স্বপ্নপুরি সিইপিজেড
- ড. অমর কান্তি চাকমা
হিল চাদিগাং বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ পরম পূজ্য সাধনা জ্যোতি স্থবির মহোদয় চট্টগ্রাম শহরে ফ্রি-পোর্ট এলাকায় অবস্থানরত চাকমাদের সমাজিক, ধর্মীয় অবস্থা এবং হিল চাদিগাং বৌদ্ধ বিহার সম্পর্কে কিছু লেখতে আমাকে অনুরোধ করেন। আমি কোন লেখক নই, এ বিষয়ে কিছু লেখা আসলে একটা কঠিন কাজ তথাপি শ্রদ্ধেয় ভান্তের অনুরোধ উপেক্ষা করতে না পেরে দুয়েক কলম লেখার অবতারনা। আমি ভারতে পড়াশুনা শেষ করে ২০০৯ সালে মার্চ মাসে স্বদেশে ফিরে আসি, তখন থেকে ২০১০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত অধ্যক্ষ মহোদয়ের বদান্যতায় হিল চাদিগাং বৌদ্ধ বিহারে অবস্থান করার সৌভাগ্য হয়েছিল। এ এক বছরে ফ্রি-পোর্ট এলাকায় অবস্থানরত চাকমাদের জীবন যাত্রা অতি কাছে থেকে পর্যবেক্ষন করার সুযোগ হয়েছে। আমার দৃষ্টিতে যা উপলদ্ধি করেছি তা তুলে ধরার ক্ষুদ্র প্রয়াস চালিয়েছি মাত্র। এখানে কাউকে ছোট বড় করার জন্য নয়।
বন্দর নগরী চট্টগ্রাম শহর বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম শিল্প এলাকা। বিশেষ করে সিইপিজেড (ঈযরঃঃধমড়হম ঊীঢ়ড়ৎঃ চৎড়পবংংরহম তড়হব) এলাকায় দেশী-বিদেশী বহুবিধ শিল্প কারখানা গড়ে উঠায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বেকার যুবক-যুবতীদের কর্ম সংস্থান তথা জীবন-জীবিকার আশ্রয়ের ঠিকানা হয়েছে। এ এলাকাটি ফ্রি-পোর্ট হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত। এখানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ এ শিল্প কারখানা গুলোতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এ শ্রমজীবি মেহনতি মানুষের সমাগম ঘটে দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে। এ যেন এক বিভিন্ন জাতি গোত্রের মহান মিলন মেলা। তাঁদের পদচারণায় এ এলাকাটি বিশাল ব্যস্ততম জায়গাতে পরিণত হয়েছে। অনেকে এ শ্রমিকদেরকে কোম্পানি চাকুরী জীবি হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং অন্য দৃষ্টিতে দেখেন। অন্য দৃষ্টিতে দেখলে কি হবে আসলে দেশের অর্থনীতি উন্নয়নে তাঁদের বিরাট অবদান রয়েছে। বিশেষতঃ তাঁদের শ্রমের উপর ভিত্তি করে দেশী-বিদেশী শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা যেমন লাভবান হচ্ছেন তেমনি সরকারও প্রচুর দেশীয় এবং বৈশিক মুদ্রা অজর্ন করছেন। কাজেই তাঁদের এ পেশাকে একেবারে ছোট করে দেখার কোন জো নেই।
বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান এ তিন পার্বত্য জেলায় বসবাসরত আদিবাসী অনেক বেকার যুবক-যুবতী কর্ম সংস্থানের খুঁজে ছুটে আসেন চট্টগ্রাম শহরের অভিমুখে। তাঁরা প্রত্যকেই এক বুক আশা আকাঙ্খা নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে চলে আসেন ভবিষ্যত জীবনের স্বপ্ন পূরণ করতে। চট্টগ্রাম শহরে বর্তমানে প্রায় অর্ধ লক্ষ আদিবাসী বিভিন্ন চাকুরীতে কর্মরত আছেন। এদের মধ্যে সরকারী, আধা সরকারী চাকুরী জীবিদের ব্যতিত প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার (৩৫,০০০) হাজার আদিবাসী সিইপিজেড এলাকার বিভিন্ন শিল্প কারখানায় কর্মরত আছেন। বাকীরা শহরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান করেন।
প্রতিটি মা-বাবা চায় তাঁদের ছেলে-মেয়েরা শিক্ষা-দীক্ষা সমুন্নত হয়ে ভাল একটা চাকুরী নিয়ে অথবা ব্যবসা বানিজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে বংশ প্রদীপ এবং সমাজের মর্যাদা রক্ষা করবে। যে সকল ছেলে-মেয়েরা সেই লক্ষ্য অর্জন করতে ব্যর্থ হয়, তখন তাঁদেরকে পরিবার এবং সমাজের বোঝা মনে করা হয়। শুধু তাই নয় প্রতিটি পদে পদে তাঁদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়। কিন্তু তাঁদের সেই সুপ্ত শক্তি, ঘুমন্ত প্রতিভা একটু সুযোগ পেলেই যে, সমাজ ও জাতির জন্য অনেক অবদান রাখতে পারে সেই কথা কেউ চিন্তা করে না। সে রকম চাকমা যুব সমাজের বিরাট একটা অংশ নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের প্রত্যাশায় ফ্রি-পোর্ট এলাকায় বিভিন্ন শিল্প কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কর্মে নিয়োজিত আছেন। তাঁরা অনেকে অকালে শিক্ষা জীবনের অবসান ঘটিয়ে, আবার অনেকে কলেজ পর্যায়ের শিক্ষা সমাপ্ত করে বেকারত্ব অভিশাপ থেকেমুক্তি লাভের আশায়, সুন্দর সুখী জীবন গড়ার লক্ষ্যে এবং মা বাবার মুখে হাসি ফুটানোর জন্য মহান স্বপ্ন নিয়ে এখানে কাজ করতে আসেন। প্রত্যকের বেলায় স্বপ্নের সেই সোনার হরিণ পুরোপুরিভাবে হস্তগত না হলেও তাঁরা পরিবার এবং সমাজের জন্য অনেক অবদান রেখে যাচ্ছেন। বিরতীহীন ভাবে কঠিন পরিশ্রমের বিনিময়ে উপার্জিত অর্থ দিয়ে তাঁরা নিজেদের মৌলিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি পরিবার ভরণ, পোষণ, সামাজিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব কর্তব্য প্রতিপালন করছেন। অতি কষ্ট করে হলেও তাঁরা অনেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শিক্ষা-দীক্ষায় সমুন্নত করে দেশের একজন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্ট করে যাচ্ছেন। তাঁরা ফ্রি-পোর্ট এলাকায় অবস্থান করার সুবাদে তাঁদের ছেলে-মেয়েরা বাংলাদেশের বানিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন স্কুল কলেজে পড়াশুনা করার সুযোগ পাচ্ছে। এ ছেলে-মেয়েরা হয়তবা এক দিন সমাজের আলোকিত মানুষ হয়ে দেশ ও জাতিকে গৌরবান্বিত করবেন। যেটা পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থান করলে কখনো সম্ভব হতো না। সেদিক থেকে তাদের উপার্জিত অর্থের একাংশ দেশ, সমাজ ও জাতি গঠনের উদ্দেশ্যে ব্যয় হচ্ছে। অপর দিকে বুদ্ধ শাসন সদ্ধর্মের কল্যাণে তাঁদের ভূমিকা কোন অংশে কম নয়। কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান কিংবা বিহার নিমার্ণের জন্য যে সমস্ত ব্যক্তি বা সংগঠন শ্রদ্ধাদান নিতে তাঁদের কাছে যান তাঁরা স্বতঃস্ফুর্তভাবে সামর্থ্যানুসারে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেন। তাঁদের ত্যাগ চেতনা প্রত্যকের প্রজ্ঞা সম্প্রযুক্ত না হলেও তাঁরা সরল বিশ্বাসে পুণ্য লাভের আশায় দান দিয়ে থাকেন। তাঁদের সম্মিলিত ত্যাগের মহিমায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁরা অনেক উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছেন।
বর্তমান চট্টগ্রাম শহরে চাকমাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত চারটি বৌদ্ধ বিহার রয়েছে । যথাক্রমে -
১. বিশ্ব মৈত্রী বৌদ্ধ বিহার
২. বড়গাং বৌদ্ধ বিহার
৩. হিল চাদিগাং বৌদ্ধ বিহার
৪. চট্টগ্রাম মৈত্রী বনবিহার
সরকারী চাকুরীজীবি বিভিন্ন পদে কর্মরত, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের মধ্যে কিছু সদ্ধর্ম হিতৈষী, ধর্মপরায়ন ব্যক্তিদের মহৎ উদ্যোগে চট্টগ্রাম শহরের প্রাণ কেন্দ্র আগ্রাবাদ আবাসিক এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে ১৯৮৯ সালে ‘বিশ্ব মৈত্রী বৌদ্ধ বিহারটি’ প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁদের এ মহৎ কর্মকে স্বাগত জানিয়ে তখনকার চট্টগ্রাম শহরে অবস্থানরত চাকমারা সামর্থ্য অনুসারে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এটি হলো চট্টগ্রাম শহরে চাকমাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত প্রথম বৌদ্ধ বিহার। চট্টগ্রাম শহরের অভ্যন্তরে অনেক বৌদ্ধ বিহার থাকা সত্ত্বেও তাঁরা নিজেদের স্বকীয়তা অনুসারে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান উদ্যাপনের জন্য এ বিহার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এ বিশ্ব মৈত্রী বৌদ্ধ বিহারকে কেন্দ্র করে বড়গাং বৌদ্ধ বিহারের জন্ম। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯১ সালে। কর্ণফুলী নদীর পূর্ব পাড়ে প্রাকৃতিক নৈসর্গিক সৌন্দর্য মন্ডিত পরিবেশে বড়গাং বৌদ্ধ বিহারের অবস্থান। দীর্ঘ দিন মামলা চলার পর বড়গাং বৌদ্ধ বিহারের জায়গার মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে বলে শুনেছি। এখন এ বিহারকে কেন্দ্র করে বহুবিধ কল্যাণ মূলক কর্মকান্ড হাতে নেয়ার সুযোগ এসেছে। আশা করি বিহার পরিচালনা কমিটি এ বিষয়ে উপযুক্ত সময়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
যুগের প্রয়োজনে, মানুষের চাহিদা অনুসারে নতুন এক স্বপ্ন ও আদর্শ নিয়ে “হিল চাদিগাং বৌদ্ধ বিহার” প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৮ সালে ফ্রি-পোর্ট এলাকার সল্টগোলা ক্রসিং-এ আম্বিয়া ভবনের সপ্তম তলা ভাড়া বাসায়। বিহারটি প্রতিষ্ঠার সুচনালগ্নে ঘোর বিরোধীতা করে তৎকালিন বরগাং বৌদ্ধ পরিষদ (বিহার পরিচালনা কমিটি)। সে সময় নানান প্রচার পত্র বিলি করে বিহারাধ্যক্ষ ও পরিচালনা কমিটিকে হেয় প্রতিপন্ন করে বক্তব্য প্রদান করে। সেই বরগাং বৌদ্ধ বিহার কমিটি কাকঁড়াই বাচ্চা দেওয়ার মতো বিহারেকে ফেলে রেখে বর্তমানে তারাই আবার মৈত্রী বন বিহারের পরিচালনা কমিটির অর্ত্তাকর্তা। প্রিয় পাঠক এবার ভেবে দেখুন কোন হীন স্বার্থ চারিতার্থ করার জন্য তাদের এ বিরোধীতা। এ বিহারটি প্রতিষ্ঠার পেছনে যাঁদের অবদান সর্বাগ্রে, তাঁরা হলেন- ভদন্ত রতœ প্রিয় থের (বি,এ অনার্স, এম,এ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়), ভদন্ত সাধনা জ্যোতি থের ( বি,এ অনার্স, এম,এ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, এম, এড দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়), ভদন্ত নন্দ প্রিয় থের (এইচ,এস,সি. ডি,এইচ,এম,এইচ. ঢাকা), ভদন্ত বিদর্শন ভিক্ষু (বি,এ অর্নাস এম,এ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়) এবং চট্টগ্রাম শহরে অবস্থানরত সদ্ধর্মপ্রাণ দায়ক দায়িকাদের অকুণ্ঠ সাহায্য সহযোগিতায়। এ বিহারটি কয়েকটা মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।
১. ফ্রি-পোর্ট এলাকার চাকমা সমাজকে বৌদ্ধিক আদর্শে এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে জাগ্রত করা।
২. ভাবনা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা।
৩. অনাথালয়, বিদ্যালয় ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করা।
৪. যে সকল ভিক্ষু শ্রামণেরা চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে চাই তাঁদের আবাসিক সুবন্দোবস্ত করা।
এ মহান উদ্দেশ্যকে বাস্তবে রুপদান করতে হলে বিহারের জন্য নিজস্ব জমি প্রয়োজন। এ তাগিদ অনুভব করে প্রথমে বিহার পরিচালনা কমিটি জমি ক্রয়ের জন্য পদক্ষেপ নেয়। কিন্তু হিসাব নিকাশ করে দেখা গেল চট্টগ্রাম শহরে যে পরিমাণ জায়গার মূল্য, তাতে জমি ক্রয় করে বিহার নির্মাণ করা দরিদ্র চাকমা সমাজের সামর্থ্যরে বাহিরে। অতঃপর সরকারীভাবে জায়গা পাওয়া যায় কিনা শুরু হলো একটার একটা নতুন অভিযান। এ অনুষঙ্গে প্রথমে চট্টগ্রাম সিটি মেয়রের কাছে জায়গার জন্য দরখাস্ত দেয়া হয়। এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মাননীয় সিটি মেয়র আশ্বস্ত করে বলেন-“ কোথাও খাস জায়গা খুঁজে পাওয়া গেলে বৌদ্ধ বিহার নির্মাণের জন্য প্রদান করা হবে।” এরই ধারাবাহিকতায় ৪ এপ্রিল ২০০৯ হিল চাদিগাং বৌদ্ধ বিহার পরিচালনা পরিষদের এক প্রতিনিধি দল আবেদনপত্র সহ চট্টগ্রাম ১০নং আসনের মাননীয় সাংসদ জনাব এম, এ লতিফের সাথে দেখা করেন। জন দরদী মাননীয় সাংসদ মহোদয় প্রতিনিধি দলকে প্রতিশ্র“টি দেন যে, যে কোন উপায়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিহার নির্মাণের জন্য তিনি জায়গা ব্যবস্থা করে দেবেন। ওই দিন তিনি প্রতিনিধি দলকে অনুরোধ করে বলেন-“ আগামী মে দিবস (২০০৯ সাল) উপলক্ষে সিইপিজেড মোড়ে শ্রমিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে, অনুগ্রহপূর্বক আপনাদের সম্প্রদায়ের লোকেরা যেন সকলে ওই সমাবেশে অংশ গ্রহণ করে, সেই সমাবেশেই কোথায় জায়গা দেয়া হবে ঘোষণা করবো।” তাঁর এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে হিল চাদিগাং বৌদ্ধ বিহার পরিচালনা পরিষদের সকল সদস্য-সদস্যা ফ্রি-পোর্ট এলাকায় অবস্থানরত চাকমাদেরকে সমাবেশে অংশ গ্রহণ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। তাঁদের অনুপ্রেরণায় কয়েক হাজার চাকমা বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে বিরাট আনন্দ মিশিল সহকারে উক্ত সমাবেশে অংশ গ্রহণ করেন।
কিন্তু অপর দিকে একটা গ্র“প এ সমাবেশকে বর্জন করেন। তাঁদের যুক্তি হলো- “ জনাব লতিফ সাহেব কোথায় থেকে জায়গা দেবেন? সমাবেশে বেশী লোক জমায়েত না করার জন্য তাদের এ ফন্দি। চলুন আমরা রাঙ্গামাটি রাজবন বিহারে গিয়ে সংঘদান করে পুণ্যার্জন করি।” স্বাভাবিকভাবে বনবিহারের কথা বললে সকলের মন শ্রদ্ধায় নমিত হয়। সেদিন বিরোধী গ্র“পটি ১৫টি বাস ভর্তি করে চলে গেলেন বন বিহারে। বন বিহার আমাদের জন্য তীর্থ স্থান। সমগ্র বৌদ্ধ সমাজে ধর্ম জাগরনের ক্ষেত্রে এ বিহারের অবদান অতুলনীয়। কিন্তু কারণে অকারণে যত্রতত্র এ পবিত্র তীর্থ স্থানের নাম দিয়ে মানুষের দুর্বলতার সুযোগে অন্যভাবে কাজে লাগানো আদৌ কি যুক্তি সংগত?
এদিকে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে আয়োজিত বিশাল শ্রম দিবস সম্মেলনে বৌদ্ধ বিহার নির্মাণের জন্য জায়গা প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করে বক্তব্য রাখেন হিল চাদিগাং বৌদ্ধ বিহারের সহসভাপতি মি. প্রীতিময় চাকমা। বিশাল জন সমুদ্রের উদ্দেশ্যে মাননীয় সাংসদ জনাব এম,এ লতিফ মহোদয় যখন বক্তব্য দিতে উঠেন তখন সমাবেশে অংশ গ্রহণকারী চাকমারা অধীর আগ্রহে প্রহর গুনছেন কখন বৌদ্ধ বিহারের জায়গাটি ঘোষণা করবেন। মাননীয় সাংসদ মহোদয় যখন সিইপিজেড গেইট সংলগ্ন খালি জায়গাটি বৌদ্ধ বিহার নির্মাণের জন্য প্রদান করা হলো, এ ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত চাকমারা মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে তাঁকে ধন্যবাদ জানান।
মাননীয় সাংসদ জনাব এম, এ লতিফ মহোদয় কর্তৃক প্রদত্ত জায়গাটির উপর যখন হিল চাদিগাং বৌদ্ধ বিহার স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য কার্যক্রম শুরু হয় তখন কাকতালীয়ভাবে চাকমা সমাজের একশ্রেণী স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবি গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। এদের একটা বড়গুণ হলো- “তাঁরা সদা সর্বদায় নিজেদেরকে সর্বেসর্বা এবং সব জান্তা হিসেবে সমাজের কাছে জাহির করা এবং উচ্চতর বেতন স্কেলে সম্মানজনক চাকুরী করেন এ নিয়েও তাঁদের অহংকারের শেষ নেই।”
তথাকথিত এ বুদ্ধিজীবিরা তাঁেদর উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য ফ্রি-পোর্টে এলাকায় অবস্থানরত চাকমা সমাজকে সুুুুুুুপরিকল্পিতভাবে দু’ভাগে বিভক্ত করে দেন। এ বিভাজন এমন চরম আকার ধারণ করে দুই গ্র“পের মধ্যে যে কোন সময় অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যেতে পারে এ রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। এক গ্র“প বলে এখানে হিল চাদিগাং বৌদ্ধ বিহার হবে, আর অন্য গ্র“পটি বলে হিল চাদিগাং নয়, বিশ্ব মৈত্রী অথবা বড়গাং বৌদ্ধ বিহার হবে। এ নিয়ে যখন চরম টান টান উত্তেজনা মুহূর্ত তখন তাঁরা ঝোপ বুঝে কোপ মারেন। তাঁরা সর্প হয়ে দংশন করেন, আর ওজা বা বৈদ্য হয়ে ঝাড় ফু করেন। দুই পক্ষকে এ বলে সাস্তনা দেন- “আরে বাবা, তোমরা একটু ধৈর্য ধর। আমরা সুন্দর একটা সমাধান দিচ্ছি। সমাধানটা হলো এই- হিল চাদিগাং, বিশ্ব মৈত্রী অথবা বড়গাং বৌদ্ধ বিহার যদি ওই জায়গায় হস্তান্তর করা হয় তা’হলে রক্তয়ী সংঘর্ষ হওয়ার সম্ভাবনা। কাজেই এ সব বাদ দিয়ে চলুন আমরা সবাই মিলেমিশে এখানে একটা বন বিহার শাখা প্রতিষ্ঠা করি।” পূর্বেই উল্লেখ করেছি বন বিহার বললে................। আমরা হলাম সবাই হুজুগি......
এ সুযোগে মহান সাধক, সর্বজন পূজ্য, পরম শ্রদ্ধেয় সাধনানন্দ মহাথের’র (বনভন্তে) একজন বিশিষ্ট শিষ্য বিশুদ্ধানন্দ ভিক্ষুকে সাথে নিয়ে তথাকথিত বুদ্ধিজীবিরা নানা তালবাহানা করে ওই ভূমির উপর ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন “চট্টগ্রাম মৈত্রী বনবিহার” অর্থাৎ বন বিহার শাখা। অথচ সেই ভিক্ষু একদিন বিহারাধ্যক্ষকে ফোন করে বলে তোমার মত ভাগ্যবান কেউ নেই তুমি এমপি সাহেবের নিকট থেকে বিহারের জন্য জায়গা বের করতে পেরেছ। সেই বিশুদ্ধানন্দ কি করে অপরের পাওয়া জায়গায় বেহায়ার মতো বিহার প্রতিষ্ঠা করলো? বিহার ভিত্তি প্রতিষ্ঠার দিন তাঁরা নিজেদেরকে জোড় গলায় উপস্থাপন করলেন তাঁদের নিরবচ্ছিন্ন তদবির না হলে এ জায়গাটি পাওয়া কখনো সম্ভব হতো না। কি চমৎকার ? ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টা। সাংসদ সাহেবেরও উচিত ছিল যারা দরখাস্ত করেছে তদবির করেছে তাদেকে জায়গাটা বুঝিয়ে দেওয়া। এ শ্রেণীর ব্যক্তিরা স্ব-উদ্যেগী হয়ে কিছু করেন না। অপরদিকে কারোর দ্বারা সৃষ্ট, সম্পাদিত মহৎ কর্মকে স্বীকৃতি দেয়া, মূল্যায়ন করা তো দূরের কথা, উল্টো অন্যের গড়া কৃতিত্ব নিয়ে কিভাবে নিজেরা নিবেদিত প্রাণ, সমাজ সেবক, সদ্ধর্মের একনিষ্ঠ দরদী হিসেবে খ্যাতি লাভ করবেন সেই তৎপরতায় লিপ্ত থাকেন। এ হলো আমাদের চাক্মা সমাজের তথাকথিত বুদ্ধিজীবিদের স্বভাব। এভাবেই অর্ধ মৃত্যু হলো উপরোক্ত তরুণ উদয়ীমান উচ্চ শিক্ষিত ভিক্ষু এবং ধর্মপ্রাণ দায়ক দায়িকাদের একটি স্বপ্ন ও আদর্শ ।
যে নামে বা যাঁরা বৌদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠা করা হোক না কেন, বিহার মানে বৌদ্ধদের পবিত্র স্থান তথা জাতীয় প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রাম মৈত্রী বৌদ্ধ বিহারের জায়গাটি আমাদের জাতীয় সম্পদ। এটাকে রক্ষা করার জন্য যেই বিষয়টি এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটা হচ্ছে জায়গাটি সরকারের কাছ থেকে রেজিষ্ট্রিশন করে নেয়া। ভবিষ্যতে যেন কোন প্রকার ভোগান্তি না হয়। অন্ততঃ এ কাজটা যদি করতে পারেন তাহলে ঊনারা প্রকৃত বুদ্ধিজীবি হিসেবে গণ্য হবেন।
চট্টগ্রাম শহরে অবস্থিত উপরোক্ত চারটি বৌদ্ধ বিহার মূলতঃ বিভিন্ন শিল্প কারখানায় কর্মরত চাকরীজীবিদের সিংহভাগ দানের উপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়। এ সমস্ত চাকুরীজীবি দায়ক-দায়িকারা বিহারে অবস্থানরত অনুত্তর পুণ্যক্ষেত্র ভিক্ষু সংঘকে সাধ্যমত চতুর্প্রত্যয় দান করে অবিরত সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এর পাশাপাশি তাঁরা বৌদ্ধদের পবিত্র পার্বনাদি যেমন- বুদ্ধ পূর্ণিমা, আষাঢ়ী পূর্ণিমা, মধু পূর্ণিমা, প্রবারণা পূর্ণিমা, মাঘী পূর্ণিমা ইত্যাদি ধর্মীয় তিথিগুলো যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপন করে থাকেন। এছাড়াও সংঘদান, অষ্টপরিস্কার দান ও কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠানে বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক জ্ঞানী, গুণী ও পন্ডিত ভিক্ষু সংঘ নিয়ে এসে বিরাট বিরাট পুণ্যানুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এ ধর্মীয় অনুষ্ঠান গুলোতে চট্টগ্রাম শহরে অবস্থানরত চাকমা সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও অংশ গ্রহণ করেন। এতে বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠানের প্রভূত উন্নতি হয়েছে বটে, কিন্তু আচার আচারণে কারোর তেমন একটা নৈতিক পরিবর্তন দেখা যায় না। প্রাজ্ঞ ভিক্ষু সংঘরা এত কষ্ট করে এসে যে মূল্যবান ধর্ম দেশনা করেন তার শতভাগ না হোক অন্তত তার অর্ধেকও যদি প্রতিপালন করতেন তাহলে সমাজে অনেক মঙ্গল সাধিত হতো।
ফ্রি-পোর্ট এলাকায় অবস্থানরত চাকমা সমাজের জীবন যাত্রা এদিকে যেমন আনন্দের অপরদিকে তেমনি খুবই বেদনা দায়ক। তাঁরা চাকমা সমাজের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং মূল¯্রােত ধারা থেকে বিছিন্ন হয়ে যাচ্ছেন। মা বাবা, আত্মীয় স্বজনকে তোয়াক্কা না করে গোপনে বিবাহ করা, বিবাহ বিচ্ছেদ, পরকিয়া ইত্যাদি অহরহ করা হচ্ছে। এ সমস্ত ঘটনা চাকমা সমাজের মধ্যে এক সময় কল্পনাও করা যেত না। এ অপসংস্কৃতি গুলো এখানে হরদম ঘটছে। এছাড়াও বিশেষ করে মা বোনেরা হঠাৎ করে গ্রাম অঞ্চল থেকে শহরে এসে তাঁরা অনেকে রঙ্গীন রঙ্গীন স্বপ্নে দিশেহারা হয়ে যান। সেই রঙ্গীন স্বপ্নে বিভোর হয়ে মা-বাবা, আত্মীয়-স¦জন, বন্ধু-বান্ধব এবং স্বজাতির কথা তাঁদের খেয়ালই থাকেনা। সেই স্বপ্ন পূরনের লক্ষ্যে সমস্ত কিছু বিসর্জন দিয়ে পা বাড়াচ্ছেন অন্য এক জগতে। এটা শুধু তাঁদের বেলায় নয়, অনেকে উচ্চ শিক্ষা লাভ করেও এ পথে ধাবিত হচ্ছেন। যাঁরা এ পথে ধাবিত হচ্ছেন, আদৌ কি তাঁদের সেই স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে ? স্বপ্ন পূরণ হওয়ার তো দূরের কথা, তাঁদের পরিণতির কাহিনী শুনলে গা শিখরে উঠে। কাজেই মাতৃ জাতিরা এ বিষয়ে সচেতন হওয়া একান্তই দরকার।
মাতৃ জাতিরা অন্ধকার জগতে ধাবিত হওয়ার কয়েকটা কারণও আছে। যেমন- ১. কেউ অবচেতন ভাবে ২. কেউ প্রতারণার স্বীকার হয়ে ৩. কেউ উচ্চ অভিলাসের কারণে ৪. কেউ অবহেলিত হয়ে
এ অন্ধকার জগত থেকে মাতৃ জাতিকে আলোর পথে নিয়ে আসার একমাত্র উপায় হলো- তরুণ প্রজন্ম এবং অভিভাবকদের সচেতন হওয়া। উপরোক্ত কারণ গুলো যেন কারো জীবনে সংঘটিত না হয় সেই বিষয়ে সচেষ্ট থাকা। যুব সমাজ জাতির কর্ণধার। মানব জাতির এ যাবত যত প্রকার উন্নতি এবং মহৎ কাজ সম্পাদিত হয়েছে তার অধিকাংশ কৃতিত্বের দাবীদার সচেতন যুব সমাজের। সচেতন যুব সমাজই পারে সভ্য-সুশীল সমাজ ব্যবস্থা এবং সুন্দর রাষ্ট্র উপহার দিতে, রক্ষা করতে পারে বিপথগামী মাতৃ জাতিকে। কিন্তু যুব সমাজ কি পারছে তাঁদের এ দায়িত্ব পালন করতে? যাঁরা হয়ত এ বিষয় নিয়ে ভাবেন এবং কিছু একটা করার উদ্যোগ নেন কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় অন্যান্যদের কাছ থেকে তেমন একটা সাড়া পান না, একারণে তাঁরাও নিরুৎসাহিত হয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। যাঁরা এ সমাজের কল্যাণমূলক কাজে অগ্রসর হতে চান তাঁদেরকে অবশ্যই প্রত্যেকের সহযোগিতা দেয়া উচিত। বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের একাংশ প্রকৃত আর্দশ থেকে বিচ্যুত এবং নীতি ভ্রষ্ট হয়ে মাদকাসক্তি, জুয়া, মিথ্যা যৌনাচারে লিপ্ত। যুব সমাজের চারিত্রিক এ অধঃপতনের মূল কারণ হচ্ছে মানবীয় গুণাবলীর অভাব। তরুণেরা যদি ধর্মীয় অনুভূতিতেজাগ্রত হয়ে, মানবীয় গুণাবলীর শক্তিতে বলিয়ান হয়ে সামনে দিকে অগ্রসর হন, তাহলে চাকমা সমাজের এ অপসংস্কৃতির কালো মেঘ অপসারিত হয়ে সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। অভিভাবক হিসেবে মা-বাবারও ছেলে-মেয়েদের প্রতিও অনেক দায়িত্ব কর্তব্য আছে। এর মধ্যে মা-বাবার প্রধান দায়িত্ব হলো- ছেলে-মেয়েদেরকে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহনের জন্য অনুপ্রানিত করা, উপযুক্ত সময়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করা, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্য সম্পত্তির সমভাবে বন্টন করা এবং সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। ভাল চাকুরি বা ভাল বেতনে মোহিত না হয়ে দায়িত্ববান হয়ে ছেলে-মেয়েরা কি ধরনে চাকুরী করে তা খোঁজ খবর রাখা। এক্ষেত্রে মাতা-পিতাকেও অবশ্যই দায়িত্ববান, ধার্মিক, আদর্শবান এবং মানবীয় গুণে গুণান্বিত হতে হবে। এভাবে তরুণ প্রজন্ম এবং অভিভাবকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নতুন কিছু একটা আশা করা যায়। তা না হলে এ সমাজের দুরাবস্থা কোথায় গিয়ে ঠেকে থাকে সময়ই বলে দিতে পারবে।
No comments
Post a Comment