পাহাড়িদের শ্মশানের ভূমি দখল করে নিয়েছে বিজিবি


বিজিবিকে ওই জমি দেওয়ার বিরোধিতা করে রোয়াংছড়ির মারমা এবং ব্যোম জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত হ্লাপাইক্ষিয়ং মৌজার হেডম্যান নাউমে প্রু বলেন, ১৯০০ সালের আইন ও পার্বত্য শান্তি চুক্তি অনুযায়ী পুরো পাহাড়ে কোনো খাস জমি নেই। বসবাসের জায়গা ছাড়া বাকি জমি জুম চাষের।
“যেহেতু পাহাড়িদের নিজস্ব ভূমি আইন কার্যকর সেক্ষেত্রে সরকারের ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে স্থানীয় রাজা বা হেডম্যানের সঙ্গে কথা বলা নিয়ম। কিন্তু সেই ধরনের কোনো আলাপ-আলোচনা বিজিবি কর্তৃপক্ষ বা জেলা প্রশাসন কেউই করেননি।”
ওই জমিতে জুম চাষ করে ৩০০ পাহাড়ি পরিবারের ভরণ-পোষণ হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “এইখানে মারমাদের একটি শ্মশান আছে। আর এক পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর শ্মশানে অন্য পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মৃতদেহের সৎকার করা যায় না।”
সম্প্রতি ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পুরো এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে একটা অস্থায়ী ক্যাম্প বসিয়েছে বিজিবি। সেখানে প্রায় ৩০ জন জওয়ান অবস্থান করছেন। কাউকে সেই জমিতে ঢুকতেও দেওয়া হচ্ছে না।
ওই পাহাড়ি জমিতে মারমাদের জুমের ফসল থাকায় প্রায়ই তারা কাঁটাতারের বেড়ার সামনে গিয়ে জড়ো হন ভেতরে লাগানো ফসল তদারকির জন্য।
ওইসময় প্রায় আড়াইশ নারী-পুরুষকে কাঁটাতারের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় ভেতরে ঢোকার অপেক্ষায়। কিন্তু বিজিবির জওয়ানরা তাদের ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছিলেন না।
ওই জমির পাশের গ্রাম ক্লাইক্ষ্যংপাড়ার বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী ম্যং ক্য চিং মারমা বলেন, “ওই জমিতে আমাদের শ্মশান রয়েছে। এর বয়স প্রায় ১০০ বছর। আর আমাদের রীতি অনুযায়ী এক পাড়ার (গ্রাম) মরদেহ অন্য পাড়ায় দাহ করা হলে তাকে অমঙ্গল হিসেবে দেখা হয়।”
বান্দরবান সরকারি কলেজের ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র উকে চিং মারমা বলেন, “আমাদের ফসল কাটার সময় এসে গেছে। অথচ গত প্রায় মাস খানেক ধরে আমাদের ওই জমিতে ঢুকতেই দেওয়া হচ্ছে না।”
ওই দিন অপেক্ষারত পাহাড়িদের ফেরত পাঠানোর পর জমিতে ঢোকার অনুমতি মেলে সাংবাদিকদের।
বিজিবি ক্যাম্প ছাড়িয়ে ৮ থেকে ১০ মিনিটের একটি পায়ে চলা পথ ধরে হাঁটার পর একটি ঢালের নিচেই দেখা মেলে এক টুকরো জমির, সেখানে সাইনবোর্ডে লেখা ‘ক্লাইক্ষ্যংপাড়া মহাশ্মশান’।
শ্মশানের পাশে পাহাড়ের ঢালে জুমের জমিতে দেখা যায় হলুদের চাষ।
দেশের প্রচলিত আইনেও ধর্মীয় স্থাপনার জায়গা অধিগ্রহণের সুযোগ না থাকার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জেলা প্রশাসক কে এস তাজুল ইসলাম বলেন, “বিজিবি এই জমি অধিগ্রহণের জন্য আবেদন করেছে। আমরা ভূমি অধিগ্রহণ কমিটি এ ব্যাপারে কাজ করছি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও এ বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে।
“আমি সরেজমিনে ওই জমি দেখেছি। কিন্তু কোথাও কোনো শ্মশান দেখিনি। তবে ভূমি অধিগ্রহণ আইন অনুযায়ী ধর্মীয় স্থাপনা রয়েছে এমন জায়গা অধিগ্রহণ করা যায় না সত্যি। ওখানে যদি শ্মশান থেকে থাকে তাহলে অবশ্যই আইন অনুযায়ী আমরা বিবেচনা করব।”
পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য কে এস মং বলেন, “১৯৯৭ সালের স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে ভূমি ব্যবস্থাপনায় প্রথাগত আইন, রীতি ও পদ্ধতিকে পুরোপুরি স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণ কিংবা ব্যবস্থাপনা বিষয়ে রাজার ভূমিকা অগ্রাহ্য করা চুক্তির লঙ্ঘন। যে কোনো অধিগ্রহণে হেডম্যানের সুপারিশ প্রয়োজন হয়। কিন্তু বিজিবির সেক্টর সদর দপ্তরের জন্য হেডম্যানের সুপারিশ ছাড়া জমি দখল কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়।”
তিনি বলেন, “পার্বত্য শাসনবিধি ১৯০০-এর আইন অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে খাসজমি বলতে কিছু নেই। জমির মালিকানা স্বত্ত্ব মৌজা হেডম্যানের কাছে কিংবা সরাসরি সার্কেল চিফের হাতে ন্যস্ত থাকে।”
মাওরুম সাময়িকীর সম্পাদক দীপায়ন খীসা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুযায়ী ছয়টি স্থায়ী সেনানিবাস ও বিজিবি ক্যাম্প ব্যতীত সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর অন্যান্য অস্থায়ী ক্যাম্প সরিয়ে নেওয়ার কথা থাকায় নতুন করে সেক্টর দপ্তর নির্মাণের বিষয়টি চুক্তির পরিপন্থী।
ওইখানে বিজিবির দপ্তর হলে আশপাশের পাহাড়িদেরও উচ্ছেদের মুখে পড়তে হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
“কতবার তারা অভ্যন্তরীণ উচ্ছেদে একস্থান থেকে আরেক স্থানে ছুটে বেড়াবে? এই উচ্ছেদ আতঙ্কের দায় কে নেবে?” বলেন তিনি।
No comments
Post a Comment