মানুষের মৃত্যুতে ভিক্ষুসংঘের প্রয়োজনীয়তা
- ড. জিন বোধি ভিক্ষু
অধ্যাপক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
মানব জীবনকে ভিত্তি করে স্বীয় জীবন দর্শন সম্পর্কে অনুসন্ধান ও গবেষণা করলে দু’টো সত্য জানা যায়। প্রথমত: লৌকিক বা ব্যবহারিক জীবন, যদ্বারা আমি, তুমি, সে নামক ধারণার জন্ম হয়। ব্যবহারিক জীবনেই স্বভাবত: কামনা, বাসনা, আমি, আমার, লোভ, দ্বেষ ও মোহ যেমন প্রবল, তেমনি আসক্তি বা তৃঞ্চা সদা সর্বদা আমাকে আপনাকে পেয়ে বসে, বিধায় নানা কুলে জন্ম গ্রহণ করতে হয় পুন: পুন:। তাই জাগতিক ও আত্যান্তিক দু:খ মানুষকে পেতে হয়। আমি নেই, আমার নেই এ ধারণা যখন মানুষের প্রজ্ঞা নেত্রে জাগ্রত হয় তখন অনিত্য, দু:খ ও অনাতœ জ্ঞানের শুভ সূচনা জাগে। সেদিন থেকে সাধারন মানুষ লৌকিক চিন্তা ভাবনা থেকে লোকোত্তর সাধনায় নিমগ্ন হয়। ক্রমে ক্রমে মানুষ মাত্রই আতœ জয়ের পথকে উন্মুক্ত করে । এ সাধনা কঠিন ও দুর্জয় কিন্তু অসাধ্য ও অসম্ভব নয়। তথাগত বুদ্ধ প্রতিদিন প্রতিনিয়ত সকাল সন্ধ্যা প্রতিটি মানুষকে মৃত্যু স্মৃতি ভাবনা বা মৃত্যু চিন্তা করতে আহ্বান জানিয়েছেন। বলা হয়েছে-
আজ মরি কি,
মরি কাল ,
মরণের কি আছে কাল ,
তৈরী থাক সর্বকাল ,
কর স্মৃতি মরণং।
মৃত্যুর মধ্যে কোন জাতি বিচার নেই। হিন্দু, মসলিম, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান এবং অন্যান্য যত সম্প্রদায় বিশ্বে বিদ্যামান সবার এই অবস্থার শিকার হতে হবে। প্রতিটি জাতির ধর্মীয় গুরুরা মৃত্যুর অনুষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে থাকে। বুদ্ধের দৃষ্টিতে মৃত্যু দর্শন হলো আতেœাপলব্ধি ও আতœদর্শনকে বোঝায়। সে জন্য বৌদ্ধদের কাছে মৃত্যু দর্শন পূণ্য। ইদানিং মৃত্যু নিয়ে অনেকের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ধারণা পরিলক্ষিত হয় হচ্ছে। বই-পুস্তকেও এ ব্যাপারে বিভিন্ন লেখা-লেখী হচ্ছে। অথচ তথাগত বুদ্ধ ‘মৃত্যু’ সম্পর্কে বলেছেন যে, সম্যক ধারণা বা শাস্ত্রজ্ঞান তথা প্রকৃত ধর্ম জ্ঞান না থাকার দরুণ সমাজে নানা জল্পনা-কল্পনার দানা বেধেঁছে। প্রকৃত বুদ্ধ জ্ঞানের অভাব বৈকি। রাজ কুমার সিদ্ধার্থ গৌতমের জীবন দর্শনে তৃতীয় নিমিত্ত ছিল মৃতদেহের দৃশ্য অবলোকন। তাঁর জীবনেও একই পরিণতি আসবে জেনে মৃত্যুঞ্জয়ী হওয়ার জন্য সন্ন্যাস ব্রত গ্রহণ পূর্বক সংসার ত্যাগী, বৈরাগ্য ধর্মের অনুসারী হয়ে ভিক্ষুত্ব জীবন যাপন করতঃ সাধনাবশে বুদ্ধ জ্ঞান অর্জন করে বিমুক্তি সুখ অর্জন করেন। তখন জীব জগতের হিতসুখ, আতœজয় ও আতœমুক্তির সুখ লাভের জন্য তাঁর সাধনা লদ্ধ ধর্মবাণী প্রচার করেন। অথচ এখনও সাধারণ মানুষের মৃত্যুর বিষয় নিয়ে নানা বির্তক ও চিন্তা ভাবনা। কারণ জীবনে সব কিছু নিয়ে চিন্তা ভাবনা যত মৃত্যু নিয়ে ভাবনার সময় খুবই কম বিদায় দৈনন্দিন জীবনে দুঃখ ও ভোগ করতে হয় বেশী।বঙ্গীয় বৌদ্ধ সমাজ (সমতল ও পার্বত্যবাসী) মূলতঃ দুটি অংশে বিভক্ত। তৎমধ্যে একটি গৃহী সমাজ এবং অন্যটি ভিক্ষু সমাজ। ভিক্ষু সমাজ সদ্ধর্মে জাগরণ ও মানব কল্যাণে আতেœাৎকৃত প্রাণ। বহুজন হিতায় বহুজন সুখায় বাণীর ধারক ও বাহক। গৃহী সমাজ মাত্র সমাজ উন্নয়ন, সমাজ কল্যাণ এবং সদ্ধর্মের সেবায় আতœনিমগ্ন থাকেন। উভয় সমাজে সম্মিলিত প্রয়াসে সুশীল সমাজ বির্নিমাণ এবং সদ্ধর্মের অগ্রগতি তরান্বিত হয়। গৃহী সমাজ সেবা ও ত্যাগের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে থাকে। আর মহান ভিক্ষুসংঘ সদ্ধর্মের আর্কষণে মুগ্ধ করেন। সংঘই সদ্ধর্মের স্থায়ীত্ব দানে ভূমিকা রাখে। সংঘের বিদ্যমান সদ্ধর্মের প্রচার ও প্রসার অটুট হয়। মহান ভিক্ষুসংঘ আহবানের যোগ্য, দক্ষিণার যোগ্য, পূজার উপযুক্ত পাত্র, অঞ্জলীবদ্ধ হয়ে কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধার প্রদর্শনের উত্তম ক্ষেত্র। যা অন্য কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে সেভাবে দেখা যায় না। অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে আধ্যাতিœক-ধ্যান সমাধি অনুশীলনকারী পূণ্যপুরুষ এবং উচ্চতর জ্ঞানের মনীষীবৃন্দ দেখা গেলেও আমাদের বৌদ্ধ সমাজ গগণে সংসার ত্যাগী গৈরিক, বসনধারী এবং ব্রহ্মচর্য জীবন যাপনকারী বুদ্ধের অসংখ্য শিষ্য মন্ডলীর জীবনার্দশ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং আদর্শ স্থানীয়।
তথাগত বুদ্ধ পরিষ্কার ভাষায় বলেছিলেন- গৃহী সমাজের প্রতিটি সদস্যগণ তাদের সৃজনশীল মেধা ও কর্ম প্রচেষ্ঠার দ্বারা দৈনন্দিন জীবনে ধন-সম্পদ অর্জন করে থাকেন। সেই সঞ্চিত ধন-সম্পদ নিজেদের আরাম আয়াসে ব্যয় করলেও মানসিক সুখ শান্তি ও পারিবারিক মঙ্গলের জন্য মাঝে মধ্যে দান ও গুরু পূজার জন্য প্রদান করে থাকেন। কিন্তু বুদ্ধ সে দান দেওয়ার সময় উপযুক্ত তথা উত্তম পূণ্যক্ষেত্র দেখে প্রদান করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। কারণ কষ্টার্জিত অর্থ যেন অপাত্রে প্রদান করা না হয়। উপযুক্ত পাত্রে দান প্রদান করলে দাতা মাত্রই মানসিক আনন্দ ও সুখানুভূতি লাভ করেন। অন্যথায় দান দেওয়ার পর ক্ষেত্র বিশেষে অনুতাপ, অনুশোচনা ও মানসিক দুঃখ কষ্ঠ ভোগের ভাবতে দেখা যায়। এখনও বলে থাকেন ওনাকে দেওয়াটা ঠিক হয়নি। বুঝতে পারিনি না দেওয়াটাই মঙ্গল ছিল ইত্যাদি নানা বির্তক ও নানা প্রশ্ন নিজেকে বিদ্ধ করে? এটাই বাস্তব সত্য, মানুষ মাত্রই বুদ্ধি দীপ্ত প্রাণী। ভাল-মন্দ, মঙ্গল-অমঙ্গল, কল্যাণ-অকল্যাণ মানুষেরা যেভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন অন্যান্য প্রাণীদের পক্ষে তা সম্ভব নয়। এখানেই মানুষ এবং অন্য প্রাণীদের মধ্যে তফাৎ। মানুষকে প্রকৃত মানুষের মত গড়ে তোলার মধ্যে মানুষের আনন্দ।
তথাগত বুদ্ধ যেমন বাস্তববাদী তেমনী যুক্তিবাদী। আবার তাঁকে (বুদ্ধ) জীবনবাদীও বলা হয়। মানুষের জীবন মাত্রই ক্ষণ স্থায়ী, যাচাই বাঁচাই পূর্বক যাবতীয় কার্যক্রম করাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। বুদ্ধ আরো বলেছেন- প্রাণী মাত্রই কর্মাধীন। অতীত কর্ম বর্তমানে ফল দেয় এবং বর্তমান কর্ম ভবিষ্যতে ফল প্রদান করবে। মানুষের জীবনে প্রতি নিয়ত কর্ম করার জন্য তিনটি দ্বার আছে, যথা -
কায়দ্বার, বাক্যদ্বার ও মনোদ্বার। মানুষ অহরহ এ তিনটা দ্বার দিয়ে ভাল-মন্দ, সুন্দর-অসুন্দর কাজকর্মে লিপ্ত হয়। সে সম্পর্কে সুন্দর শিক্ষা দিয়ে থাকেন বুদ্ধ প্রমূখ মহান ভিক্ষুসংঘ। ভিক্ষুসংঘ জ্ঞানার্জন পূর্বক ও জ্ঞানদাতা হিসেবে নৈতিক দায়-দায়িত্ব পালন করেন। গৃহী সংঘের মধ্যেও অনেকে জ্ঞান দাতার ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। কিন্তু দান গ্রহীতার আসন প্রাপ্ত হতে পারেন না। জ্ঞান দাতা হয়ে যদি ব্রহ্মচর্য জীবন যাপনে অপারগ হয় তাহলে তিনি দান গ্রহীতার পদমর্যাদা লাভ করতে পারেনা বলে দান গ্রহণের উপযুক্ত পাত্র হওয়া যায় না। তার পক্ষে সদ্ধর্মের বাণী দিয়ে আর্শীবাদ প্রদান করার সুযোগ নেই। কিন্তু যে কনিষ্ঠদের আর্শীবাদ এবং বয়ঃ জ্যেষ্ঠদের শ্রদ্ধা প্রদর্শন সর্বস্তরের মানুষের আর্শীবাদ ও মঙ্গল কামনা করার ক্ষমতা রাখেন। অনেক সময় কতিপয় গৃহী যারা নেতৃত্বস্থানীয় আতœ-অহংকার বশতঃ এবং প্রকৃত ধর্মজ্ঞানের অভাবে জনসমাজে অনেক সময়, মত প্রকাশ করে সবক্ষেত্রে ভিক্ষু সংঘের উপস্থিতি না হলেও চলে। প্রয়োজনে আমরাও অনেক ধর্মীয় কার্যাদি সম্পাদন করতে পারি অসুবিধা নেই। বিশেষতঃ কোন জ্ঞাতি-আতœীয়-স্বজন প্রতিবেশী বন্ধু পরিজন কালগত তথা মৃত্যুবরণ করলে এ জাতীয় কথা বার্তা বলতে শুনা যায় যে- এ মৃত্যু আসরে ভিক্ষু সংঘ না আসলে অসুবিধা নেই। কিন্তু ভিক্ষু সংঘ যে সব মন্ত্র উচ্চারণ করবেন, আমি বা আমরা উক্ত মন্ত্রগুলি উচ্চারণ এবং বলতে পারি। মৃত ব্যক্তির বাড়ীতে বা শ্বশ্মানে ভিক্ষু সংঘ আহবান না করলেই কোন অসুবিধা নেই। আমি তো আছি, আমি সেই মন্ত্র বলে দিলেই হবে। এমন এমন জায়গা আছে সেখানে ভিক্ষুসংঘ আনা-নেওয়া একবারে অসম্ভব। সে ক্ষেত্রে উপস্থিত সমস্যা সমাধানের জন্য হয়ত সাময়িকভাবে তা করা যায়। কিন্তু সবক্ষেত্রে তা করা সমীচিন নয়। তাহলে একদিকে ধর্মের প্রতি অগৌরব হয়, অন্যদিকে মহান ভিক্ষুসংঘের প্রতি অমর্যাদাকর বলে মনে হয়। পরবর্তীকালে সাপ্তাহিক ধর্মীয় অনষ্ঠান সংঘদান এবং অষ্টপরিস্কার দান কি গৃহী সংঘের মাধ্যমে করা যায় কি? তখন কিন্তু মহান ভিক্ষু সংঘের দরকার। বুদ্ধের শিক্ষায় অনুত্তর পূণ্য ক্ষেত্র হল- মহান ভিক্ষু সংঘ। নচেৎ সাধারণ দায়ক-দায়িকাগণ কোন মতেই তা মেনে নেবেন না। বরং অশান্তির কারণ হয়ে দাড়াঁয়। এটা যদি আমরা বুঝে থাকি তাহলে ধর্ম নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করার সুযোগ নেই। ধর্ম মানে স্ব-স্ব দায়িত্ব কর্তব্য পালনের নিষ্ঠাবান হওয়া। ব্যক্তির যথেষ্ট দায়িত্ব রয়েছে, পরিবার, সমাজ, দেশ, জাতির প্রতিও নানা দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে। স্ব-স্ব অবস্থানে থেকে যথা দায়িত্ব কর্তব্য পালনে যদি আন্তরিক হয় তাহলে কোন ক্ষেত্রে সমস্যা থাকবে বলে মনে হয় না। এখানেই সহাবস্থান, মহামিলন, সম্পীতি ও সৌর্হাদবোধ আরো সুদৃঢ় হবে। যখন একজন নবজাতকের জন্ম হয় তখন আমরা আনন্দিত হই, তেমন মৃত্যুতেও দুঃখ করার কিছু থাকে না বরং আনন্দ চেতনা নিয়ে পূণ্য প্রদান করার সৌভাগ্য লাভ হয়। তাও কিন্তু মহান ভিক্ষু সংঘের উপস্থিতিতে সহজতর হয়। বর্তমান নিবন্ধে মৃত বা মরা বাড়ীতে বা শেষকৃত্যানুষ্ঠানে ভিক্ষুসংঘের উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা কতটুকু এ আলোচনা এখানে প্রাধান্য পেয়েছে। জন্ম ও মৃত্যু মানব জীবনের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু নামক অবস্থানটি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। একটি জীব সত্বের জন্ম না হলে মৃত্যু নামক শব্দের উচ্চারণ হয় না। জন্ম হলে মৃত্যু সময় সাপেক্ষ, অবশ্যম্ভাবী এবং চিরন্তন শ্মাশ্বত সত্য। মৃত্যু নামে শিউরে ওঠে মনপ্রাণ। সবাই মৃত্যুকে ভয় করে। কিন্তু মৃত্যুর হাত থেকে কেউ রেহাই পায় না। সজহ কথায় বলতে গেলে জন্ম হয় বলে জীবকে দুঃখভার বহন করতে হয়। তাই বুদ্ধের ধর্ম দর্শনে কার্যকারণ শৃঙ্খলায় বলা হয়েছে- জন্মের কারণে জ্বরা-ব্যাধি ও মৃত্যু ইত্যাদি। তাই তো বলা হয়েছে- মরণম্পি চ দুক্খং অথার্ৎ মৃত্যুই দুঃখ।
প্রাণীগণের মৃত্যু হয় চারটি কারণে যথাঃ ১.আয়ু ক্ষয়ে মৃত্যু ২.কর্ম ক্ষয়ে মৃত্যু ৩.আয়ু কর্ম উভয় ক্ষয়ে মৃত্যু এবং ৪. উপঘাতক কর্মের দ্বারা মৃত্যু। স্বয়ং তথাগত বুদ্ধ বলেছিলেন, আমার আয়ুসংস্কার শেষ বা পরিপূর্ণ হয়েছে, আমি এখন পরিনির্বাণ লাভ করবো। তখন তাঁর নিষ্কাম কর্মের পরিপূর্ণতা হয়েছে এবং সকায় কর্মকে জয় করেছেন বলে কর্মক্ষয় করার প্রভাব তৈয়ারী হয়েছিল। এ ভব সংসার থেকে মুক্তির জন্য যে কর্ম সম্পাদন করা এবং পূণ্য সঞ্চয় করা প্রয়োজন তা পরিপূর্ণ হয়েছে বিধায় তাঁর পরিনির্বাণ লাভ হয়েছে। কিন্তু বুদ্ধগণের জীবনে উপঘাতক কর্মের ফল নেই। কারণ বুদ্ধগণ আতœজয়ী বিমুক্ত মহামানব। তাঁরা স্ব-ইচ্ছাকৃত মৃত্যুবরণ করেন বলে তাঁরা মৃত্যুঞ্জয়ী মৃত্যু। লৌকিক জগতে জীবের মৃত্যু মূলতঃ মৃত্যু নয় প্রতিসন্ধি বরা হয়। অর্থাৎ এক জন্ম থেকে অন্য আরেকটি জন্ম লাভ করা। প্রকৃত মৃত্যু হল- যিনি মৃত্যু কে জয় করেছেন । ভব সংসারে আর তাঁর পূনঃ জন্ম হবে না। এক কথায় মৃত্যুঞ্জয়ী হওয়া। স্বভাবত উপঘাতক মৃত্যু হল- নানা অঘটন অর্থাৎ জলে মৃত্যু, দুঃঘটনায় মৃত্যু, গুলি বিদ্ধ হয়ে মৃত্যু, এবং গলায় দঁড়ি দিয়ে মৃত্যু ইত্যাদি উপঘাতক মৃত্যু নামে অভিহিত। এ উপঘাতক মৃত্যু মাত্র প্রেতাতœা নামে পরিচিত। তাদের প্রেতাতœা জীবন থেকে মুক্ত করতে হলে পবিত্র বুদ্ধগয়াতে গিয়ে রাজকুমার সিদ্ধার্থ গৌতমের বুদ্ধত্ব জ্ঞান প্রাপ্তির স্থান বুদ্ধগয়ার পবিত্র বোধি বৃক্ষমূলে বুদ্ধ প্রমুখ মহান ভিক্ষু সংঘকে উপস্থিত করিয়ে সংঘদানাদি পূন্যকর্ম সম্পাদন অবশ্যই করতে হবে। বুদ্ধ তাঁর ভিক্ষুসংঘদের নিয়ে মহারাজ বিম্বিসারের ষাটহাজার প্রেতাতœা জ্ঞাতিদেরকে পূণ্যদানের মাধ্যমে প্রেতাতœা জীবন থেকে মুক্ত করেছিলেন বলে ত্রিপিটকে উল্লেখ আছে। তখন থেকে কোন জ্ঞাতি স্বজন মারা গেলে তাঁদের উদ্দেশ্য সংঘদান ও অষ্ঠপরিষ্কারসহ বিভিন্ন দানীয়বস্তু পবিত্র ভিক্ষু সংঘকে দেওয়া হয়ে থাকে। তাই মৃত্যু ব্যক্তির শেষকৃত্যানুষ্ঠানে দায়কগণ প্রিয়জন আতœীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব হিসেবে অসংখ্য জনের উপস্থিতিতে অনিত্য গাথা পাঠের মাধ্যমে প্রয়াত ব্যক্তির পারলোকিক সুখ-শান্তি এবং পুণ্যদানের সুন্দর ব্যবস্থা করা হয়। সেই সময় গৃহীরা সম্মিলিতভাবে প্রয়াত ব্যক্তির মঙ্গল ও শান্তির কামনার ভিক্ষুদের সংঘদানসহ পূণ্য অনুমোদনে তা দান করা হয়। গুরুগণ একদিকে পূন্য পুরুষ অন্য দিকে কল্যাণ মিত্র এবং মঙ্গলকামী। পুণ্যদান ও শান্তিকামী হিসেবে উত্তম ক্ষেত্র। সুতরাং পুণ্য পুরুষ উপস্থিত না হলে প্রয়াত ব্যক্তিকে ভিত্তি করে দান কাকে দেওয়া হবে এবং কাকে ভিত্তি পূণ্যদান অনুমোদন করা হবে। দাতা গ্রহীতা পার্থক্য এখানে পরিষ্কার যে মহান ভিক্ষু সংঘ ব্যতীরেকে প্রয়াতের কল্যাণ ও মঙ্গল কামনা অসম্ভব। তজ্জন্য মৃতদেহকে সামনে রেখে মরণানুস্মৃতি ভাবনা করা এবং উপস্থিত ভিক্ষু সংঘ কর্তৃক মঙ্গলবাণী সহ অনিত্য গাথা পাঠ শুনানোর জন্য ভিক্ষুর প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। এ প্রসঙ্গে তথাগত বুদ্ধ পরিষ্কার ভাষায় উচ্চারণ করেছেন- জগতে বুদ্ধ এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংঘের উৎপত্তি না হলে পরলোকগত জ্ঞাতির পারলৌকিক সুখ-শান্তি বিধান করা যায় না। বুদ্ধ আরো বলেছেন- প্রয়াত ব্যক্তিকে ভিত্তি করে জ্ঞাতি পূজা করাই উত্তম মঙ্গল। তথাগত বুদ্ধের উৎপত্তি থেকে থেরবাদী বৌদ্ধ বিশ্বে প্রয়াত ব্যক্তিকে উপলক্ষে মহান ভিক্ষু সংঘের উপস্থিতিতে সংঘদান ও অষ্টপরিষ্কারসহ অন্যান্য মহাদানের আয়োজন হয়ে থাকে। তখন প্রয়াতের আতœীয়-স্বজন-বন্ধু-বান্ধব এবং প্রতিবেশীুুদেরকেও আমন্ত্রণ জানানো এবং ভোজন দান করা হয়। সবদিকে বিবেচনা করলে পূজনীয় ভিক্ষু সংঘের প্রয়োজনীয়তা সমধিক গুরুত্বপূর্ণ।
সংঘই বুদ্ধ শাসনের রক্ষাকবচ তুল্য। সংঘ ব্যতীত শাসন সর্দ্ধমের অগ্রগতি অসম্ভব । সমাজ ও জাতি সুন্দর ও মঙ্গলময় হয় না। বিশ্বময় বুদ্ধবাণী প্রচার ও প্রসারের ভিক্ষু-সংঘের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশী। সবার মধ্যে সাংঘিক চেতনার জাগরণ ঘটুক এটাই সময়ের দাবী।
No comments
Post a Comment