ঢাকা মেডিকেলে হৃদয়বিদারক দৃশ্য যাত্রাবাড়ীতে বাসে বোমা, দগ্ধ ২৮

যাত্রাবাড়ীর কাঠেরপুল এলাকায় গতকাল রাতে বাসে পেট্রলবোমা হামলায় দগ্ধ কয়েকজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে l ছবি: প্রথম আলো
     



রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানা এলাকায় গতকাল শুক্রবার রাতে যাত্রীবাহী বাসে পেট্রলবোমা হামলা করেছে দুর্বৃত্তরা। এতে দুই নারীসহ ২৮ যাত্রী দগ্ধ হয়েছেন। হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে আহত হয়েছেন আরও একজন। দগ্ধদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর।
ঘটনার পর দগ্ধ ব্যক্তিদের একে একে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হলে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে কারও পুড়ে গেছে মুখ, কারও হাত, কারও পা। কারও নাক-মুখ থেঁতলে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। তীব্র যন্ত্রণা আর ব্যথায় ছটফট করছিলেন অনেকেই। খবর পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসেন স্বজনেরা। কারও কারও কণ্ঠে তখন তীব্র ক্ষোভ।
দগ্ধ যাত্রী ও যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশ জানায়, রাত পৌনে ১০টার দিকে গুলিস্তান থেকে যাত্রীবাহী গ্লোরি পরিবহনের একটি বাস নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে যাচ্ছিল। বাসটি ডেমরা রোডের কাঠেরপুল এলাকায় পৌঁছালে কে বা কারা বাসের বাঁ পাশে পেট্রলবোমা ছুড়ে মারে। এতে বিকট শব্দ হয়ে পুরো বাসেই আগুন ধরে যায়। এতে দগ্ধ হন ২৮ জন। নামতে গিয়ে আহত হন আরও একজন। অন্য যাত্রীরা দরজা ও জানালা দিয়ে কোনো রকমে নেমে প্রাণে রক্ষা পান।
আহত ব্যক্তিরা হলেন শরীফ খান, তকবীর ইসলাম, সালাউদ্দিন পলাশ, সালমান, মোশারফ হোসেন, মোশারফের ভাতিজা সালাউদ্দিন, জয়নাল আবেদীন, খোকন, ইসতিয়াক আহমেদ, নাজমুল হোসেন, ইয়াসির আরাফাত, ইয়াসিরের স্ত্রী শাহীদা ফাতেমা, রাশেদুল ইসলাম, নূর আলম, ওসমান গনি, মো. সুমন, ফারুক হোসেন, মো. রুবেল, মোমেন, রফিকুল ইসলাম, তানভীর, আরিস মিয়া, মো. জাবেদ, আবু মিয়া, শহীদুল ইসলাম, মোজাফফর মোল্লা, শাহজাহান, আবুল হোসেন ও আফরোজা বেগম। এঁদের মধ্যে আফরোজা ছাড়া বাকি সবাই দগ্ধ। দগ্ধদের ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে।
বার্ন ইউনিটের অধ্যাপক সাজ্জাদ খন্দকার সাংবাদিকদের জানান, ২৯ জনের মধ্যে নয়জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাঁদের প্রত্যেকের শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। বাকি ২০ জনের সর্বনিম্ন ২০ থেকে সর্বোচ্চ ৪০ ভাগ পুড়ে গেছে।
রাত ১০টার দিকে বার্ন ইউনিটে গিয়ে দেখা যায়, দগ্ধদের ধরাধরি করে আনা হচ্ছে। চারদিকে চিৎকার, আর্তনাদ, আহাজারি। গণমাধ্যমের কর্মী ছাড়াও স্বজনদের ভিড়। খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন বার্ন ইউনিটের ঊর্ধ্বতন চিকিৎসকেরাসহ অনেকেই। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে একে একে আহত ব্যক্তিদের পাঠানো হচ্ছে পর্যবেক্ষণকক্ষে।
বার্ন ইউনিটের ভেতরে গিয়ে দেখা গেছে, আগুনে মুখ আর হাত পুড়ে গেছে ইয়াসিরের। একটি বেঞ্চে বসে হাঁপাচ্ছিলেন তিনি। কথাও বলতে পারছিলেন না। অন্য পাশে শয্যায় কাতরাচ্ছিলেন তাঁর স্ত্রী শাহীদা। মুখ আর চুল পুড়ে গেছে তাঁর। শাহীদার পাশে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন খবর পেয়ে ছুটে আসা শ্বশুর আবু বকর।
জানতে চাইলে আবু বকর বলেন, তাঁর ছেলে ইয়াসির ও ছেলের বউ শাহীদা দুজনই ফার্মাসিস্ট। মাতুয়াইলে থাকেন তাঁরা। ইয়াসির গাজীপুরের একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। শাহীদা ডেমরায়। দুজনই বাসায় ফিরছিলেন।
দগ্ধ তকবীর একসময় বাস্কেটবল খেলতেন। বর্তমানে একটি প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কর্মকর্তা। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে থাকেন। মিরপুরে বোনের বাসা থেকে নারায়ণগঞ্জে ফিরছিলেন। আগুনে পুড়ে গেছে তাঁর নাক। পুড়েছে চুল। তকবীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘হঠাৎ দেখলাম, বাসের বাঁ পাশে কে বা কারা যেন কী একটা ছুড়ে মারল। এরপর শুধুই আগুন আর আগুন। আমি জানালার কাচ ভেঙে নেমে যাই।’
বার্ন ইউনিটের সামনে আল আমিন নামের এক ব্যক্তি সাংবাদিকদের জানান, তিনি ওই বাসের যাত্রী ছিলেন। দগ্ধ মোজাফফর ও শাহজাহান তাঁর খালু। তিনি, তাঁর বাবা, দুই খালু ও এক বন্ধুসহ মিলে বিশ্বরোড এলাকায় তাঁর (আল আমিন) বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে যাচ্ছিলেন।
আল আমিন বলেন, ‘বাসটা চলন্ত অবস্থায় ছিল। যেখানে ঘটনা সেখানে ছিল কিছুটা অন্ধকার। আমি বাসের বাঁ পাশের সিটে জানালার পাশে ছিলাম। হঠাৎ কইরা বাসের সামনের লাইটের আলোতেই দেখলাম দুইটা ছেলে কী যেন একটা ছুইড়া মাইরা দৌড় দিছে। সঙ্গে সঙ্গে দেখি আগুন আর আগুন। আমি জানালা দিয়া নাইমা পড়ি। তয় আমার ওই দুই খালু পুড়ে যায়। আমার বাবা ও বন্ধু সামান্য আহত হইছে।’ ছেলে দুটো অল্পবয়সী, বয়স ১২ কি ১৩ হতে পারে বলে জানান আল আমিন।
এক আত্মীয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে কেরানীগঞ্জে গিয়েছিলেন নাজমুল হোসেন। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে তাঁর বাসা। সেখানকার স্থানীয় একটি কলেজের উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। অনুষ্ঠান শেষে বাসায় ফিরছিলেন তিনি। বার্ন ইউনিটের পর্যবেক্ষণ কক্ষের বাইরে জানালা দিয়ে ছেলের পোড়া মুখ দেখে চোখের পানি ফেলছিলেন বাবা আবদুল লতিফ। জানতে চাইলে আবদুল লতিফ বলেন, ‘বাবা, কার কাছে বিচার দিমু?’
পাশেই হাউমাউ করে কাঁদছিলেন দগ্ধ নূর আলমের স্ত্রী চম্পা বেগম। তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন স্বজনেরা। আরেক স্বজন ক্ষোভে চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘এ দেশে কোনো বিচার নাই, বিচার নাই।’ স্বজনেরা জানান, নূর আলম ঠিকাদারি ব্যবসা করেন। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে থাকেন। মিরপুরে বোনের সঙ্গে দেখা করে বাসায় ফিরছিলেন তিনি।
বার্ন ইউনিটের ভেতরে পাশাপাশি বসে ‘আল্লাহ’ ‘আল্লাহ’ করেছিলেন দগ্ধ সালাউদ্দিন ও তাঁর চাচা মোশারফ। সালাউদ্দিনের মুখের বেশির ভাগ অংশ পুড়ে গেছে। মুখ পুড়ে গেছে মোশারফের। তাঁদের দিকে তাকিয়ে অঝোরে কাঁদছিলেন সালাউদ্দিনের বড় ভাই আবদুর রহমান। সালাউদ্দিন ও মোশারফ দুজনই এলিফ্যান্ট রোডে এক দোকানে চাকরি করেন। নারায়ণগঞ্জে বাসায় ফিরছিলেন তাঁরা।
ঘটনার পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক দীন মোহাম্মদ নূরুল হক বার্ন ইউনিটে যান। তিনি পরে সাংবাদিকদের জানান, এটা বীভৎস ঘটনা। শুধু এদেরকেই পোড়ানো হয়নি, তাদের পরিবারকেও ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। যারা এ কাজ করেছে, তারাও জানে না কত বড় ক্ষতি করেছে তারা।

তথ্যসূত্র : প্রথম আলো

No comments

Theme images by 5ugarless. Powered by Blogger.