বৌদ্ধ দর্শনে সংযম
সাধনাজ্যোতি ভিক্ষু
বি,এ (অনার্স) এম, এ. এম, এড.
বৌদ্ধ দর্শনে কায়-মন-বাক্য সংযমকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সে কারণে ধর্মপদ গ্রন্থে ভিক্ষুবর্গে বরা হয়েছে-
কায়েন সংবরো সাধু, সাধু বাচায় সংবরো,
মনসা সংবরো সাধু, সাধু সব্বত্থ সংবরো
সব্বত্থু সংবতো ভিক্খূ সব্ব দুক্খ পমুচ্চতি ॥
অর্থাৎ - কায়-মন-বাক্য এ সকল বিষয়ে সংযত থাকা শুভকর। যে ভিক্ষু এই অষ্ট বিষয়ে সর্বত্র সংযত থাকতে পারেন তিনি সর্ব প্রকার ক্লেশ হতে বিমুক্ত হন।
চক্ষুদ্বারে জ্হানরুপ দর্শন করে মনোজ্ঞ বিষয়বস্তু রুপে আসক্ত হওয়া ইচত নয়। অমনোজ্ঞরুপ দর্শন করেও তৎপ্রতি বিদ্বেষ চিত্ত উপন্ন করা অনুচিত। যদি তৎদৃষ্টরুপের প্রতি আসক্তি উৎপন্ন না করে স্মৃতি সহকারে তা নিরীক্ষিণ করা হয় তাহলে মোহ উৎপন্ন হয় না। এরুপে চক্সুদ্বারে সংযম আসে, এত চক্ষুদ্বার আবদ্ধ ও সুরক্ষিত হয়। ঠিক এরুপ ভাবে শ্রোত দ্বারে শব্দ, ঘ্রাণ দ্বারে গন্ধ এবং জিহ্বা দ্বারে রস উৎপন্ন হলে সংবরণ করা উচিত। চক্ষ,ু শ্রোত্র, ঘ্রাণ, জিহ্বা দ্বার অসংযত হলে অকুশল বীথিতে অশ্রদ্ধা, অধৈর্য্য, হীন, বীর্যভাব, ভূল, ভ্রান্তি উৎপন্ন হয়। চক্ষু, শ্রোত্র ইত্যাদি সংযম হলে অকুশল বীথিতে শ্রদ্ধ, ক্ষান্তি, বীর্য, স্মৃতি ও জ্ঞান উৎপন্ন হয়ে থাকে।
কায় সংযম ঃ এখানে কায় বলতে শরীলকে বুঝায়। বৌদ্ধ দর্শনে মতে, রুপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান এ পঞ্চস্কন্ধ দ্বারা গঠিত। চার্বাক মতে ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ এই চারি মহাভূতের জীব দেহ সৃষ্টি। এদের কোনটিতে চৈতন্য না থাকলেও এদের সংমিশ্রনে জীবদেহ সৃষ্টি হয়। যেমন পান, সুপারি ও চুন এদর কোনটিতে রাল আভা দেখা যায় না। কিন্তু এদের চর্বনের ফলে একটি লাল আভা দেখা যায়। তদ্রুপ চারিমহাভূতের কোনটিতে চৈতন্য না থাকলে এদের সংমিশ্রণে জীবদেহ সৃষ্টি হয়। প্রাণী, হত্যা ও ব্যভিচার না করলে কায় সংযম হয়ে থাকে বা এ তিনটি কারণ হতে বিরত থাকলে কায় সংযম হয়। নিম্নে এদের সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা গেল ঃ
১) প্রাণীহত্যা ঃ যে কোন হীন, মধ্যম, উৎকৃষ্ট, ছোট বড়, অনু-পরমানু দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান, হিংস্র-অহিংস্র, উৎপন্ন-অনুৎপন্ন যা হবে এবং প্রাণী হত্যার কারণও হবে না। প্রত্যেক প্রাণীর প্রতি দয়াবান, হিত ও অনুকম্পাকারী হবে। কোন প্রাণীকে দন্ডাঘাত ও অস্ত্রঘাতে নির্যাতিত করবেন না। প্রাণী হত্যা হতে বিরত নর নারিগণ জন্মে- জন্মান্তরে খর্বতা, বিকলাঙ্গতা ইত্যাদি দোষ বর্জিত হয়ে পরিপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও দীঘায়ু লাভী হন। তারা বীর পরাক্রম বেগবান, সুপ্রতিষ্টি পদ বিশিষ্ট হন। দেহ সুন্দর, কোমল পবিত্র ও মহাশাক্তিশালী হয়। বাক্যালাপ কর্ণসুখকর ও জড়তাশূন্য হয়। তাদের পরিষদবর্গকে কেহ বিভেদ করতে পারে না তারা নির্ভীক ও রক্ষক হন। পরের আঘাত জনিত অপমৃত্যু তাদের হয় না। তারা জন বহুল পরিবার সম্পন্ন হন। দেহরুপ-লাবণ্যময়, সৃশ্রী, সুলক্ষণ ও সেীষ্ঠবময় হয়। চিরসুস্থ, শোকহীন ও বিচ্ছেদ, বেদনাহীন হয়ে সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাত্রা নির্বাহ করেন। মৃত্যুর পর আনন্দময় স্বর্গ প্রাপ্তি হয়।
২) চুরি বা চৌর্য কর্ম ঃ অপরের স্থাবর- অস্থাবর যে কোনও বস্তু এমনকি সামান্য সুত্রনাল পর্যন্ত ও চৌর্য্য চিত্তে গ্রহন করবে না। অপরকেও তজ্জন্য উৎসাহিত করবে না। পরের ক্ষতি কামনাও অন্তরে পোষণ করবে না। চুরি হতে বিরত নর-নারীগণ জন্মে জন্মে ধন-দান্য ও মনোজ্ঞ ভোগ সম্পদ লাভ করে থাকেন। লদ্ধ ভোগ সম্পদ চিরকাল নিখুঁত স্থায়ী হয়। অভীস্পিতবস্তু অনায়াসেই লাভ কনে। তাদের সম্পত্তি রাজা, চোর, ডাকাত, অগ্নি, জল, যক্ষ ও শত্রু কর্তৃক কিছুতে নষ্ট হয় না। মনুষ্যদের মধ্যে তারা শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেন। ‘নেই’ শব্দ কখনও তাদের শ্রুতিগোচর হয় না। এই সৎপুরুষগণ অতীব সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাত্রা নির্বাহ করে মৃত্যুর পর দিব্য আনন্দময় স্বর্গে জন্মধারণ করেন।
৩) ব্যভিচার বা মিথ্যকামাচার ঃ যথাকালে পুরুষ স্বীয় স্ত্রী বা নারীঘন স্বীয় স্বামী ব্যতীত অপর কোন মানব, তির্যক ও প্রেত জাতীয় স্ত্রী-পুরুষের সাথে কাম পরিভোগ করবে না। এমকি অপরকেও তজ্জন্য উৎসাহিত করবে না। মিথ্যাকামাচার হতে বিরত নর-নারীগণ শত্রুহীন হয়। দেব নরের প্রিয় হন। উৎকৃষ্ট খাদ্য-ভোজ্য, অন্ন-পানীয়, মনোজ্ঞ পোশাক-পরিচ্ছদ ও শস্যাদি প্রচুর পরিমাণে লাভ হয়। সুখে নিদ্রা যায়, সুখে জাগ্রত হন, চতুবির্ধ অপায়ে জন্ম গ্রহন করেন না। পুরুষগণ স্ত্রীত্ব বা নপুংসকত্ব আর নারীগণ নপুংসকত্বও বন্ধ্যত্ব হতে মুক্ত হন। সতী-সাধ্বী রমনীগণ ক্রমান্বেয়ে পুরুষত্ব প্রাপ্ত হন। তাদের ক্রোধও শত্রুহীনবল হয়। তারা প্রত্যক্ষ দর্শী হন। সভাসমিতিতে নির্ভীক ও নিঃসংকোচ চিত্তে গমন ও উপবেশন করেন। কাম মিথ্যাচার বিরত স্ত্রী পুরুষের মধ্যে পরস্পরের প্রিয়ভাব বর্দ্ধিত হয়। ইন্দ্রিয় লক্ষণ সমূহ পরিপূর্ন হয়, শঙ্কা ও কৌতুহল শূন্য হয়, ভয় ও প্রিয় বিচ্ছেদ দুঃখ বিহীন হয়ে সুখে কালযাপন করেন। মৃত্যুর পর স্বর্গে উৎপন্ন হন।
মন বা চিত্ত সংযম ঃ মনকে সংযত রাখতে পারলে মনের দুষ্ক্রিয়া, অবিদ্যা, ব্যাপাদ ও মিথ্যাদৃষ্টি ত্যাগ সাধন করে। মানসিক বৃত্তি অর্থাৎ বেদনা, সংজ্হা এবং সংস্কার এই ত্রিবিধ অরুপ ধর্ম স্কন্ধের পূর্বে মন উৎপন্ন হয়। মন উক্ত ধর্মসমুহের সঙ্গে একই বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে একই সময়ে উৎপন্ন হয়, হলেও স্ব স্ব কার্যকারণ সম্বন্ধ দ্বারা মনের পূর্ব গামিতা সুচিত হয়। উদাহরণ স্বরুপ বলা যেতে পারে যেমন গ্রাম লুন্ঠনে বহুলোক একসঙ্গে কাজ করলেও প্রদান পরিচালকের নির্দ্দেশে সমস্তকাজ সম্পন হয় তদ্রুপ মনও বৃত্তিনিচয়ের পরিচালকরুপে সব সময় পূর্বে গমন করে। মন ব্যতিত চিত্তবৃত্তি উৎপন্ন হতে পারেনা। কোন কোন চৈতসিক বা চিত্ত বৃত্তি ব্যতিত মন স্বয়ং উৎপন্ন হতে পারে। দৃস্যদল দলপতির আজ্হাধীন হয়, সেরুপ মানসিক বুত্তি নিচয় ও মনের উপর নির্ভশীল সে জন্য মনশ্রেষ্ঠ। কাষ্ঠ নির্মিত দ্রব্য কাষ্ঠময় নামে অভিহিত হয়। সেরুপ মনে উৎপন্ন বিষয়বস্তুকেও মনোময় বরা হয়।
স্বভাবতঃ মন নির্মল, আলোকময় ও অমিশ্র। স্বচ্ছজল যেমন বিভিন্নবর্ণের সংমিশ্রণে বিভিন্নরুপ প্রাপ্ত হয়, সেরুপ নির্মল মনও ভিন্ন ভিন্ন পাপ চেতনা সংযোগে ভিন্ন ভিন্ন নামে প্রকট হয়। সুতরাং বাহ্যিক উপসর্গের দ্বারা মলিন চিত্ত নতুনও নহে এবং র্পর্বতন স্বাভাবিক আলোময় চিত্ত নয়। মে জন্য লোভ, দেষ, মোহের প্রবাবে প্রাণী হত্যা, দ্বেষ, মোহ ও লোভ, মোহ চুরি এবং লোভে-মোহে ব্যভিচার এতিনটি অকুশল কায়কর্মে সম্পাদন করে মন কলুষিত হয়। দ্বেষ-মোহ, লোভ=মোহে পিশুন বাক্য, দ্বেষ ও মোহে কর্কম কথা এবং দ্বেষ মোহ ও লোভ-মোহে বৃথাবাক্রে এচারটি অকুশল বাককর্ম করে মন দুষত হয়। মোহে অবিদ্যা. দ্ষে-মোহে হিংসা এবং লোভ-মোহে মিথ্যাদৃষ্টি এতিনটি অকুশল মনোকর্ম করেমন কলুষিত হয়। এরুপে এপ্রকার পাপ পথ বাড়তে থাকে। অজ্ঞমানব লোখ, দ্বেষ, মোহ চিত্তবুত্তির কবলে পড়ে নিজেরা মনকে কলুষিত করে এবং সর্বদা অসীম দুৎখ বোগ করে।
সেজন্য তথাগত বুদ্ধ প্রত্যক্ষ অনুভ’তির জন্য উপমার দ্বারা বর্ণণা করতেছেন যে বরদেব পদানুসারী শকটচক্রের ঘুর্ণণতুল্য নিজের কৃতকর্ম ও জীবকে অনুসরণ করে। যুগবদ্ধ বলদ সপ্তাহ মাস কিংবা বৎসর চললেও চক্রকে ঘুর্ণণ হতে প্রতি নিবৃত্তি করতে পারে না। সেরুপ মন দুষিত করে জীব, কায় ও বাক এই দুইপথে সর্বদা দুষ্কার্যে লিপ্ত থাকে। পরিনামে সে জন্মান্তরে তির্ষক, প্রেত, অসুর, নরকগামী, হয়ে কল্প কল্পান্তর ধরে অসীম দুঃখ ভোগ করে। একানে বেদনা, সংজ্ঞা ও সংস্কারকে সমষ্টিগত ভাবে ধর্মনামে অভিহিত করা হয়েছে। এগুলো বিজ্ঞান বা মনের রুপান্তর। সুতরাং মানসিক বুত্তি সমূহ মনের অধীনে মনের দ্বারা পরিচালিত এবং মন এদের উৎপত্তির একমাত্র উৎস।
বাক্য সংযম ঃ লোভ-দ্বেষ-মোহে পিশুন বাক্য, দেষ-মোহে কর্কশকথা, এবং লোভ-দ্বেষ-মোহে সম্প্রলাপ বাক্য, লোভ-দ্বেষ-মোহে মিথ্যা কথা বলা থেকে বিরত থাকা।
১. মিথ্য বাক্য ভাষণ এমনকি হাস্যচ্ছলেও মিথ্যা, কটু, বুথা, ভেদ ও পিমুন বাক্য ভাষণ করবেন না। মিত্যা ভাষণে বিরত নরনারীদের জন্ম-জন্মান্তরে ইন্দ্রিয় সমূহ সুসম্পন্ন হয়, মনোহারী, মধুর ও অর্নগল বাক্য ভাষী হন, দন্তরাজী সমান, সুশ্রী. শুভ্র ও বিশুদ্ধ হয়। তাদের দেহ নাতিদীর্ঘ, নাতিহ্রস্ব, নাতিকৃশ, নাতিস্তুল, মদ্যমকার, সুখসম্পর্শ ও কমনীয় হয়। মুখ হতে সর্বদা পদ্ম গন্ধ নিঃসৃত হয়। পরিজনবর্গ প্রাণপনে তাদের সেবা শুশ্রুষা ও আদেশ পালন করে। দাতের জিহ্বা পদ্মদলের ন্যায় কোমল, রক্তিমবণ ও পাতলা হয়। তারা ঔদ্ধত্য ও চঞ্চলতা বর্জ্জিত হয় এবং মৃত্যুর পর স্বর্গ লাভ করেন।
২. পিশুন বাক্য বিরত দুইজন বন্ধুর মধ্যে পরস্পর ভেদমূলক কথা না বলা।
৩. কর্কশ বাক্য বিরত অপর জাতকে ভেদ করে কথা না বলা। জ্ঞাতি, কুল, সংস্থিতি অর্থাৎ কাণা ও বোবা বংশ ইত্যাদি তুচ্ছ কথা ও হীন কম্মাদি বলে কর্ম নিন্দা এরুপ কর্কশ কথা না বলা।
৪. সম্প্রলাপ বাক্য বিরত, চিন্তা পূর্বক লেখা, রামায়ণ, মহাভারত, উপন্যাস, নাটক, প্রহসনাদি গল্প, কথা দ্বারা সম্যক জ্ঞান লাভ হয় না। সেরুপ অজ্ঞানতা বিষয়ক কথা না বলা। রামায়ণ ও মহাভারত দীর্ঘ গল্প বটে কিন্তু ইহা বিনয় বিষয়ক নয়। বিশেষত হাস্য, রসাদি ভাব প্রকাশ কথাতে পূর্ণ। এতে কেবল দীঘায়ু, ধন, সম্পদ ও পরলোকে স্বর্গ সম্পত্তি প্রাপ্ত হবার কথা আছে। বিনয় অনুরুপ কথা বললে মনুষ্য স্বভাবত মাতা-পিতার বন্ধন, মানন, পুজন ও পাদ ধৌত করণ ইত্যাদি দ্বারা সেবা শুশ্রুষা করা এবং যথাকালে বসন, ভূষণ ইত্যাদি প্রদান ও মিষ্ট বাক্য দ্বারা শীলাদি রক্ষা করা। তাদের উপকার সাধন, স্ত্রীপুত্রেরও ধর্মত উপকার করা এবং নিকেও সুশীল হওয়া। সেরুপ অর্থ ধর্ম বিনয় লাভের জন্য উল্লেখিত তির্য়ক কথা না বলে পরিমিত শীল, সমাধি ও বির্দশন ভাবনা ইত্যাদি অর্থ ধর্ম বিনয় বিষয়ক কথা বলা উচিত।
পরিশেয়ে বলা যায় যে, কায়িক দুষ্কর্ম হতে বিরত থেকে কায়িক সংযমকারী হবেন। প্রাণী হত্যা, চুরি, ব্যভিচার পরিত্যাগ করে কায়িক কুশল সাধন করবে বাক্যে সংযত তাকবে, বাক্যের র্দুব্যবহার, মিথ্যাবাক্য, পিশুনবাক্য, সম্প্রলাপ বাক্য পরিত্যাগ পূর্বক বাচনিক কুশল কার্য সাধন করবে। মনের ক্রোধ নিবারণ করবে, মনকে সংযত রাখলে মনের দুষ্ক্রিয়া, ক্রোধ, অবিধ্যা, ব্যাপাদ ও মিথ্যাদৃষ্টি ত্যাগ করে সৎকর্ম সাধন করবে। যে সকণ ধীর ব্যক্তি কায়ে সংযত, বাক্যে সংযত এবং মনে সংযত সে ধীর ব্যক্তিগণ যথার্থ সুসংযত।
সাধু---------সাধু-------সাধু
বি,এ (অনার্স) এম, এ. এম, এড.
বৌদ্ধ দর্শনে কায়-মন-বাক্য সংযমকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সে কারণে ধর্মপদ গ্রন্থে ভিক্ষুবর্গে বরা হয়েছে-
কায়েন সংবরো সাধু, সাধু বাচায় সংবরো,
মনসা সংবরো সাধু, সাধু সব্বত্থ সংবরো
সব্বত্থু সংবতো ভিক্খূ সব্ব দুক্খ পমুচ্চতি ॥
অর্থাৎ - কায়-মন-বাক্য এ সকল বিষয়ে সংযত থাকা শুভকর। যে ভিক্ষু এই অষ্ট বিষয়ে সর্বত্র সংযত থাকতে পারেন তিনি সর্ব প্রকার ক্লেশ হতে বিমুক্ত হন।
চক্ষুদ্বারে জ্হানরুপ দর্শন করে মনোজ্ঞ বিষয়বস্তু রুপে আসক্ত হওয়া ইচত নয়। অমনোজ্ঞরুপ দর্শন করেও তৎপ্রতি বিদ্বেষ চিত্ত উপন্ন করা অনুচিত। যদি তৎদৃষ্টরুপের প্রতি আসক্তি উৎপন্ন না করে স্মৃতি সহকারে তা নিরীক্ষিণ করা হয় তাহলে মোহ উৎপন্ন হয় না। এরুপে চক্সুদ্বারে সংযম আসে, এত চক্ষুদ্বার আবদ্ধ ও সুরক্ষিত হয়। ঠিক এরুপ ভাবে শ্রোত দ্বারে শব্দ, ঘ্রাণ দ্বারে গন্ধ এবং জিহ্বা দ্বারে রস উৎপন্ন হলে সংবরণ করা উচিত। চক্ষ,ু শ্রোত্র, ঘ্রাণ, জিহ্বা দ্বার অসংযত হলে অকুশল বীথিতে অশ্রদ্ধা, অধৈর্য্য, হীন, বীর্যভাব, ভূল, ভ্রান্তি উৎপন্ন হয়। চক্ষু, শ্রোত্র ইত্যাদি সংযম হলে অকুশল বীথিতে শ্রদ্ধ, ক্ষান্তি, বীর্য, স্মৃতি ও জ্ঞান উৎপন্ন হয়ে থাকে।
কায় সংযম ঃ এখানে কায় বলতে শরীলকে বুঝায়। বৌদ্ধ দর্শনে মতে, রুপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান এ পঞ্চস্কন্ধ দ্বারা গঠিত। চার্বাক মতে ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ এই চারি মহাভূতের জীব দেহ সৃষ্টি। এদের কোনটিতে চৈতন্য না থাকলেও এদের সংমিশ্রনে জীবদেহ সৃষ্টি হয়। যেমন পান, সুপারি ও চুন এদর কোনটিতে রাল আভা দেখা যায় না। কিন্তু এদের চর্বনের ফলে একটি লাল আভা দেখা যায়। তদ্রুপ চারিমহাভূতের কোনটিতে চৈতন্য না থাকলে এদের সংমিশ্রণে জীবদেহ সৃষ্টি হয়। প্রাণী, হত্যা ও ব্যভিচার না করলে কায় সংযম হয়ে থাকে বা এ তিনটি কারণ হতে বিরত থাকলে কায় সংযম হয়। নিম্নে এদের সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা গেল ঃ
১) প্রাণীহত্যা ঃ যে কোন হীন, মধ্যম, উৎকৃষ্ট, ছোট বড়, অনু-পরমানু দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান, হিংস্র-অহিংস্র, উৎপন্ন-অনুৎপন্ন যা হবে এবং প্রাণী হত্যার কারণও হবে না। প্রত্যেক প্রাণীর প্রতি দয়াবান, হিত ও অনুকম্পাকারী হবে। কোন প্রাণীকে দন্ডাঘাত ও অস্ত্রঘাতে নির্যাতিত করবেন না। প্রাণী হত্যা হতে বিরত নর নারিগণ জন্মে- জন্মান্তরে খর্বতা, বিকলাঙ্গতা ইত্যাদি দোষ বর্জিত হয়ে পরিপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও দীঘায়ু লাভী হন। তারা বীর পরাক্রম বেগবান, সুপ্রতিষ্টি পদ বিশিষ্ট হন। দেহ সুন্দর, কোমল পবিত্র ও মহাশাক্তিশালী হয়। বাক্যালাপ কর্ণসুখকর ও জড়তাশূন্য হয়। তাদের পরিষদবর্গকে কেহ বিভেদ করতে পারে না তারা নির্ভীক ও রক্ষক হন। পরের আঘাত জনিত অপমৃত্যু তাদের হয় না। তারা জন বহুল পরিবার সম্পন্ন হন। দেহরুপ-লাবণ্যময়, সৃশ্রী, সুলক্ষণ ও সেীষ্ঠবময় হয়। চিরসুস্থ, শোকহীন ও বিচ্ছেদ, বেদনাহীন হয়ে সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাত্রা নির্বাহ করেন। মৃত্যুর পর আনন্দময় স্বর্গ প্রাপ্তি হয়।
২) চুরি বা চৌর্য কর্ম ঃ অপরের স্থাবর- অস্থাবর যে কোনও বস্তু এমনকি সামান্য সুত্রনাল পর্যন্ত ও চৌর্য্য চিত্তে গ্রহন করবে না। অপরকেও তজ্জন্য উৎসাহিত করবে না। পরের ক্ষতি কামনাও অন্তরে পোষণ করবে না। চুরি হতে বিরত নর-নারীগণ জন্মে জন্মে ধন-দান্য ও মনোজ্ঞ ভোগ সম্পদ লাভ করে থাকেন। লদ্ধ ভোগ সম্পদ চিরকাল নিখুঁত স্থায়ী হয়। অভীস্পিতবস্তু অনায়াসেই লাভ কনে। তাদের সম্পত্তি রাজা, চোর, ডাকাত, অগ্নি, জল, যক্ষ ও শত্রু কর্তৃক কিছুতে নষ্ট হয় না। মনুষ্যদের মধ্যে তারা শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেন। ‘নেই’ শব্দ কখনও তাদের শ্রুতিগোচর হয় না। এই সৎপুরুষগণ অতীব সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাত্রা নির্বাহ করে মৃত্যুর পর দিব্য আনন্দময় স্বর্গে জন্মধারণ করেন।
৩) ব্যভিচার বা মিথ্যকামাচার ঃ যথাকালে পুরুষ স্বীয় স্ত্রী বা নারীঘন স্বীয় স্বামী ব্যতীত অপর কোন মানব, তির্যক ও প্রেত জাতীয় স্ত্রী-পুরুষের সাথে কাম পরিভোগ করবে না। এমকি অপরকেও তজ্জন্য উৎসাহিত করবে না। মিথ্যাকামাচার হতে বিরত নর-নারীগণ শত্রুহীন হয়। দেব নরের প্রিয় হন। উৎকৃষ্ট খাদ্য-ভোজ্য, অন্ন-পানীয়, মনোজ্ঞ পোশাক-পরিচ্ছদ ও শস্যাদি প্রচুর পরিমাণে লাভ হয়। সুখে নিদ্রা যায়, সুখে জাগ্রত হন, চতুবির্ধ অপায়ে জন্ম গ্রহন করেন না। পুরুষগণ স্ত্রীত্ব বা নপুংসকত্ব আর নারীগণ নপুংসকত্বও বন্ধ্যত্ব হতে মুক্ত হন। সতী-সাধ্বী রমনীগণ ক্রমান্বেয়ে পুরুষত্ব প্রাপ্ত হন। তাদের ক্রোধও শত্রুহীনবল হয়। তারা প্রত্যক্ষ দর্শী হন। সভাসমিতিতে নির্ভীক ও নিঃসংকোচ চিত্তে গমন ও উপবেশন করেন। কাম মিথ্যাচার বিরত স্ত্রী পুরুষের মধ্যে পরস্পরের প্রিয়ভাব বর্দ্ধিত হয়। ইন্দ্রিয় লক্ষণ সমূহ পরিপূর্ন হয়, শঙ্কা ও কৌতুহল শূন্য হয়, ভয় ও প্রিয় বিচ্ছেদ দুঃখ বিহীন হয়ে সুখে কালযাপন করেন। মৃত্যুর পর স্বর্গে উৎপন্ন হন।
মন বা চিত্ত সংযম ঃ মনকে সংযত রাখতে পারলে মনের দুষ্ক্রিয়া, অবিদ্যা, ব্যাপাদ ও মিথ্যাদৃষ্টি ত্যাগ সাধন করে। মানসিক বৃত্তি অর্থাৎ বেদনা, সংজ্হা এবং সংস্কার এই ত্রিবিধ অরুপ ধর্ম স্কন্ধের পূর্বে মন উৎপন্ন হয়। মন উক্ত ধর্মসমুহের সঙ্গে একই বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে একই সময়ে উৎপন্ন হয়, হলেও স্ব স্ব কার্যকারণ সম্বন্ধ দ্বারা মনের পূর্ব গামিতা সুচিত হয়। উদাহরণ স্বরুপ বলা যেতে পারে যেমন গ্রাম লুন্ঠনে বহুলোক একসঙ্গে কাজ করলেও প্রদান পরিচালকের নির্দ্দেশে সমস্তকাজ সম্পন হয় তদ্রুপ মনও বৃত্তিনিচয়ের পরিচালকরুপে সব সময় পূর্বে গমন করে। মন ব্যতিত চিত্তবৃত্তি উৎপন্ন হতে পারেনা। কোন কোন চৈতসিক বা চিত্ত বৃত্তি ব্যতিত মন স্বয়ং উৎপন্ন হতে পারে। দৃস্যদল দলপতির আজ্হাধীন হয়, সেরুপ মানসিক বুত্তি নিচয় ও মনের উপর নির্ভশীল সে জন্য মনশ্রেষ্ঠ। কাষ্ঠ নির্মিত দ্রব্য কাষ্ঠময় নামে অভিহিত হয়। সেরুপ মনে উৎপন্ন বিষয়বস্তুকেও মনোময় বরা হয়।
স্বভাবতঃ মন নির্মল, আলোকময় ও অমিশ্র। স্বচ্ছজল যেমন বিভিন্নবর্ণের সংমিশ্রণে বিভিন্নরুপ প্রাপ্ত হয়, সেরুপ নির্মল মনও ভিন্ন ভিন্ন পাপ চেতনা সংযোগে ভিন্ন ভিন্ন নামে প্রকট হয়। সুতরাং বাহ্যিক উপসর্গের দ্বারা মলিন চিত্ত নতুনও নহে এবং র্পর্বতন স্বাভাবিক আলোময় চিত্ত নয়। মে জন্য লোভ, দেষ, মোহের প্রবাবে প্রাণী হত্যা, দ্বেষ, মোহ ও লোভ, মোহ চুরি এবং লোভে-মোহে ব্যভিচার এতিনটি অকুশল কায়কর্মে সম্পাদন করে মন কলুষিত হয়। দ্বেষ-মোহ, লোভ=মোহে পিশুন বাক্য, দ্বেষ ও মোহে কর্কম কথা এবং দ্বেষ মোহ ও লোভ-মোহে বৃথাবাক্রে এচারটি অকুশল বাককর্ম করে মন দুষত হয়। মোহে অবিদ্যা. দ্ষে-মোহে হিংসা এবং লোভ-মোহে মিথ্যাদৃষ্টি এতিনটি অকুশল মনোকর্ম করেমন কলুষিত হয়। এরুপে এপ্রকার পাপ পথ বাড়তে থাকে। অজ্ঞমানব লোখ, দ্বেষ, মোহ চিত্তবুত্তির কবলে পড়ে নিজেরা মনকে কলুষিত করে এবং সর্বদা অসীম দুৎখ বোগ করে।
সেজন্য তথাগত বুদ্ধ প্রত্যক্ষ অনুভ’তির জন্য উপমার দ্বারা বর্ণণা করতেছেন যে বরদেব পদানুসারী শকটচক্রের ঘুর্ণণতুল্য নিজের কৃতকর্ম ও জীবকে অনুসরণ করে। যুগবদ্ধ বলদ সপ্তাহ মাস কিংবা বৎসর চললেও চক্রকে ঘুর্ণণ হতে প্রতি নিবৃত্তি করতে পারে না। সেরুপ মন দুষিত করে জীব, কায় ও বাক এই দুইপথে সর্বদা দুষ্কার্যে লিপ্ত থাকে। পরিনামে সে জন্মান্তরে তির্ষক, প্রেত, অসুর, নরকগামী, হয়ে কল্প কল্পান্তর ধরে অসীম দুঃখ ভোগ করে। একানে বেদনা, সংজ্ঞা ও সংস্কারকে সমষ্টিগত ভাবে ধর্মনামে অভিহিত করা হয়েছে। এগুলো বিজ্ঞান বা মনের রুপান্তর। সুতরাং মানসিক বুত্তি সমূহ মনের অধীনে মনের দ্বারা পরিচালিত এবং মন এদের উৎপত্তির একমাত্র উৎস।
বাক্য সংযম ঃ লোভ-দ্বেষ-মোহে পিশুন বাক্য, দেষ-মোহে কর্কশকথা, এবং লোভ-দ্বেষ-মোহে সম্প্রলাপ বাক্য, লোভ-দ্বেষ-মোহে মিথ্যা কথা বলা থেকে বিরত থাকা।
১. মিথ্য বাক্য ভাষণ এমনকি হাস্যচ্ছলেও মিথ্যা, কটু, বুথা, ভেদ ও পিমুন বাক্য ভাষণ করবেন না। মিত্যা ভাষণে বিরত নরনারীদের জন্ম-জন্মান্তরে ইন্দ্রিয় সমূহ সুসম্পন্ন হয়, মনোহারী, মধুর ও অর্নগল বাক্য ভাষী হন, দন্তরাজী সমান, সুশ্রী. শুভ্র ও বিশুদ্ধ হয়। তাদের দেহ নাতিদীর্ঘ, নাতিহ্রস্ব, নাতিকৃশ, নাতিস্তুল, মদ্যমকার, সুখসম্পর্শ ও কমনীয় হয়। মুখ হতে সর্বদা পদ্ম গন্ধ নিঃসৃত হয়। পরিজনবর্গ প্রাণপনে তাদের সেবা শুশ্রুষা ও আদেশ পালন করে। দাতের জিহ্বা পদ্মদলের ন্যায় কোমল, রক্তিমবণ ও পাতলা হয়। তারা ঔদ্ধত্য ও চঞ্চলতা বর্জ্জিত হয় এবং মৃত্যুর পর স্বর্গ লাভ করেন।
২. পিশুন বাক্য বিরত দুইজন বন্ধুর মধ্যে পরস্পর ভেদমূলক কথা না বলা।
৩. কর্কশ বাক্য বিরত অপর জাতকে ভেদ করে কথা না বলা। জ্ঞাতি, কুল, সংস্থিতি অর্থাৎ কাণা ও বোবা বংশ ইত্যাদি তুচ্ছ কথা ও হীন কম্মাদি বলে কর্ম নিন্দা এরুপ কর্কশ কথা না বলা।
৪. সম্প্রলাপ বাক্য বিরত, চিন্তা পূর্বক লেখা, রামায়ণ, মহাভারত, উপন্যাস, নাটক, প্রহসনাদি গল্প, কথা দ্বারা সম্যক জ্ঞান লাভ হয় না। সেরুপ অজ্ঞানতা বিষয়ক কথা না বলা। রামায়ণ ও মহাভারত দীর্ঘ গল্প বটে কিন্তু ইহা বিনয় বিষয়ক নয়। বিশেষত হাস্য, রসাদি ভাব প্রকাশ কথাতে পূর্ণ। এতে কেবল দীঘায়ু, ধন, সম্পদ ও পরলোকে স্বর্গ সম্পত্তি প্রাপ্ত হবার কথা আছে। বিনয় অনুরুপ কথা বললে মনুষ্য স্বভাবত মাতা-পিতার বন্ধন, মানন, পুজন ও পাদ ধৌত করণ ইত্যাদি দ্বারা সেবা শুশ্রুষা করা এবং যথাকালে বসন, ভূষণ ইত্যাদি প্রদান ও মিষ্ট বাক্য দ্বারা শীলাদি রক্ষা করা। তাদের উপকার সাধন, স্ত্রীপুত্রেরও ধর্মত উপকার করা এবং নিকেও সুশীল হওয়া। সেরুপ অর্থ ধর্ম বিনয় লাভের জন্য উল্লেখিত তির্য়ক কথা না বলে পরিমিত শীল, সমাধি ও বির্দশন ভাবনা ইত্যাদি অর্থ ধর্ম বিনয় বিষয়ক কথা বলা উচিত।
পরিশেয়ে বলা যায় যে, কায়িক দুষ্কর্ম হতে বিরত থেকে কায়িক সংযমকারী হবেন। প্রাণী হত্যা, চুরি, ব্যভিচার পরিত্যাগ করে কায়িক কুশল সাধন করবে বাক্যে সংযত তাকবে, বাক্যের র্দুব্যবহার, মিথ্যাবাক্য, পিশুনবাক্য, সম্প্রলাপ বাক্য পরিত্যাগ পূর্বক বাচনিক কুশল কার্য সাধন করবে। মনের ক্রোধ নিবারণ করবে, মনকে সংযত রাখলে মনের দুষ্ক্রিয়া, ক্রোধ, অবিধ্যা, ব্যাপাদ ও মিথ্যাদৃষ্টি ত্যাগ করে সৎকর্ম সাধন করবে। যে সকণ ধীর ব্যক্তি কায়ে সংযত, বাক্যে সংযত এবং মনে সংযত সে ধীর ব্যক্তিগণ যথার্থ সুসংযত।
সাধু---------সাধু-------সাধু
No comments
Post a Comment