পরচর্চা বনাম আত্মচর্চা

ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো
সভাপতি, পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ
পূর্ব প্রকাশিতের পর

প্রারম্ভ: সব্রহ্মচারী মাননীয় ভিক্ষু সংঘ ও পুণ্যবান পুণ্যবতী দায়ক-দায়িকাদের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করে একাদশ নিপাতে বর্ণিত সব্রহ্মচারী ভিক্ষুদের প্রতি আক্রোশকারী ভিক্ষুর একাদশটি বিপত্তি সম্বন্ধে এখানে আলোচনায় অবতীর্ন হতে চাই। এখানে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে যে, সব্রহ্মচারীদের প্রতি আক্রোশকারী ভিক্ষুর তাঁর জীবনে নিম্নলিখিত ১১ (এগার) টি বিপত্তির মধ্যে কোন একটি অবধারিতভাবে আসতে পারে। এ ১১ (এগার) টি বিপত্তি কি কি?
১। যা অপ্রাপ্ত, তা প্রাপ্ত হবে না;
২। যা প্রাপ্ত হয়েছে, তা নষ্ট হয়ে যেতে পারে;
৩। সদ্ধর্ম স্পষ্ট হবে না;
৪। সদ্ধর্মের বিষয়ে অহংকারী হয়ে পড়া;
৫। অনিচ্ছুকভাবে ব্রহ্মচর্য পালন করা;
৬। কোন গুরুতর দোষে অভিযুক্ত হওয়া;
৭। ভিক্ষু জীবন ত্যাগ করে হীন ধর্ম (গৃহস্থের জীবন) গ্রহণ;
৮। কোন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আতংকিত হয়ে উঠা;
৯। পাগল হয়ে যাওয়া;
১০। বেঁহুশ হয়ে মৃত্যু বরণ করা ও
১১। মৃত্যুর পর দূর্গতি প্রাপ্ত হওয়া।
করুণাঘন গৌতম বুদ্ধের কম্বুকণ্ঠের উচ্চারণ হলঃ
“ন তেন হোতি ধম্মট্ঠো যেনত্থং সহসা নরে,
যো চ অত্থং অনত্থঞ্চ উভো নিচ্ছেয়্য পণ্ডিতো।
[ধম্মপদ, ধম্মট্ঠ বগ্গো।]
(অনুবাদ)
যিনি বিচার বিবেচনায় রাগ, দ্বেষ, মোহ ও ভয় বশতঃ পক্ষপাতিত্ব করেন তদ্বারা তিনি ধর্ম্মস্থ বা ন্যায় বিচারক হতে পারেন না। যিনি অর্থ ও অনর্থ উভয় দিক বিবেচনায় নিয়ে ন্যায়ত নিরপেক্ষ ও সমদর্শী হয়ে, অপরাধের গুরুত্ব বিবেকের কষ্টি পাথরে যাচাই করে, অপরের জয়-পরাজয় নির্ধারণ করেন, তিনিই ন্যায় ধর্মের রক্ষক, বুদ্ধিমান ও সুবিচারক বলে উক্ত হন ও মর্যাদা লাভ করেন এবং সর্বত্র সমাদৃত হন। আমাদের স্বঘোষিত ষড়াভিজ্ঞালাভী শ্রাবকবুদ্ধ বনভান্তে মহোদয় কতটুকু ন্যায় ধর্মের রক্ষকের মর্যাদা পাবেন- তা কালের ইতিহাসই মূল্যায়ন করবে। তা আমার মতো অর্বাচীন ভিক্ষুর মূল্যায়নের বিষয় নয় । আর সব্রহ্মচারী ভিক্ষুদের প্রতি আক্রোশবশতঃ অথবা লোভ দ্বেষ, মোহ ও তৃষ্ণা, দৃষ্টি এবং মানবশতঃ প্রেত, শকুন, বাজার পরিষ্কারক আখ্যায় আখ্যায়িত করার কারণে বর্ণিত ১১ টি বিপত্তির কোন একটি তাঁর জীবনে এসেছিল কিনা- তাঁর ঘনিষ্ঠ অন্তেবাসী ভিক্ষু শ্রামণ অথবা সুক্ষ্মদর্শী বিচক্ষণ দায়ক-দায়িকা ছাড়া কেউ বলতে পারবেন না । তাঁদের মধ্যে এ বিষয়ে মতামত প্রদানের ক্ষেত্রে বিবেকপ্রসূত নিরপেক্ষতারও প্রয়োজন হতে পারে।

তবে এ বিষয়টি নির্দ্বিধায় বলবো- ১৯৭৩ খ্রি: অব্দের লংগদু তিনটিলায় অনুষ্ঠিত দানোত্তম কঠিন চীবর দানোৎসবের পরের দিন মহাসমুদ্র সদৃশ অনুত্তর পুণ্যক্ষেত্র মহাসংঘের প্রতি স্বঘোষিত ষড়াভিজ্ঞালাভী শ্রাবকবুদ্ধ শ্রীমৎ সাধনানন্দ মহাস্থবিরের (বনভন্তে) সংঘ ভেদাত্বক উক্তির পর পার্বত্য ভিক্ষুসংঘ ও বনভান্তের মধ্যে একটা সুষ্পষ্ট মানসিক দূরত্ব সৃষ্টি হয়। পার্বত্য ভিক্ষুসংঘের অন্তর্ভূক্ত ভিক্ষুসংঘের দুঃখ হল এই- পার্বত্য ভিক্ষুসংঘ মহাসমুদ্র সদৃশ। শত-সহস্র সংঘ সদস্য পার্বত্য ভিক্ষুসংঘের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত রয়েছেন । এছাড়াও উক্ত তিনটিলার দানোত্তম কঠিন চীবর দানানুষ্ঠানে শুধু পার্বত্য ভিক্ষুসংঘের অন্তর্ভূক্ত ভিক্ষুরা অংশ নেননি, চট্টগ্রামস্থ সংঘরাজ নিকায়েরও অনেক জ্ঞানী, গুণী ভিক্ষু অংশগ্রহণ করে সেদিন বনভান্তের প্রতি সৌহার্দ্য প্রকাশের পরম পরাকাষ্টা প্রদর্শন করার প্রয়াস পেয়েছেন । যেসব প্রখ্যাত স্থবির, মহাস্থবির তাঁকে ভিক্ষুত্বে দীক্ষা দিয়েছিলেন সেদিন তাঁরাও ঐ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। দূর্ভাগ্য হল- জলপথ ব্যতীত স্থল পথে সড়ক যোগাযোগ না থাকায় (কঠিন চীবর দানানুষ্ঠান সমাপ্তির পর) অধিকাংশ ভিক্ষু সেদিন তিনটিলার অনুষ্ঠান স্থলে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। যেকোন দানানুষ্ঠানের পর উপস্থিত ভিক্ষুসংঘ দান হিসেবে প্রাপ্ত সামগ্রীসমূহ সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভিক্ষুদের মধ্যে বিলি বণ্টন করে থাকেন । এটি হচ্ছে করুণাঘন বুদ্ধ প্রজ্ঞাপ্ত চিরাচরিত নিয়ম বা বিনয়ের বিধান । সেদিনও বোধ হয় ভিক্ষুসংঘ অনুরূপ বিলি বণ্টন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দানীয় সামগ্রীসমূহ ভিক্ষুদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়ার প্রয়াস পেয়েছিলেন। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর হৃদ্স্পন্দন স্বঘোষিত ষড়াভিজ্ঞালাভী শ্রাবকবুদ্ধ বনভান্তে মহোদয়ের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অবলম্বনে প্রাগুক্ত দানানুষ্ঠানে প্রদত্ত দানীয় সামগ্রী ভিক্ষুদের মধ্যে বিলি বণ্টনের প্রক্রিয়াটি অবলোকন করে বোধহয় মোটেই ভালো লাগেনি । হয়তোবা দানানুষ্ঠানে শ্রদ্ধাবান ও শ্রদ্ধাবতী দায়ক দায়িকাদের শ্রদ্ধাপ্রদত্ত দানীয় সামগ্রীর উপর তাঁর অবদমিত লোভ-সহগতচিত্ত উৎপন্ন হয়েছিল। তাই তিনি সেদিন মহাসমুদ্র সদৃশ অনুত্তর পুণ্যক্ষেত্র মহাসংঘকে প্রেত, শকুন ও বাজার পরিষ্কারক, আখ্যায় আখ্যায়িত করার পরম পরাকাষ্টা প্রদর্শন করে সংঘ ক্ষেত্রে সংঘভেদের বিষবৃক্ষ রোপণ করার পরাকাষ্টা দেখিয়েছিলেন।

করুণাঘন মানবপুত্র গৌতম বুদ্ধকে গণতন্ত্রের প্রবক্তা বলা হয় । লিচ্ছবী গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ সপ্ত অপরিহানীয় ধর্ম স্বয়ং করুণাঘন বুদ্ধের শ্রীমুখেই সুব্যাখ্যাত । লিচ্ছবীর তাবৎ জনগণের মাঝে সপ্ত অপরিহানীয় ধর্ম প্রশংসনীয়ভাবে সর্বক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল । প্রারম্ভিক পর্ব থেকে পার্বত্য ভিক্ষুসংঘ ও বুদ্ধ প্রবর্তিত ও প্রশংসিত সপ্ত অপরিহানীয় ধর্ম দর্শনের আলোকে সংঘ পরিচালনার পরম পরাকাষ্টা প্রদর্শন করে আসছিলেন । পার্বত্য ভিক্ষুসংঘের পূর্বসূরী কোন ভিক্ষু কোন কালেই স্থবির অথবা মহাস্থবির পুণ্যপুত ভিক্ষুসংঘকে জনসমক্ষে প্রেত, শকুন ও বাজার পরিষ্কারক আখ্যায় আখ্যায়িত করার দুঃসাহস দেখাননি । পুণ্যার্থী দায়ক-দায়িকাদের শ্রদ্ধাপ্রদত্ত দানীয় সামগ্রীও এককভাবে কুক্ষীগত করে যাচ্ছেতাইভাবে পরিভোগ করার কোন নজিরও পার্বত্য ভিক্ষুসংঘের অন্তর্ভূক্ত ভিক্ষুসংঘের ইতিহাসে নেই বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। এখন পার্বত্য ভিক্ষুসংঘের সদস্যভুক্ত তাবৎ ভিক্ষুসংঘের প্রশ্ন- আমাদের ষড়াভিজ্ঞালাভী শ্রাবকবুদ্ধ বনভান্তে মহোদয় মৈত্রী, করুণা, মুদিতা ও অহিংসার মূর্ত প্রতীক মানবপুত্র গৌতম বুদ্ধের ধর্ম-দর্শনের অনুসারী একজন সংঘ সদস্য হওয়া সত্ত্বেও সব্রহ্মচারীদের প্রতি কিরূপ আচরণ বাঞ্ছনীয় তা জানা থাকা সত্বেও কোন্ যুক্তিতে অপর সংঘ সমাজকে ‘প্রেত’, ‘শকুন’ ও ‘বাজার পরিষ্কারক’ আখ্যায় আখ্যায়িত করতে পারেন ? তিনি কি সপ্ত অপরিহানীয় ধর্ম সম্পর্কে জানেন না ? তিনি কি সুকৌশলে বনভিক্ষু সংঘ প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করার মানসে এরূপ সংঘ ভেদাত্বক কথা বলে কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন ? পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ একটি বিশাল বহু ঐহিত্যমণ্ডিত সংঘ সংগঠন । এ সংগঠনে অন্তর্ভূক্ত সব ভিক্ষুসংঘ সুশীল এরূপ দাবী করা অযৌক্তিক। করুণাঘন গৌতম বুদ্ধের আমলে স্বয়ং তাঁর দ্বারা সৃষ্ট ও তাঁর শিষ্য প্রশিষ্যদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সংঘের সকলেই যে সুশীল, সুদান্ত, এরূপ দাবী তিনি কখনো করেননি । কারণ, ভিক্ষু হিসেবে দীক্ষিত হওয়ার সাথে সাথে সব ভিক্ষুসংঘ যদি শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞায় বিমণ্ডিত থেকে আত্মঅন্বেষণে আত্মনিবেদিত থাকতেন তাহলে বিনয় পিটক সৃষ্টির কোন প্রয়োজন হয়ে পড়তো না । অতঃপর পার্বত্য ভিক্ষুসংঘের সদস্যদের মধ্যেও কিছু কিছু লোভাতুর ভিক্ষু থাকা স্বাভাবিক। তাই বলে পার্বত্য ভিক্ষুসংঘের তাবৎ ভিক্ষু দুঃশীল, ‘প্রেত’, ‘শকুন’, ‘বাজার পরিষ্কারক’ প্রভৃতি আখ্যায় আখ্যায়িত করে সংঘ ভেদের বিষবৃক্ষ রোপন করা কতটুকু বিনয়ানুগ ছিল ? এ বিষয়টি বিচক্ষণ, চিন্তাশীল, দূরদর্শী সকল পর্যায়ের ব্যক্তিত্বদের বিবেচনার অবকাশ রাখে । অন্যথায় সাংঘিক শৃঙ্খলা রক্ষা করার বিষয়টিসহ ‘বিনয়ো বুদ্ধ সাসনসস’, আয়ু এ কালজয়ী বিধানটি পার্বত্য চট্টগ্রামে অকার্যকর হতে বাধ্য।

যাক। আমাদের স্বঘোষিত ষড়াভিজ্ঞালাভী শ্রাবকবুদ্ধ বনভান্তে মহোদয় ১৯৭৪ খ্রিঃ অব্দের দিকে রাঙ্গামাটিস্থ রাজবন বিহারে স্থায়ীভাবে অবস্থানের লক্ষে চলে আসেন । রাঙ্গামাটিতে স্থায়ীভাবে আসার পর থেকে বনসংঘ সৃষ্টির প্রত্যাশা চরিতার্থ করার সুক্ষ্ম প্রয়াস তাঁর মধ্যে পরিলক্ষিত হয় । পার্বত্য ভিক্ষুসংঘের কাছেও এ বিষয়টি দিবালোকের মতো পরিস্ফুট হয়ে ওঠে । কারণ তখন থেকে শত-সহস্র পুণ্যার্থীর জনসমুদ্রে প্রদত্ত তাঁর ধর্মভাষণে আত্মচর্চার পরিবর্তে পরচর্চা, আত্মদর্শনের পরিবর্তে পরছিদ্রান্বেষণ, পরের দোষ, মিথ্যা, বেনামী কুৎসা বাতাসে শষ্যের ভূষি উড়িয়ে দেয়ার মতো প্রচার করে অপরকে হেয় প্রতিপন্ন করার ঘৃণ্য তৎপরতা সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হতে থাকে । অপরকে দুঃশীলতাদোষে কুপোকাৎ করে নিজেকে এবং তাঁর স্বসৃষ্ট অনুসারী ভিক্ষুসংঘকে তথা বনসংঘকে সুশীল, সংযত, সুদান্ত হিসেবে জনসমক্ষে প্রতিপন্ন করার চাতুর্যপূর্ণ তৎপরতা নিরন্তর চলতে থাকে । এ অপতৎপরতা তাঁর পরলোকগমনের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত অব্যাহত ছিল । অথচ করুণাঘন বুদ্ধের নির্দেশনা ছিল-
“মা’বোচ করুসং কষ্ণি বুত্তা পটিবদেয়্যুতং,
দুক্খাহি সারম্ভকথা পটিদন্তা ফুসেয়্যুতং।”,
[ধম্মপদ- দণ্ডবর্গ।]
অনুবাদ-
কাউকে কর্কশ বা কটুবাক্য বলবে না । যাকে উদ্দেশ্য করে কর্কশ বাক্য বলবে সেও তোমাকে কর্কশ বাক্য বলতে পারে । ক্রোধপূর্ণ বাক্য দুঃখদায়ক । দণ্ডের প্রতিদণ্ডে দণ্ড তোমাকেই স্পর্শ করবে । 
তবে স্মরণযোগ্য সৌভাগ্যের অনুষঙ্গ হল এই- স্বঘোষিত ষড়াভিজ্ঞালাভী শ্রাবকবুদ্ধ বনভান্তে মহোদয়ের নিরন্তর নিরবচ্ছিন্ন নিন্দাবাদ প্রচার পূর্বক জনসমক্ষে চরমভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা সত্বেও পার্বত্য ভিক্ষুসংঘের কোন ভিক্ষু প্রতিনিন্দাবাদে জড়িত হওয়ার কোন তৎপরতা দেখানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি । কিন্তু এ বিষয়টি অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বনভান্তেসহ তাঁর সৃষ্ট বনভিক্ষু সংঘের সাথে পার্বত্য ভিক্ষুসংঘের ভিক্ষুদের একটি সুস্পষ্ট মানসিক দূরত্ব ১৯৭৩ খ্রি: অব্দের পর থেকে সৃষ্টি হয়েছিল । এ মানসিক দূরত্ব ক্রমে প্রগাঢ় হয়েছিল । কোথাও কোথাও মারামারি-হানাহানির ঘৃণ্য আবহ সৃষ্টি হয়েছিল । তবে এটি সর্বৈব সত্য যে, পার্বত্য ভিক্ষুসংঘের ভিক্ষুরা বনভান্তেকে শ্রদ্ধা করেন । তাঁর দ্বারা বর্ষিত কটুক্তি গর্হিত, অন্যায়, অমুলক, অযৌক্তিক, মানহাণিকর, ক্লেশদায়ক হলেও তাঁরা তা মাথা পেতে নিতে দ্বিধা করেন না । কারণ তাঁর নিন্দাবাদের পরিবর্তে প্রতিনিন্দাবাদ প্রচারের কোন নজির পার্বত্য ভিক্ষুসংঘের ইতিহাসে নেই । যদিও তাঁর অনেক স্রোতাপত্তি, সকৃদাগামী, অনাগামী ও অর্হৎ ভিক্ষু, স্থবির-মহাস্থবির শিষ্য পবিত্র রং বস্ত্র ত্যাগ করে হীন, গ্রাম্য, গৃহী জীবনে ফিরে গিয়ে করুণাঘন বুদ্ধ কর্তৃক নিন্দিত, পঞ্চ বাণিজ্যের দ্বারা জীবন জীবিকা নির্বাহ করার প্রয়াস পেয়েছেন । যে পঞ্চ বাণিজ্য পুণ্যবান পুণ্যবতী বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর কাছে করুণাঘন বুদ্ধের জীবদ্দশা থেকে শুরু করে বর্তমান ২৫৫৬ বুদ্ধাব্দ পর্যন্ত সাংঘাতিকভাবে ঘৃণিত, নিন্দিত, অপাংক্তেয় হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে, কোন মার্গ লাভী ভিক্ষু, স্থবির বা মহাস্থবির কি গৃহী জীবনে ফিরে গিয়ে সে পঞ্চ বাণিজ্যের যে কোন একটি অবলম্বন পূর্বক জীবন জীবিকা নির্বাহ করতে পারে ? বনভান্তের ঐসব শিষ্য- যারা মার্গস্থ-ফলস্থ ভেদে অনাগামী ফল পর্যন্ত লাভ করেছেন বলে দাবীকৃত, পুণ্যার্থী জনগণ কর্তৃক মার্গলাভী হিসেবে পূঁজিত, পরে রং বস্ত্র ত্যাগ করে গৃহী জীবনে প্রত্যাবর্তিত এবং যাঁরা শ্রাবকবুদ্ধ, অনুবুদ্ধ ষড়াভিজ্ঞালাভী অর্হৎ ও আর্যপুদ্গলের লেবাস পড়ে অদ্যাবধি বিলাসী জীবন জীবিকা নির্বাহ করে যাচ্ছেন, অন্যদেশ থেকে সুন্দরী মহিলা ফুঁসলিয়ে এদেশে এনে বিবাহ করার কারিশমা দেখাচ্ছেন, পুণ্যার্থী দায়ক-দায়িকাদের শ্রদ্ধাপ্রদত্ত অর্থ সঞ্চয় করে হীন গ্রাম্য গৃহী জীবনে ফিরে গিয়ে তাদেরই কোন এক সুন্দরী সেবাদাসীকে বিয়ে করার ডজন ডজন নজির স্থাপন করে চলেছেন, তাদের ব্যাপারেও পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ কোনদিন আঙ্গুল তুলে কোন কথা বলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি । এ ক্ষেত্রে ও এ প্রসঙ্গে পার্বত্য ভিক্ষুসংঘের সান্তনা হ’ল- মানুষ হিসেবে যার পরিচয় সে দেয়, যে যেরকম কর্ম করে সে সেরকম ফল ভোগ করে, যার যেরকম মনুষ্যত্ববোধ বা পশুত্ববোধ সে সেরকম কর্মের দ্বারা তার অস্তিত্বের স্বাক্ষর রেখে যায় । সর্বোপরি ‘যার পাপ তাকেই পায়’, চিরন্তন এ আপ্ত বাক্যের অনুষঙ্গে বনভান্তের দ্বারা বর্ষিত সমস্ত কটুক্তিকে পার্বত্য ভিক্ষুসংঘ ঐভাবেই অবলোকন করে এসেছিল । কিন্তু দুর্ভাগ্য হল এখানে- কোথাও কোথাও সূর্যতাপের চেয়ে বালুর তাপের আধিক্য পরিলক্ষিত হওয়ার কারণে কোথাও কোথাও ইতরজনোচিত বিবদমান আবহ সৃষ্টি হয়েছিল । মারামারিও সংঘটিত হয়েছিল বলে জানা যায় কোথাও কোথাও । বনভান্তের মতো তাঁর শিষ্য-প্রশিষ্যরাও যদি পার্বত্য ভিক্ষুসংঘের সংঘ সদস্যদের কটুক্তি বর্ষণের মধ্য দিয়ে তাঁদের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধারের অপতৎপরতায় লিপ্ত হন তখনতো সংঘাত আর হানাহানি এবং মারামারির একটি অনিবার্য আবহ সৃষ্টি হতে বাধ্য।

পার্বত্য ভিক্ষুসংঘ তো বটে সংসার ত্যাগী অহিংসার পূজারী ভিক্ষুসংঘের মধ্যে একটি বিবদমান শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ দীর্ঘকাল বিরাজমান থাকুক পুণ্যার্থী জনগণও আন্তরিকভাবে কোন কালেই চান নি । তাই ১৯৮৮ খ্রিঃ অব্দের এক পুণ্যময় দিনে পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ ও বনভান্তে এবং বন ভিক্ষুসংঘের মধ্যে বিরাজমান বিবদমান অবস্থা নিরসনের একটি শুভ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় । রাঙ্গামাটির তখনকার সময়ের বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরাও এ শুভ উদ্যোগের সাথে ঐকান্তিক শ্রদ্ধাসহগত চিত্তে সম্পৃক্ত হওয়ার সদিচ্ছা পোষণ করেন । তারই ধারাবাহিকতায় ২৫ (পঁচিশ) সদস্য/সদস্যা বিশিষ্ট একটি শক্তিশালী মিলনানুষ্ঠান বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা হয়েছিল । যদ্দুর মনে পড়ে ঐ ২৫ সদস্য/সদস্যা বিশিষ্ট শক্তিশালী কমিটিতে তখনকার সময়ের রাঙ্গামাটি পার্বত্য জিলা পরিষদের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত প্রথম মাননীয় চেয়ারম্যান মি: গৌতম দেওয়ান মহোদয় সম্পৃক্ত থেকে বিবাদ নিরসনের লক্ষে অনন্যসাধারণ ভূমিকা রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন । সম্পৃক্ত ছিলেন বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা মি: সুবিমল দেওয়ান মহোদয় । বস্তুত তখনকার সময়ে স্ব স্ব ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত, বিচক্ষণ, দূরদর্শী ব্যক্তিত্ববর্গের সমন্বয়ে ঐ ২৫ সদস্য/সদস্যা বিশিষ্ট কমিটিটি গঠিত হয়েছিল। কমিটির বেশ কয়েকটি বৈঠক রাঙ্গামাটিস্থ তবলছড়ি আনন্দ বিহারের দেশনালয়ে অনুষ্ঠিত হয় । সর্বশেষ বৈঠকে উভয় সংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে মিলনের একটি তারিখ নির্ধারণ করা হয় । উভয় সংঘ মিলনের স্থান নির্ধারিত হয় রাঙ্গামাটিস্থ তবলছড়ি আনন্দ বিহার।

পার্বত্য ভিক্ষুসংঘের পক্ষে আমি প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো এবং শ্রদ্ধেয় ভদন্ত বিমল বংশ মহাস্থবির মহোদয় আহুত প্রতিটি বৈঠকে উপস্থিত ছিলাম । প্রস্তাবিত আনুষ্ঠানিকভাবে মিলনের দিন কিভাবে মিলনানুষ্ঠান করুণাঘন বুদ্ধের ধর্ম-দর্শনানুসারে ধর্মীয় মর্যাদা ও মূল্যবোধকে সমুন্নত রেখে সাধিত হতে পারে সে ব্যাপারে আমরা অভিমত দিয়ে এসেছিলাম । পরিশেষে সর্বসম্মতিক্রমে এ সিদ্ধান্তটি গৃহীত হয় যে, শ্রদ্ধেয় ভদন্ত সাধনানন্দ মহাস্থবির (বনভান্তে) আনন্দ বিহারে প্রস্তাবিত উভয় সংঘ মিলনের স্থলে এসে পৌঁছলে তাঁকে নিয়ে ৩০ (ত্রিশ) জন বিচক্ষণ, প্রাজ্ঞ, বয়োজ্যেষ্ট মহাস্থবির আনন্দবিহারস্থ ভিক্ষু সীমার অভ্যন্তরে গিয়ে পারস্পরিক আপত্তি দেশনার মধ্য দিয়ে উভয় সংঘের মিলনানুষ্ঠান সম্পন্ন করবে । বিগত সময়ের মধ্যে সংঘটিত অনাকাঙ্খিত ঘটনা ও তিক্ততা সম্পর্কে কোন পক্ষই কোন রকম উচ্চবাচ্য করবেন না । এটিই ছিল সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত । উভয় সংঘ মিলনের ব্যাপারে স্বত:স্ফুর্তভাবে পবিত্র অন্ত:করণে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেছিলেন প্রখ্যাত হস্তিদন্ত কারুশিল্পী মি: বিজয় কেতন চাকমা মহোদয় । পার্বত্য ভিক্ষুসংঘের পক্ষে আমি সংঘরাজ নিকায়ের মহামান্য সংঘরাজ সহ ৫ (পাঁচ) জন প্রাজ্ঞ, প্রতিথযশা মহাস্থবিরকে মিলনানুষ্ঠানের দিন সম্মানীত প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে উপস্থিত থাকার জন্য নিমন্ত্রণ করেছিলাম । তাঁরাও মিলনানুষ্ঠানের দিন সাগ্রহে উপস্থিত ছিলেন । মিলনানুষ্ঠানের যাবতীয় কার্যক্রম খুবই সুষ্ঠুভাবে পরিকল্পনা মাফিক অগ্রসর হচ্ছিল । যথারীতি মিলনানুষ্ঠানের পুণ্যপুত দিনে রাঙ্গামাটি জিলা পরিষদের মাননীয় চেয়ারম্যান মি: গৌতম দেওয়ান মহোদয় তাঁর নিজস্ব ব্যবহারের জন্য সদাশয় সরকার প্রদত্ত গাড়ীসহ আরও ৪/৫ টি গাড়ী নিয়ে বনভান্তে সহ তাঁর শিষ্য সংঘকে আনন্দ বিহারের মিলনানুষ্ঠান স্থলে নিয়ে আসার জন্যে রাঙ্গামাটি রাজবন বিহারে চলে গেলেন । তাঁর সঙ্গে সমন্বয়ক মি: বিজয় কেতন চাকমা সহ আরও জনা পঞ্চাশেক লোক সঙ্গী হলেন ।

কিন্তু বড়ই মর্মযাতনার বিষয় হল এই- মিলনানুষ্ঠানের দিন স্বঘোষিত ষড়াভিজ্ঞালাভী শ্রাবকবুদ্ধ বনভান্তে মহোদয় বেঁকে বসলেন । মিলনানুষ্ঠান স্থলে তাঁকে নাকি হেনস্তা করা হবে । তাই তিনি আসবেন না । মিলনানুষ্ঠান আয়োজকদের মাথায় বিনা মেঘে বজ্রপাত হল । তিন লক্ষাধিক টাকা গচ্ছা গেল । উভয় সংঘের সমন্বয়ক মি: বিজয় কেতন চাকমা বনভান্তের সম্মুখে হাঙ্গার স্ট্রাইক 
(Hunger strike) শুরু করলেন । পার্বত্য ভিক্ষু সংঘের যাবতীয় উদ্যোগ ভেস্তে গেল । খবর এসে পৌঁছল-বনভান্তে মহোদয় ‘চুপ’ বলার সাথে সাথে সমন্বয়ক মি: বিজয় কেতন চাকমা মহোদয় নাকি আর কথা বলতে পারছেন না এবং নড়াচড়াও করতে পারছেন না, খানা পিনাও খেতে পারছেন না । ইত্যাদি ইত্যাদি । দীর্ঘ ৭ দিন তিনি সেখানে হাঙ্গার স্ট্রাইক করলেন । সংঘভেদের পাপ পঙ্কিলময় আবহ থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামস্থ সংসার ত্যাগী ভিক্ষুসংঘের মধ্যে একটি মৈত্রীময় পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য মি: বিজয় কেতন চাকমা মহোদয়ের এ বীর্যবন্ত প্রতিবাদ অবিস্মরণীয় ও অভূতপূর্ব । মি: বিজয় কেতন চাকমার এ অনন্যসাধারণ ও অভূতপূর্ব প্রতিবাদকে পার্বত্য ভিক্ষুসংঘের তাবৎ ভিক্ষুসংঘ আন্তরিক শ্রদ্ধাসহগতচিত্তে মূল্যায়ন করলেও স্বঘোষিত ষড়াভিজ্ঞালাভী অর্হৎ শ্রাবকবুদ্ধ বনভান্তে মহোদয়ের বুদ্ধজনোচিত হৃদিসরোবরে কিন্তু বিন্দুমাত্র আলোড়ন তুলতে পারেনি । পার্বত্য ভিক্ষুসংঘের তাবৎ ভিক্ষুসংঘসহ বিচক্ষণ, দূরদর্শী, পূণ্যার্থী দায়ক-দায়িকাদের প্রশ্ন- বনভান্তে ষড়াভিজ্ঞালাভী অর্হৎ শ্রাবকবুদ্ধ হওয়া সত্বেও কেন তিনি সেদিনের হাজারো পুণ্যার্থী দায়ক-দায়িকামন্ডলীর মর্মমূলের হৃদস্পন্দনকে মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হলেন ? তাঁর ষড়াভিজ্ঞার বিচক্ষণতায় কি কোন গলদ ছিল ? তাঁর পরচিত্ত বিজানন জ্ঞান কি সেদিন অবিদ্যায় আচ্ছন্ন ছিল ? অহিংসার পরিবর্তে হিংসার মদমত্ততায় ষড়াভিজ্ঞার অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ পরচিত্ত বিজানন জ্ঞানটি কি সেদিন অকার্যকর হয়ে পড়েছিল?

তাই তো এর পর থেকে স্বঘোষিত ষড়াভিজ্ঞালাভী শ্রাবকবুদ্ধ বনভান্তে মহোদয় দ্বিগুণ উৎসাহে শত-সহস্র, কোথাও কোথাও লক্ষাধিক জনসমুদ্রে পার্বত্য ভিক্ষুসংঘের বাছাই করা বেশ কয়েকজন ভিক্ষু, স্থবির ও মহাস্থবিরের বিরুদ্ধে নানাবিধ কুৎসা রটনা, গালমন্দ, নিন্দাবাদ, দুঃশীলতার অপবাদ থেকে শুরু করে হেন কোন অপবাদ নেই-যা তিনি তাঁর সুমধুর ধর্মভাষণে বলেন নি । পার্বত্য ভিক্ষুসংঘের অন্তর্ভূক্ত ভিক্ষু সংঘের বিরুদ্ধে বনভান্তে মহোদয়ের এ চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধারের মহোৎসব ১৯৭৩ খ্রি: অব্দ হতে শুরু করে তাঁর পরলোক গমনের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে অব্যাহত ছিল বলে তথ্যাভিজ্ঞ মহলের অভিমত।

১৯৭৩ খ্রি: অব্দ হতে ২০১২ খ্রি: অব্দ- এ ঊনচল্লিশ বছরের ব্যাপ্তিকালে বহু সহস্র ক্যাসেটে স্বঘোষিত ষড়াভিজ্ঞালাভী শ্রাবক বুদ্ধ বনভান্তে মহোদয়ের শ্রীমুখ নি:সৃত ধর্মভাষণ সমূহ বাণীবদ্ধ করা হয়েছে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস । যেহেতু ভদন্ত শ্রীমৎ সাধনানন্দ মহাস্থবির (বনভান্তে) একজন ষড়াভিজ্ঞালাভী শ্রাবক বুদ্ধ সেহেতু পুণ্যবান পুণ্যবতী বিচক্ষণ, প্রাজ্ঞ, দূরদর্শী দায়ক-দায়িকাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো ইতোমধ্যে বাণীবদ্ধ শতসহস্র ক্যাসেটসমূহ অনুপুঙ্খ শ্রবণ করে বিবেক প্রসূত নিরপেক্ষতা বজায় রেখে বনভান্তের সারগর্ভ বাণী সংরক্ষণ ও সম্পাদনায় অগ্রসর হবেন । সেখানে হয়তো অবধারিতভাবে বনভান্তের বাণী সমূহের নিরপেক্ষ মূল্যায়ন হবে । গোটা জীবনে শতসহস্র, স্থান বিশেষে লক্ষাধিক জনসমুদ্রে তিনি কি কি প্রসঙ্গে আলোচনার বাতাবরণ সৃষ্টি করে স্বঘোষিত ষড়াভিজ্ঞালাভী অর্হৎ শ্রাবকবুদ্ধের কারিশমা প্রদর্শন করেছেন- তা হয়তো কোন একদিন কোন একজন বিবেকবান প্রাজ্ঞ লোকের দ্বারা নিরপেক্ষভাবে সম্পাদিত ও মূল্যায়িত হবে- এরূপ আশাবাদ ব্যক্ত করি। তবে দুঃখের বিষয় হল এই- ইতোমধ্যে বনভান্তের সারগর্ভ বাণী হিসেবে সম্পাদিত যে ৩/৪ টি পুস্তক বাজারে পাওয়া যাচ্ছে । সেগুলিতে করুণাঘন মানবপুত্র গৌতম বুদ্ধের বাণীগুলিকে বনভান্তের বাণী হিসেবে চালিয়ে দেয়ার অমার্জনীয় ধৃষ্টতা প্রদর্শন করা হয়েছে- যা খুবই গর্হিত, নিন্দনীয় ও ক্ষমার অযোগ্য অপতৎপরতা বিশেষ । এরূপ ক্ষমাহীন অপতৎপরতা অচিরেই বন্ধ হওয়া উচিত বলে মনে করি।

শুধু অবিভক্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম বা বাংলাদেশ নিয়েই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড নয় । এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বিরাট এবং বিশাল। এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বর্তমান লোকসংখ্যা ৬০০ কোটিরও অধিক । বিশাল লোকসংখ্যা অধ্যুষিত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অধিকাংশ লোক করুণাঘন তথাগত বুদ্ধকে জানে এবং চেনে । তাঁর আবিষ্কৃত চর্তুমহাসত্য, আর্যঅষ্টাঙ্গিক মার্গ সম্পর্কে ধারণা রাখে । সাধারণ লোক হিতের জন্য তাঁর প্রদত্ত পঞ্চশীলা নীতি বিশ্বব্যাপী সমাদৃত । তাঁর অহিংসা নীতিকে অনুসরণসহ বাহবা দেয়ার মত লোকের অভাব এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে নেই । আমরা যাঁরা রং বস্ত্র ধারণ করে আবাল্য ব্রহ্মচর্য প্রতিপালন করছি সবাই করুণাঘন বুদ্ধ কর্তৃক আবিষ্কৃত চারি মহা আর্যসত্যের আলোকে আবর্তিত চুরাশি হাজার ধর্ম স্কন্ধকে আত্মস্থকরণ যথাযথ অনুশীলন, অনুসরণ ও চর্বিত চর্বনের মধ্য দিয়েই নিজ নিজ জীবন বিনিমার্ণের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছি । করুণাঘন মানবপুত্র গৌতম বুদ্ধের দীর্ঘ ৪৫ (পয়ঁতাল্লিশ) বছরের ধর্ম ভাষণ গোটা মানব জাতির অমূল্য সম্পদ- যা আদি, অকৃত্রিম পবিত্রতায় এখনো পরিপূর্ণভাবে আমাদের মাঝে বিদ্যমান।

প্রাণী হত্যা করোনা, চুরি করো না, ব্যভিচার করো না, মিথ্যা কথা বলো না, মদ, গাঁজা, অহিফেন তথা মাদক দ্রব্য সেবন করো না- এ পঞ্চশীলা নীতির নির্দেশনা করুণাঘন বুদ্ধেরই নির্দেশনা । এ পাঁচটি নীতি কথা ভদন্ত সাধনানন্দ মহাস্থবিরের মুখ থেকে জনগণের উদ্দেশ্যে নিসৃত হলো বলে- এসব বনভান্তের বাণী হতে যাবে কোন যুক্তিতে ? তিনিই বা কোন ধৃষ্টতায় এসব বুদ্ধবাণীকে তাঁর বাণী হিসেবে প্রচার করতে যাবেন ? করুণাঘন বুদ্ধ পালি ভাষায় এসব বাণী প্রচার করার প্রয়াস পেয়েছেন। শুধু বাংলা ভাষায় বা চাকমা ভাষায় এসব বাণী ভাষান্তর করে যদি জনসাধারণকে বলা হয়, তাহলে কি ঐসব বাণী বক্তার বাণী হিসেবে চালিয়ে দেয়া যায় ? মন-চিত্ত সংযত কর । অপ্রমত্ত আচরণ কর । তৃষ্ণা বন ছিন্ন কর । আর্যসত্য দর্শন কর । ভববন্ধন ছিন্ন কর । অবিদ্যা ধ্বংস কর, দিব্যচক্ষু উৎপন্ন কর । শীল, সমাধি প্রজ্ঞায় অধিষ্ঠিত থাক । বুদ্ধের ধর্ম-দর্শনকে ভেলা হিসেবে গ্রহণ করে সর্ব দুঃখ অন্ত:সাধন কর । এ ভেলাকে কাঁধে করে বয়ে বেড়িও না । এসব করুণাঘন বুদ্ধেরই কালজয়ী উপদেশ । এসব উপদেশ আমার দ্বারা ধর্ম-দেশনাকারে জনগণের উদ্দেশ্যে বর্ষিত হলো বলে কোন যুক্তিতে এসব বক্তার উপদেশ হিসেবে বিধৃত হতে পারে ? অতএব, এ চিরন্তন সত্যটি এখানে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠলো যে- “মানুষের লজ্জা না থাকলেও সে একভাগ পায়।”
[চলবে]
লেখক : সভাপতি, পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ -বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, বনফুল আদিবাসী গ্রীন্ড হার্ট স্কুল এণ্ড কলেজ, মিরপুর, ঢাকা।
(নন্দসার স্মারকে প্রকাশিত, ২৯ নভেম্বর ২০১৩ইং)

3 comments

Anonymous said...

আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য এরুপ ইতিহাস মুলক প্রবন্ধ খুবই দরকার।

তাপস চাকমা said...

আমাদের সমাজে অন্ধভক্তি ও বিশ্বাসের কারণে আজ এরুপ স্বঘোষিত ষড়াভিজ্ঞালাভী শ্রাবকবুদ্ধ আর্বিভূত হচ্ছে হয়েছে।

বিজয় চাকমা said...

যারা অন্ধ ভক্ত তারাই এধরনের প্রবন্ধ প্রকাশের বিরোধীতা করে থাকে। তাই তারা অন্ধ ভক্তের কারণে সত্যকে সত্য বলে না। মিথ্যা ধর্মকে আকরে থাকে।

Theme images by 5ugarless. Powered by Blogger.