনুরোধ ও দাবি রেখেছি কিন্তু সরকার কর্ণপাত করেনি। আজকে রাঙ্গামাটিতে যে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে এটি পাহাড়ি-বাঙালিদের বিরোধ নয়। কিন্তু অনেকে পাহাড়ি-বাঙালি বলে অপপ্রচার চালাচ্ছে। তা ঠিক নয়। এই এলাকাটি একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ ও আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল। শুধু এই অঞ্চলটির জন্য পার্বত্য চুক্তি হয়েছে। জেলা পরিষদ, আঞ্চলিক পরিষদ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন হয়েছে।
তিনি বলেন, এই এলাকায় মেডিকেল হচ্ছে, প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে কিন্তু আদিবাসী পার্বত্য চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নের আগে এগুলো কেউ চাচ্ছে না। তাই সরকারের একটু ভাবা উচিত ছিল। কিন্তু সরকার আমাদের দাবিকে পুরো উড়িয়ে দিয়েছে। জোর করে কোনো কিছু চাপিয়ে দিলে যা হয় তা হচ্ছে এখানে। এই পরিবেশ আমাদের কারো কাম্য নয়।
বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য নিরুপা দেওয়ান মানবকণ্ঠকে বলেন, এখানে একে অপরের আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। দ্রুত এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া না হলে দূরত্ব আরো বেড়ে যাবে। এ নিয়ে প্রশাসনের ভূমিকা রাখতে হবে। উভয় পক্ষের দাবি নিয়ে আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। উল্লেখ্য, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন ও পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষার মান উন্নয়ন না হওয়া পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে মেডিকেল কলেজ স্থাপনের সব কার্যক্রম বন্ধের দাবিতে পার্বত্য চট্টগ্রামভিত্তিক পাহাড়ি সংগঠনগুলো আন্দোলন চালিয়ে আসছিল। এই দাবিকে উপেক্ষা করে সরকার রাঙ্গামাটিতে মেডিকেল কলেজ ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কাজ শুরু করেছে। তার ধারারাহিকতায় গত ১০ জানুয়ারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর প্রতিবাদে শনিবার রাঙ্গামাটি জেলা সড়ক ও নৌপথ অবরোধের ডাক দেয় জেএসএস সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ। এই অবরোধকে কেন্দ্র করে অবরোধকারী ও ছাত্রলীগ, যুবলীগ কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে তিন সাংবাদিকসহ প্রায় ৪০ জন আহত হয়। ভাঙচুর করা হয় গাড়ি, ইসলামী ব্যাংক, টেলিটক গ্রাহকসেবা সেন্টার শেভরন ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ একাধিক দোকানপাট। এ ঘটনার জেরে গতকালও সংঘর্ষ হয়।
তথ্য সুত্র : মানবকন্ঠ
No comments
Post a Comment