গারোরা বাঙালিদের মতো স্বাভাবিক খাবারই খায়। খাসিরা বাবাকে দেবতা মনে করে
পূজা করে। ছেলেরা পরে পকেট ছাড়া জামা ও লুঙ্গি। ম্রোরা সাধারণত বৌদ্ধ
ধর্মাবলম্বী। পুরুষরা সাদা খাটো কাপড় পরে। তাদের অন্যতম সুস্বাদু খাবারের
নাম 'নাপ্পি'। ত্রিপুরাদের ঘর সাধারণত চাকমা ও মারমাদের তুলনায় উঁচু।
ত্রিপুরা শিশুরা 'খিলা' (গিলা) নামের বিচি দিয়ে খেলতে ভালোবাসে। গারো ও
খাসিদের নিজস্ব বর্ণমালা নেই। দেশের ক্ষুদ্র জাতি সম্পর্কে এ ধরনের
বিভ্রান্তিকর তথ্য দেওয়া হয়েছে পঞ্চম শ্রেণীর 'বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়'
বইয়ের ক্ষুদ্র জাতিসত্তা পরিচিতি অংশে। এতে বৃহত্তর ময়মনসিংহের গারো,
সিলেটের খাসি (খাসিয়া), পার্বত্য চট্টগ্রামের ম্রো ও ত্রিপুরাদের সম্পর্কে
দেওয়া হয়েছে বিকৃত তথ্য। বইয়ে দেওয়া প্রাসঙ্গিক হাতে আঁকা ছবিগুলোও ক্ষুদ্র
জাতির সংস্কৃতি এবং তাদের জীবনযাত্রার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। ক্ষুদ্র
জাতির নেতারা বইটি সম্পর্কে তীব্র ক্ষোভ ও আপত্তি জানিয়ে বলেছেন, এ বই
কোমলমতি শিশুদের কাছে দেশের ক্ষুদ্র জাতিগুলোকে হেয়ভাবে উপস্থাপন করবে।
তাঁরা দাবি করেন, প্রত্যেক ক্ষুদ্র জাতির রয়েছে নিজ নিজ ভাষা, সমৃদ্ধ
সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ঐতিহ্য। তাঁরা অবিলম্বে বইটি প্রত্যাহার ও সংশোধন করার
দাবি জানিয়েছেন। এ ছাড়া পাঠ্যপুস্তকে ক্ষুদ্র জাতি সম্পর্কে লেখা যুক্ত
করার আগে সংশ্লিষ্ট গবেষক ও নেতাদের মতামত গ্রহণেরও দাবি জানান তাঁরা।
পঞ্চম শ্রেণীর বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বইটিতে দেখা যায়, গারোদের সম্পর্কে
এক জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে, 'গারোরা আবেং ভাষায় কথা বলে। এই ভাষার কোনো
লিখিত রূপ নেই। তারা ভাতের সঙ্গে মাছ, মাংস, শাকসবজি অর্থাৎ বাঙালিদের মতোই
স্বাভাবিক খাবার খায়।' এ ছাড়া গারোদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ও প্রকৃতি পূজা
'ওয়ানগালা' উৎসবের বর্ণনা দিয়ে এতে ছাপা হয়েছে কদাকার সাজ-পোশাকের
নারী-পুরুষের ছবি। গারো জাতির নেতা ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ
সম্পাদক সঞ্জিব দ্রং বইটি সম্পর্কে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে কালের কণ্ঠকে
বলেন, পুরো বইটিতে গারো জনগোষ্ঠীসহ অপরাপর আদিবাসীদের বিকৃতভাবে উপস্থাপন
করা হয়েছে। এটি বাঙালি শিশুদের মনে আদিবাসী সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি
করবে। সরকারের উচিত হবে এ ধরনের লেখা পাঠ্যপুস্তকে যুক্ত করার আগে লেখাগুলো
সম্পর্কে আদিবাসী বুদ্ধিজীবী ও গবেষকদের মতামত গ্রহণ করা। এতে সহজেই অনেক
বিভ্রান্তি এড়ানো যায়। সঞ্জিব দ্রং আরো বলেন, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন
থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধসহ এ দেশের বহু গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বাঙালিদের
পাশাপাশি আদিবাসীরাও গৌরবময় অবদান রেখেছে। আদিবাসীদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি
অনেক উন্নত ও প্রাচীন। এসব কথাও পাঠ্যপুস্তকে সঠিকভাবে যুক্ত করা দরকার।
তিনি জানান, গারো ও খাসি ক্ষুদ্র জাতির লিখিত বর্ণমালা না থাকলেও বহু বছর
ধরে রোমান হরফে লেখাপড়ার চর্চা চলছে। অথচ এই পাঠ্যপুস্তকে এ বিষয়টি একদমই
এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। বইটিতে দেখা যায়, খাসিদের সম্পর্কে দেওয়া বর্ণনায়
এক জায়গায় বলা হয়েছে, খাসিরা বিভিন্ন দেবতার পূজা করে। তারা বাবাকে দেবতা
মনে করে পূজা করে। খাসিদের প্রধান খাদ্য হলো ভাত, মাংস, শুঁটকি মাছ, মধু
ইত্যাদি। ছেলেরা পকেট ছাড়া জামা ও লুঙ্গি পরে, যার নাম 'ফুংগ মারং'। খাসি
ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা নেই। এ প্রসঙ্গে খাসি ওয়েলফেয়ার সোসাইটির সভাপতি
এন্ড্রু সলেমার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বৃহত্তর সিলেটের ৯৫ শতাংশ খাসি প্রায়
১০০ বছর আগে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেছে। আমাদের ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কৃতির
বেশির ভাগই খ্রিস্টীয় রীতিতে পালন করা হয়।' তিনি আরো বলেন, খাসিদের আদি
ধর্ম ছিল প্রকৃতি বা শক্তির পূজা। আদি ধর্মে কোনো দেব-দেবী নেই। বাবাকে
দেবতা জ্ঞানে পূজা করার প্রশ্নই আসে না। এ ছাড়া খাসিদের প্রধান খাদ্য
তালিকায় মধুও নেই। একসময় ধুতি-জামা খাসি পুরুষদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ছিল।
ওই বইয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের ম্রো ও ত্রিপুরা ক্ষুদ্র জাতি সম্পর্কে বলা
হয়, ম্রো পুরুষরা সাদা খাটো কাপড় পরে। তাদের অন্যতম সুস্বাদু খাবারের নাম
'নাপ্পি'। ত্রিপুরাদের ঘর সাধারণত চাকমা ও মারমাদের তুলনায় উঁচু। তাদের
শিশুরা 'খিলা' (গিলা) নামের বিচি দিয়ে খেলতে ভালোবাসে। বইটিতে এসব বর্ণনার
পাশাপাশি দেওয়া হয়েছে হাতে আঁকা ছবি। এর একটিতে দেখা যায়, নারী-পুরুষ,
শিশুসহ একটি ম্রো পরিবার। পুরুষটির মাথায় রয়েছে সাদা পাগড়ি। পরনে ফুল হাতা
লাল জামার ওপর হাতাকাটা সাদা কোট। এ বিষয়ে ম্রো আদিবাসী নেতা রাংলাই
ম্রো কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ম্রো সাধু ছাড়া পুরুষরা কখনোই সাদা খাটো কাপড় বা
পাগড়ি পরে না। এটি আমাদের সব ম্রোর ঐতিহ্যও নয়। নাপ্পি বা সিঁদোল নামক
শুঁটকি মাছ শুধু এককভাবে ম্রো জনগোষ্ঠী নয়- এটি রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও
বান্দরবান নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রামের ১৩টি আদিবাসী পাহাড়িদেরই
ঐতিহ্যবাদী ও সুস্বাদু খাবার।' জনসংহতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক শক্তিপদ
ত্রিপুরা কালের কণ্ঠকে জানান, পাহাড় ও অরণ্যে ঘেরা পার্বত্য চট্টগ্রামের
বুনো জীবজন্তুর কবল থেকে সুরক্ষিত থাকতে পার্বত্যাঞ্চলের সব ক্ষুদ্র জাতির
জনগোষ্ঠীই মাচার ওপর উঁচু করে ঘর বাঁধে। এটি পাহাড়িদের অতি প্রাচীন ঐতিহ্য।
সাধারণত মাচাং ঘরের উচ্চতা নির্ভর করে প্রয়োজনের ওপর। কিন্তু তাই বলে অন্য
কোনো পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর চেয়ে ত্রিপুরাদের ঘর উঁচু- এমন তথ্য পুরোপুরি
বিভ্রান্তিকর। এ ছাড়া 'খিলা' (গিলা) খেলা শুধু ত্রিপুরা শিশুদের নয়, এটি সব
পাহাড়িরই ঐতিহ্যবাহী খেলা। বর্ষ বিদায় ও বর্ষবরণ উৎসবসহ নানা পালা-পার্বণে
পাহাড়ি নারী-পুরুষ-শিশু সবাই এই খেলাটি খেলে। এসব সমালোচনার বিষয়ে জানতে
চাইলে এনসিটিবির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, শব্দ চয়নের
ক্ষেত্রে ওই বইয়ে সংবিধান অনুসৃত হয়েছে। তিনি বলেন, বইয়ে দেওয়া কোনো তথ্য
বা বর্ণনার বিষয়ে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নেতাদের আপত্তি থাকলে কর্তৃপক্ষ
অভিযোগ খতিয়ে দেখবে। প্রয়োজনে বইটি আবার সংশোধন করা হবে।
No comments
Post a Comment