বর্তমান পেক্ষাপটে জুম্ম জাতির জন্য সপ্ত অপরিহানীয় ধর্মের গুরুত্ব
বিগত কয়েকদশক ধরে শাসকগোষ্টি নানা ভাবে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি জঘন্য কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে নিষ্পোষিত করে রেখেছে পুরো জুম্ম জাতি সত্ত্বাকে। পাহাড়ীদের সরলতার সুযোগ নিয়ে প্রতিনিয়ত ঠকাচ্ছে, জমি কেড়ে নিচ্ছে, মা বোনের সম্ভ্রম লুন্ঠন করছে, এর প্রতিবাদ করতে গেলে তাঁদের জীবন কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। যাঁরা এক সময়ে দরজা খুলে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে যেত তাঁরা আজ দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়েও রক্ষা পায়নি। এ সমস্ত অত্যাচার নির্যাতন থেকে জুম্ম জাতিকে মুক্ত করতে পাহাড়ি ছেলেরা সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিল। ১৯৭৩ সালে ৭ই জানুয়ারী জুম্ম জাতির স্বকীয় জাতি সত্ত্বা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে অক্ষুন্ন রাখার জন্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, সন্তু লারমা, প্রীতি কুমার, স্নেহ কুমার নেতৃত্বে শান্তিবাহিনী গঠন করা হয়। জুম্ম জাতির অত্যাচার, নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার অন্যতম সহায়শক্তি ছিল শান্তিবাহিনী (শান্তিবাহিনী ও শান্তিচুক্তি, সালাম আজাদ, ১৯৯৯ইং, পৃষ্ঠা-৮৭)। দীর্ঘ সংগ্রামের পর অবশেষে শান্তিচুক্তির মাধ্যমে শাসকগোষ্ঠির নির্যাতনের ঘোর অন্ধকার বিদুরিত হয়ে কিছুটা আলোর প্রতিফলন ঘটতে ঘটতে আবার নেমে আসতে শুরু করেছে রাহু গ্রাসের অন্ধকার।
বিশ্বে শান্তি ধর্ম বললে নিশ্চয় বলা হবে, তা হলো বৌদ্ধ ধর্ম। তার প্রমাণ বুদ্ধের একটি বাক্যই যথেষ্ঠ “সব্বে সত্ত্বা সুখিতা হোন্তু” অর্থাৎ- সকল প্রাণী সুখী হোক। তিনি শুধু মুখে বলেননি, বাস্তব জীবনেও করে দেখিয়ে দিয়েছেন। তিনি যখন বুদ্ধত্ব লাভের অন্যেষণে বেরিয়ে ছিলেন, তখন রাজা বিম্বিসারের রাজ্যে উপনীত হয়ে জানতে পারলেন যে, রাজা পুত্র সন্তান লাভের জন্য পাঁঠা বলি যজ্ঞের আয়োজন করেছেন। এ কথা শুনে ব্যথিত চিত্তে এদের প্রাণরক্ষার্থে যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হয়ে রাজার নিকট অসহায় প্রাণীদের প্রাণ ভিক্ষা চাইলেন। রাজা ইতস্ততঃ করলে বিন¤্র কন্ঠে বললেন, এই তুচ্ছ প্রাণীর বিনিময়ে সন্তান লাভের আশা করেছেন? সন্তান লাভের আশায় আপনি আমাকে বলি দিন, তবেই আপনার আরাধ্য দেবতা সন্তুষ্ট হয়ে আপনাকে পুত্র লাভের বর দেবেন। ঐ শুনুন এদের কাতর ক্রন্দন করে মা মা বলে আশ্রয় খুঁজতেছে। কে সে নিষ্ঠুর আরাধ্য বরদাতা দেবতা? সন্তানের আত্মহুতিতে সন্তুুষ্ট হয়ে বর প্রদান করবে? শাক্যমুনি সিদ্ধার্থের কথায় রাজার জ্ঞানচুক্ষ উন্মোচিত হলে বিনাশর্তে যজ্ঞপূজা বন্ধ করে দিয়ে তাঁর রাজ্যে পশুবলির বন্ধ ঘোষণা করলেন। রাজা বিম্বিসার সিদ্ধার্থ গৌতমকে সম্বোধন করে বললেন, যদি আপনি আপনার আরাধ্য বিষয় লাভ করেন তাহলে আমাকেই আগে আপনার ধর্মে দীক্ষিত করবেন এই প্রার্থনা করে রাজা বিদায় নিলেন (ত্রিপিটক, সুদর্শন বড়–য়া, ১৯৯৯ ইং,পৃষ্ঠা- ৬)। তথাগত গৌতম বুদ্ধ বুদ্ধত্ব লাভের পর গৃহীদের নিত্য পালনীয় পঞ্চশীলের মধ্যে সর্ব প্রথম শীল প্রাণী হত্যা নিষেধাজ্ঞা জারী করেছিলেন। এরূপ মানবতাবাদী বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী আমরা। বৌদ্ধধর্ম কথায় বিশ্বাসী নয় কাজে-কর্মের বিশ্বাসী। তাহলে আমরা কাজে-কর্মের প্রকৃত বৌদ্ধ কি হতে পেরেছি? যদি প্রকৃত বৌদ্ধ হতে পারতাম তাহলে আমরা নিজেরা হিংসা-হানা-হানিতে র্জজরিত হয়ে ভাতৃত্ব সংঘাতের মতো অবর্ণনীয় দুঃখে বয়ে নিয়ে আসতাম না। হিংসা-হানা-হানি ত্যাগ করে জাতি, সমাজ ও ধর্মে সুখ-সমৃদ্ধির জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠতাম। তাই আমাদের অন্ধ ভক্তি, অন্ধ বিশ্বাস পরিহার করে একজন মানবতাবাদী প্রকৃত বৌদ্ধ হওয়া চেষ্টা করা বাঞ্চনীয়।
১৯৮৩ সালে ১০ই নভেম্বর মহান দেশ-প্রেমিক, জাতীয় চেতনা ও জাগরণের মহান
অগ্রনায়ক, নিপীড়িত জাতি ও জনগণের একনিষ্ঠ বিপ্লব সৈনিক, জাতীয় মহান নেতা
“জন সংহতির সমিতির” প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাসহ ৮জন
সহযোগীকে হত্যার মধ্যে দিয়ে জুম্ম জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে ঘৃনিত ও কলঙ্কিত
দিন রচনা করা হলো। যাঁরা জুম্ম জাতির নির্যাতিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত জনগণের
মুক্তির একমাত্র আশ্রয় ছিলো, তাঁদেরকে করা হলো দ্বিধা বিভক্ত লাম্বা ও
বাট্ট গ্রুফে (শান্তিবাহিনী ও শান্তিচুক্তি, সালাম আজাদ, ১৯৯৯ইং,
পৃষ্ঠা-৮৮)। শাসকগোষ্ঠির বিরুদ্ধে যে অস্ত্র কাঁধে তুলে নিয়ে ছিল, সেটি
ব্যবহার করতে বাধ্য করা হল নিজের জাতি ভাইয়ের উপর, পিতার উপর, বোনের উপর।
সে দিন বেশি দুরে নয় ভাই-ভাইয়ের উপর গুলি চালানোর বারুদের গন্ধে হৃদয়
কম্পিত বন্দুকের আওয়াজে মুখরিত হয়ে উঠেছিল আকাশ বাতাস। রক্তে প্লাবিত
হয়েছিল পার্বত্য ভূমি, আজও সেই রক্তের দাগ শুকিয়ে যায়নি। আবারও সেই একই
ঘটনার পুনরাবৃত্তি। সমগ্র জাতির স্বার্থের কথা বিবেচনা না করে একদিকে
জেএসএস, জেএসএস (এমএনলারমা), অন্যদিকে ইউপিডিএফ এই তিন গ্রুফে বিভক্ত করা
হলো। এতেও শুধু বিভক্তির মাঝে সীমাবদ্ধ নেই, আত্মদ্বন্দে-কলহে লিপ্ত হয়ে
প্রতি নিয়ত ভাইয়ে-ভাইয়ে যুদ্ধ করতে করতে জুম্ম জাতির মুক্তির আন্দোলনের কথা
যেন বেমালুম ভূলে গেছি। ভালো মন্দ বিচার না করে জাতি ভাইদের হত্যার পথ
বেছে নিতে তিল পরিমাণ মাত্র দ্বিধাবোধ করছি না। অবশেষে সমঝোতায় এর কিছুটা
স্বস্তি নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে আবারও একদলে সৃষ্টি হলো ইউপিডিএফ
(গণতান্ত্রিক) নামে। আমাদের এই জুম্ম রাজনীতি পাটিগুলোর সমাধানের পথ খুঁজে
পাওয়া অত্যন্ত মুসকিল হয়ে উঠেছে, কবে নির্যাতিত জুম্মদের স্বাধীকার-অধিকার
আদায়ে জন্য সংগ্রাম করবো? এভাবে একদিকে জেএসএস, জেএসএস (এমএনলারমা),
অন্যদিকে ইউপিডিএফ, ইউপিডিএফ (গনতান্ত্রিক) ইত্যাদি ভাগে বিভক্ত হয়ে একে
অপরকে কিম্বা নীরিহ জনগণকে হত্যা, গুম, অপরহণ, মুক্তিপণ আদায়, শারীরিক
নির্যাতন ইত্যাদি নিত্য নৈমনিত্তিক ব্যাপার হয়ে উঠেছে। এতে করে জুম্ম
জনগণের কারোর চোখে ঘুম নেই। সব সময় ভীত সন্ত্রস্ত দিনাতিপাত করতে হচ্ছে।
অবর্ণীয় দুঃখে জর্জরিত আজ পুরো জুম্ম জাতি। এ হৃদয় বিদারক দৃশ্য গুলো মনে
পড়লে একবারও কি হৃদয় কম্পিত হয় না। আত্মজিজ্ঞাসা বোধ জাগ্রত হয় না? আমরা
যদি দলে দলে বিভক্তি হয়ে আমরাই আমাদেরকে হত্যা করি, তাহলে জুম্মজাতির
অস্তিত্ব কোথায় গিয়ে দাড়াঁবে? এই জাতি কোথায় ঠাঁই পাবে? এই জাতির অস্তিত্ব
কেমন করে ঠিকে থাকবে? এ কয়েকদশকে কতো জনে ভাই-বোনকে হারিয়েছে, মাতা-পিতাকে
হারিয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। কতো জুম্মজাতি ভাইয়ের তাজা রক্তে প্লাবিত
হয়েছিল পার্বত্যভূমি। ভ্রাতৃত্ব সংঘাতে অকাতরে দিতে হচ্ছে তর-তাজা প্রাণ।
আরো কতো দেখতে হবে ভাই-ভাইয়ের হত্যার করুণ দৃশ্য। সেই অতীতের ভ্রাতৃত্ব
সংঘাত থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি না? এই নিষ্ঠুর ভ্রাতৃত্বঘাতী যুদ্ধ কি
বন্ধ করতে পারি না? বুদ্ধ বলেছেন “নহি বেরেন বেরানি সম্মন্তী’ধ কুদাচনং,
অবেরেন সম্মন্তি এস ধম্মো সনন্তনো”। (ধম্মপদ-৫ নং গাথা)। জগতে শত্রুতা
দ্বারা কখনও শত্রুতার উপশম হয় না, মিত্রতার দ্বারাই শত্রুতার উপশম হয়, এটি
সনাতন ধর্ম। তাই আমাদের প্রতিশোধের ও প্রতিহিংসায় নেশায় মত্ত না হয়ে এরুপ
আদর্শে গড়ে উঠতে হবে।
আমাদের বিবাদমান চর্তুমূখী ভ্রাতৃত্ব সংঘাতের সুযোগ নিয়ে শাসকগোষ্টি নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। সে দিন বেশী দুরে নয় রামগড়ে. ভূঁয়াছড়ি, মহালছড়ি, লংগদুতে শত শত পাহাড়ি বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দিয়ে লুটপাত চালিয়ে ছিলো। এই হৃদয় বিদারক ঘটনা গুলোর করুণ দৃশ্য দেখেও কি ইচ্ছা জাগে না অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়নের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ভাবে জাতির মুক্তির সংগ্রাম করতে। তা না করে বরঞ্চ আত্মকলহে, আত্মদ্বন্দে, আত্মযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে নানা দলে উপদলে বিভক্ত হয়ে আজ ক্ষতবিক্ষত পুরো জাতি। আমরা ক্ষুদ্র তির্যক প্রাণী পিপিলিকা গুলো দেখেও কি শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি না? যখন বন্যার পানিতে সব কিছু পানিতে ডুবে যায় তখন তারা পানিতে ডুবে ভেসে যাওয়া হতে রক্ষা পেতে এক জোটা হয়ে পানিতে ভেসে যাওয়া বিপদকে মোকাবিলা করে প্রাণে রক্ষা পায়। তেমনি আমাদের জুম্মদেরও একতাবদ্ধ হয়ে যে কোন প্রতিকুলতাকে মোকাবিলা করতে হবে। আমাদের এরুপ সংকটের মহুুর্ত থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হলো সপ্ত অপরিহানীয় ধর্ম অনুশীলন ও পালনের কোন বিকল্প নেই। জুম্ম জাতিকে সুসংগঠিত, সংঘবদ্ধ ও একতাবদ্ধ জাতি গঠনে এবং রাষ্ট্রীয় জীবনের কল্যাণ সাধনার্থে বুদ্ধের সপ্ত অপরিহানীয় ধর্ম অতিব গুরুত্বপূর্ণ। বুদ্ধের এই সপ্ত অপরিহানীয় ধর্ম ব্যক্তি, সমাজ, জাতি সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করবে এতে কোন সন্দেহ নেই।
ভগবান বৈশালী সারন্দন চৈত্যে অবস্থান করার সময় বৃজি রাজ্যের শাসক মন্ডলীকে এই সাতটি উপদেশ দিয়েছিলেন। যে গুলো পালন করলে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে পরিহানি বা বিপর্যয় আসতে পারে না। সে জন্য এগুলোকে সপ্ত অপরিহানীয় বা অপরাজিত ধর্ম বলা হয়। বৃজিরা এ নীতিগুলো পালন করে তাঁদের জাতীয় জীবনে উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছিল। সেই সপ্ত অপরিহানীয় ধর্ম গুলো হল :
১। অভিণহং সন্নিপাতা ভবিস্সন্তি; অর্থাৎ- তাঁরা যেন সদা সর্বদা অভিন্ন হৃদয়ে সাধারণ সভায় সম্মিলিত হয়।
২। বহুলা সমগ্গা সন্নিপতন্তি বুট্ঠহন্তি, সমগ্গা করণীয়ানি করোন্তি; অর্থাৎ- তাঁরা যেন সকলে একমত হয়ে সংঘবদ্ধ ভাবে সভায় উপস্থিত হয় ও সভা ত্যাগ করে এবং একমতে সাধারণ কর্তব্য কার্য সম্পাদন করে।
৩। অপঞ্ঞত্তং ন পঞ্ঞাপোন্তি, পঞ্ঞত্তং ন সমুচ্ছিন্দন্তি, য়থা পঞ্ঞত্তে পোরাণে ধম্মে সমাদায় বত্তন্তি; অর্থাৎ- তাঁরা যেন হঠাৎ অবিহিত বিধি ব্যবস্থা গ্রহণ না করে বিহিত বিধি ব্যবস্থার উচ্ছেদ না করে এবং যথা বিহীত প্রাচীন বিধি ব্যবস্থা সমূহ পালন করেন।
৪। মহল্লকে সক্করোন্তি, গরু করোন্তি, মানেন্তি, পুজেন্তি, তেসং চ সোতধ্বং মঞ্ঞন্তি; অর্থাৎ- বায়োবৃদ্ধ ও জ্ঞান বৃদ্ধদের প্রতি সম্মান প্রর্দশন করে ও তাঁদের উপদেশ মেনে চলে।
৫। য়া কুলিত্থিয়ো কুল কুমারিয়ো ন ওকস্স পসয়হ বাসেন্তি; অর্থাৎ- তাঁরা যেন কুলবধু ও কুলকমারীদের প্রতি কুব্যবহার বা কোন প্রকার জবর দস্তি না করে।
৬। য়ানি য়ানি চেতিয়ানি অব্ভন্তরানি চেব বাহিরানি তানি সাক্কারোন্তি, গরুকরোন্তি, মানেন্তি, পুজেন্তি, তেসঞ্চ, দিন্নপূব্বং কতপুব্বং ধম্মিকং বলিং নো পরিহাপেন্তি; অর্থাৎ- বর্জ্জিদেশের অভ্যন্তরে ও বর্হিভাগে বর্জ্জিদের প্রতিষ্ঠিত যত চৈত্য আছে, সে গুলো পূজার্চ্চানাদি দ্বারা সম্মান প্রর্দশন করে এবং তাদের প্রাপ্য রাজস্বাদি আত্মসাৎ না করে।
৭। অরহন্তেসু ধম্মিকা রক্খাবরণগুত্তি সুসংবিহিতা হোতি, কিন্তে অনগতা চ অরহন্তা বিজিতং আগচ্ছেয়্যু, আগতা চ অরহস্তা বিজিতে ফাসুং বিহরেয়্যু বিজরেয়্যুং, বুডঢিয়েব পটিকঙ্খা নো পরিজানী; অর্থাৎ- তাঁরা যেন বর্জ্জি রাজ্যে অর্হৎদের রক্ষণাবেক্ষণ ও ভরণ পোষণের সুব্যবস্থা করে যাতে তদ্দেশাস্থিত অর্হৎতেরা নিবিঘেœ ও শাস্তিতে বসবাস করতে পারে এবং ভিন্ন দেশের অর্হৎতেরা ও তাঁদের রাজ্য আগমন করে শান্তিতে বাস করতে পারে। (তথ্যসূত্র: মহাপরিনিব্বাণ সূত্তং, রাজগুরু শ্রƒধম্মরতœ মহাস্থবির, ১৯৮১ খৃষ্টাব্দ, ২৩-৩৩ পৃষ্ঠা)।
সপ্ত অপরিহানীয় ধর্ম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা:
প্রথম অপরিহানীয় ধর্ম: বর্জ্জিগণ যেন সদা সর্বদা অভিন্ন হৃদয়ে সাধারণ সভায় সম্মিলিত হয়। দ্বিতীয় অপরিহানীয় ধর্ম: বর্জ্জিগণ যেন সকলে একমত হয়ে সংঘবদ্ধ ভাবে সভায় উপস্থিত হয় ও সভা ত্যাগ করে এবং একমতে সাধারণ কর্তব্য কার্য সম্পাদন করে।
প্রথম ও দ্বিতীয় অপরিহানীয় ধর্মে সুসংগঠিত, সংঘবদ্ধ ও একতাবদ্ধ জাতি গঠনে এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে কল্যাণ সাধনার্থে অতিব গুরুত্বসহকারে আলোচনা করা হয়েছে। বর্জ্জিগণ সর্বদা সম্মিলিত হন; সর্বদা সম্মিলিত হতে অথার্ৎ- গতকল্য সম্মিলিত হয়েছি পরশুও পূনঃ অদ্য কেন সম্মিলিত হব, তাঁরা এরূপ বলে না। বর্জ্জিগণ সম্মিলিত হওয়ার সংকেত পেলেই তাঁদের মধ্যে কেউ এখনতো আমার কাজ আছে বা আমি তো মাঙ্গলিক কাজে ব্যাপৃত আছি, এরূপ কোন আপত্তি না করে, যে যেভাবে থাকুক না কেন, যথা সময়ে সকলে সম্মিলিত হয়ে থাকেন ও কার্য্যাদি সকলে একমত হয়ে সম্পাদন করতঃ এক সঙ্গে বৈঠক হতে উঠে থাকেন এবং এক জনের রোগ, দুঃখ অভাবাদি ঘটলে সকলে মিলিত হয়ে তা প্রতিকার করেন। একের কার্য হলেও তা সকলে মিলে সম্পাদন করেন। বৃজিরা বুদ্ধের এ শিক্ষা গ্রহণ করে এমন কর্তব্য পরায়ণ ও সংঘবদ্ধ জাতি ছিল যে, জুরুরি সভার অধিবেশনের সময় ভেরি ধ্বনি করলে আহারেরত, প্রসাদনেরত, বস্ত্রপরিধানেরত, অদ্ধ ভোজন হয়েছে এমন সময়, বস্ত্র পরিধান সমাপ্ত হয়নি এমন সময়ও সভাস্থলে উপস্থিত হয়ে সকলে পরামর্শ করে কর্তব্য কার্য সমাধা করত। এই সমস্ত আদর্শ বা ধর্মগুলো আচরণ করে বর্জ্জিগণ একটি অপরাজেয় জাতি হিসেবে তৎকালিন ভারতবর্ষে প্রতিষ্টিত হয়েছিল। সে জন্যে অজাতশক্রর মতো শক্তিশালী রাজার পক্ষে বৃজিদের আক্রমণ করতে সাহস করে উঠতে পারছিলেন না। পরে তাঁর মন্ত্রী বর্ষাকর ব্রাহ্মণের সাথে পরামর্শক্রমে সরাসরি যুদ্ধে না গিয়ে কুটনৈতিক যুদ্ধে অগ্রসর হয়। এক সময় রাজা অজাতশক্র মন্ত্রী বর্ষাকর ব্রাহ্মণকে মাথা মুন্ডিত করে রাজ্য হতে তাঁড়িয়ে দিয়েছিলেন। সুচঁতুর, বুদ্ধিমান ব্রাহ্মণ কৌশলে বর্জ্জিদের সাথে একত্রিত হয়ে অল্পদিনের মধ্যে বিশ্বাসী হয়ে উঠেন। তিনি বিচারকের পদে আসীন হয়ে রাজপুত্রদের শিল্পবিদ্যা শিক্ষা দিতে লাগলেন। বর্ষাকর ব্রাহ্মণ রাজপুত্র বিদ্যা শিক্ষা দেয়ার সময় এক একেক সময় এক একেক জনকে আলাদা করে ডেকে জিজ্ঞাসা করতেন “বৎস! কি তরকারী দিয়ে ভাত খেয়েছ? কয়টি গরু দিয়ে হাল কর্ষণ করেছো ইত্যাদি। তখন অন্য ছাত্ররা জিজ্ঞাসা করতো আমাদের আচার্য্য কি জিজ্ঞাসা করেছেন? তখন তারা উত্তর দেয়, কি আর জিজ্ঞাসা করবে ভাই? কি তরকারী দিয়ে ভাত খেয়েছ? কয়টি গরু দিয়ে হাল কর্ষণ করেছো? এই সব আর কি? তখন অন্য ছাত্ররা বিশ্বাস না করে বলে থাকে, এসব বলার জন্য কি তোদেরকে অন্যত্র ডেকে নিতে হয়? আমাদের সামনে বলতে পারলেন না কেন? তোমরা নিশ্চয় সত্যি কথা গোপন করতেছো, আমাদের অবিশ্বাস করতেছো না। এভাবে একের অপরের প্রতি অবিশ্বাস ও মন-মালিন্যসৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় তিন বছর অবস্থান করে বর্জ্জিদের মধ্যে এমন দলাদলির সৃষ্টি করলেন যে, এক সঙ্গে একই পথে দুইজন রাজকুমার যেতেন না। ব্রাহ্মণের চক্রান্তে তাঁরা সপ্ত অপরিহানীয় ধর্ম হতে চ্যুত হলে, তখন ব্রাহ্মণ সুযোগ বুঝে মগধরাজ অজাতশক্রকে খবর দিলে রাজা সসৈন্য এসে বিনা বাঁধায় বৈশালি জয় করে বর্জ্জিদের পরাজয় করলেন (মহাপরিনিব্বান সুত্তং, রাজগুরু শ্রীধর্মরতœ মহাস্থবির, ১৯৪১ খৃষ্টাব্দ, পৃ:১০)।
অনুরুপভাবে শাসকগোষ্ঠী আমাদের জুম্মদের কোনদিন ভালো চক্ষে দেখে না। সে জন্য তারা ছলে-বলে কৌশলে আমাদের নানা ভাবে বিভক্ত করে দুর্বল করে রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। উক্ত বর্ষাকর ব্রাহ্মণ নামক ব্যক্তিদের লেলিয়ে দিয়ে গোপনে এর পিছনে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করতেছে। আর সেই বর্ষাকর ব্রাহ্মণ আমাদের জাতিতে, সমাজে কৌশলে ডুকে নানা কটুকৌশলে অবিশ্বাস সৃষ্টি করে নানা দলে নানা ভাগে বিভক্ত করতেছে। তাই আমাদের বিচক্ষণতার সাথে এসব বর্ষাকর ব্রাহ্মণকে চিহিৃত করে আসন্ন নানা প্রতিকুলতাকে কাঠিয়ে উঠতে হবে। আগের তুলনায় আমরা আমাদের অনেক আদর্শ হতে চ্যুত হয়েছি বিধায় আজ জাতি নানা প্রতিকুলতার সম্মূখীন হয়েছে। আগে আমাদের জুম্মজাতি অনেক ঐক্যবদ্ধ, সংহতি ও আদর্শ সম্পন্ন পরিলক্ষিত হতো। যেমন বর্ষাঋতুকে ধানচারা রোপন করার সময় গ্রামের কেউ যদি সাহায্য চাইত, তাহলে তাকে সবাই গিয়ে সাহায্য করে ধানচারা রোপন সম্পন্ন করে দিতো। শুধু তাই নয় গ্রামে যে কোন কাজের সাহায্য চাওয়া হলে অথবা গ্রামের কোন বিপদ আসন্ন হলে সবাই একত্রিত হয়ে মোকাবিলা করা হয়েছে। বর্তমানে সে সব আদর্শ হতে অনেক চ্যুত হয়েছি বিধায় আজ জুম্মজাতি অবর্ণনীয় দুঃখ দুর্দশার সম্মূখীন। বর্তমান পরিস্থিতির পেক্ষাপটে পূর্বের তুলানায় আমাদের আরো অনেক সুসংগঠিত ও সংঘবদ্ধ হতে হবে। কারণ আগের তুলনায় আমাদের জুম্মদের চলার পথ সুগম নয় আগের চেয়ে অনেক বেশী কন্ঠকময় হয়ে উঠেছে। তাই ভ্রাতৃত্ববোধ বজায় রেখে নিজেদের মধ্যে হিংসা-হানা-হানি, মারা-মারিতে লিপ্ত না হয়ে, প্রতিশোধের নেশায় নিজের ইস্পৃহা চারিতার্থ না করে বুদ্ধের উপদেশ সপ্ত অপরিহানীয় ধর্মে প্রতিষ্টিত হয়ে মৈত্রীপূর্ণ হৃদয়ে একত্রিত হয়ে সম্মূখস্থ কন্ঠকময়পদ পরিস্কার করে চলারপথ সুগম করা অত্যন্ত জুরুরী হয়ে পড়েছে।
তৃতীয় অপরিহানীয় ধর্ম: বৃজিরা যেন হঠাৎ অবিহিত বিধি ব্যবস্থা গ্রহণ না করে বিহিত বিধি ব্যবস্থার উচ্ছেদ না করে এবং যথা বিহীত প্রাচীন বিধি ব্যবস্থা সমূহ পালন করেন।
বর্জ্জিগণ পূর্বে যেরুপ বিধি ধর্মতঃ ব্যবস্থাপিত হয়নি এমন কোন বিধি বর্তমানে ব্যবস্থাপিত সুনীতি গুলো লংঘন করে না, পৌরানিক বর্জ্জীরাজ ধর্মে বিচারাদি সম্পর্কে যেরুপ ব্যবস্থা আছে তার অনুবর্তী হয়ে চলেন। এই ধর্মে দেখা যায় যে, সমাজের সুনীতি, রীতিনীতি ও বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে আলোচনা করা হয়েছে। আমাদের সমাজেও আধুনিকতার দোহাই দিয়ে সমাজের আগেকার বিধিবদ্ধ নিয়ম গুলো উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বলা চলে। আমাদের ধর্মীয় গুরুরাও ভালোমন্দ বাদ বিচার না করে পুরাতন বিধিবদ্ধ নিয়ম গুলোর কোন তোয়াক্কা না নিত্য নতুন বিধি বা নিয়ম প্রর্বতন করেই যাচ্ছে। যা সমাজে নানা বির্তকের জন্ম দিয়ে নানা মতভেদ সৃষ্টি হচ্ছে। মোট কথা আধুনিকতার দোহা দিয়ে পুরানা বিধি বা নীতি ধর্ম হতে চ্যুত হয়ে আজ আমরা দিকবেদিক শূন্য হয়ে পড়েছি। আগে আমাদের সমাজে বিবাহ যোগ্যা কন্যা অন্যেষণ করলে বুনন শিল্পে পারদর্শী কিনা যাচাই করা হতো। সে জন্যে মাতা-পিতা কন্যাকে বুনন শিল্পে পারদর্শী করার জন্য তৎপর হতে হতো। কিন্তু বর্তমান সময়ে এ সবের ধার কেউ ধারে না। আমাদের জুম্ম মেয়েরা নিজেদের কাপড় আর বুনন করে না, বুনন করে বাঙালিরা। বাঙালিরা কুঠির শিল্পে এ সব বুনন করে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যবসা করে যাচ্ছে আর আমাদের জুম্মরা তাদের কাছ থেকে ক্রয় করে পরতে হচ্ছে। বিবাহের রীতিনীতি সম্পর্কেও অনেক পরিবর্তন করা হয়েছে। বর্তমানে বিবাহ অনুষ্ঠানে শুধু মন্দিরে গিয়ে পঞ্চশীল ও সুত্রশ্রবণ করলে বিবাহ করা সম্পন্ন হয়েছে বলে মনে করে। অথচ এখানে যে কতগুলো সামাজিক রীতিনীতি রয়েছে তার কোন তোয়াক্ত করেনা। এভাবেই পুরানা নীতিধর্ম হতে চ্যুত আজ পুরো সমাজ।
রাষ্ট্রীয় রীতি-নীতি পালন করা ধর্ম মুলতঃ মানবিক মূল্যবোধকে প্রাধান্য দেয়। জনগণের কল্যাণ ও মঙ্গলের সোপান হল ধর্ম। আত্মকল্যাণ ও পরকল্যাণের নৈতিক শিক্ষার মধ্যে ধর্মের নির্যাস। গভীরতা দিক থেকে আত্মমুক্তি এর পরমুক্তি মৌলিক দিকর্দশন হল ধর্ম। ধর্মের মৌলিক এ আদর্শগুলি দৈনন্দিন জীবনে প্রতিফলিত হলেই মানুষ-মানুষে হিংসা-বিদ্বেষ, মারা-মারি, চুরি-ডাকাতি, যুদ্ধ-বিগ্রহ কোন প্রশ্নই আসে না। বুদ্ধের ধর্ম শিক্ষায় রাষ্ট্রীয় রীতি-নীতি ও প্রাচীন অনুশাসন পালনের কথা বলা হয়েছে। বুদ্ধের সময় রাজা শুদ্ধোধন, বিম্বিসার, প্রসেনজিৎ, উদয়ন, প্রদ্যোত ও লিচ্ছবি ইত্যাদি রাজাগণ বুদ্ধ ভাবাপন্ন শুধু নয় বুদ্ধের শিক্ষায় দীক্ষিত হয়েছিলেন। তাঁেদর অধীনে প্রজাবৃন্দ রাষ্ট্রীয় অনুশাসন মেনে চলতো বিধায় রাজ্যের মধ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা বিরাজ করতো। পরবর্তী সময়ে স¤্রাট অশোক সারা বিশ্বময় কি করে গেছেন তা সর্বজনবিদিত। স¤্রাট অশোকের রাষ্ট্রনীতি এবং ধর্মনীতি থেকে শিক্ষা নেওয়ার প্রয়োজন আছে আমাদের বর্তমান নেতৃবৃন্দদের। তিনি প্রজা কল্যাণের জন্য সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করে ক্ষান্ত হয়নি। নিরীহ পশুর চিকিৎসার ব্যবস্থা করে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। স¤্রাট অশোক রাজ্যভার গ্রহনে পর বৌদ্ধধর্মের অনুসারী হয়ে চন্ডাশোক থেকে ধর্মশোকে পরিণত হলে তখন থেকে রাজ্যে পশু হত্যা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। অশোক ঘোষণা করলেন আর যুদ্ধ নয়, এবার হবে ধর্ম বিজয়। ভ্রাতৃত্ব প্রেম, করুণার মধ্যে দিয়ে অপরকে জয় করতে হবে। শুধু মাত্র নির্দেশ প্রদান করেই নিজের কর্তব্য শেষ করলেন না। তিনি সকল প্রতিবেশী দেশের রাজাদের কাছে দূত পাঠিয়ে ঘোষণা করেছিলেন তিনি তাঁদের সাথে মৈত্রী, প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হতে চান। সকলে যেন নির্ভয়ে আপন রাজ্য শাসন করেন। এমনকি স¤্রাট অশোক তাঁর উত্তরাধিকারীদের কাছেও দেশ জয়ের জন্য যুদ্ধ করতে নিষেধ করেছিলেন। তিনি তাদের উপদেশ দিতেন অস্ত্রের মাধ্যমে নয়, প্রেম, করুণা, সহৃদয়তার মধ্যে দিয়েই মানুষকে জয় কর। এই জয়কে স¤্রাট অশোক বলতেন ধর্ম বিজয়। অশোকে প্রচেষ্টায় পূর্ব ভারতে বৌদ্ধ ধর্ম প্রসার লাভ করে। তবে তিনি ধর্ম প্রচারের জন্য শুধু যে রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচারকদের পাঠাতেন তাই নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্তম্ভ, পর্বত, শিলাখন্ডের ওপর বিভিন্ন উপদেশ উৎকীর্ণ করে দিতেন যাতে সেই অনুশাসন পাঠ করে প্রজারা তা পালন করতে পারে। অশোকের নির্দেশে বহু পথ নির্মাণ করা হয়। এই সমস্ত পথের দুপাশে প্রধানত বট এবং আম গাছ রোপন করা হতো। যাতে মানুষ ছায়ায় পথ চলতে পারে। ক্ষুধার সময় গাছের ফল খেতে পারে। প্রতি আট ক্রোশ অন্তর পথের ধারে কূপ খনন করা হয়েছিল।
ধর্মচরণে অধিক মনোযোগী হলেও রাজ্যশাসনের ব্যাপারে সামান্যতম দুর্বলতা দেখাননি। একজন স¤্রাট হিসেবে রাজ্য শাসনে কি তাঁর কর্তব্য তা পালন করে গেছেন? একদিন গুরুকে প্রশ্ন করলেন, গুরুদেব, সর্বশ্রেষ্ঠ দান কী? বৌদ্ধ সন্ন্যাসী উত্তর দিলেন, সর্বশ্রেষ্ঠ দান ধর্মদান। একমাত্র ধর্মের পবিত্র আলোতেই মানুষের অন্তর আলোকিত হয়ে উঠতে পারে। তুমি সেই ধর্মদান কর। গুরুর আদেশ নতমস্তকে গ্রহণ করলেন অশোক। তারই অনুপ্রেরণায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল বৌদ্ধ ধর্মের সুমহান বাণী। আমাদের জুম্ম রাজারা বা নেতৃবৃন্দরাও এরুপ আর্দশ গ্রহণ করে প্রজা কল্যাণে আত্ম নিয়োগ করা অত্যন্ত জুরুরী। আমাদের জুম্ম সমাজ বা জাতি মাঝি বিহীন নৌকার মতো আজ অসহায় ভাবে দিনাতিপাত করছে কুল কিনারা হীন অথৈই সমুদ্রে। জনগণ বা প্রজাদের এরুপ দুর্দিনে আমাদের জুম্ম রাজারা বা নেতৃবৃন্দরা এগিয়ে আসা অতিব জুরুরী। কারণ প্রজা বিহীন রাজার কোন মূল্যই থাকে না তদ্রুপ জনগণ বিহীন নেতার কোন মূল্যায়ন থাকে না। বর্তমানে সময়ে জুম্মজাতি সমাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও বিচার ব্যবস্থা খুবই করুণ অবস্থা, সে দিকে নজর দেয়া সময়ের দাবী বলে মনে করছি।
আমাদের জুম্ম সমাজে লিখিতভাবে বিচার ব্যবস্থা না থাকলেও আগেকার দিনে আমাদের পূর্বপুরুষরা সৎ ও ন্যায়ের ভিত্তিতে বিচারকার্য করে সমাজকে সুন্দর ও সুশৃঙ্খল রাখতে সক্ষম হয়েছেন। আগেকার দিনে আমাদের জুম্মদের ন্যায় বিচারের জন্য কোন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বা সরকারী বিচার আদালতে যেতে হয়নি। বর্তমানে আমাদের সমাজে যে বিচার ব্যবস্থা রয়েছে বা মুরব্বীরা বিচার-আচার করে যাচ্ছে তা দেখলে গা শিউরে উঠে। অর্থলোভে নিজেকে জলাঞ্জলি দিয়ে বিচারে নামে অবিচার করে যাচ্ছে অহরহ। অন্যায় ভাবে বিচারে জরিমানা নামে হাজার হাজার টাকা আদায় করে আত্মসাৎ করা হচ্ছে, ন্যায় বিচারের পরিবর্তে অন্যায়কে প্রতিষ্টিত করা হচ্ছে। বিচারের শাস্তির নামে অন্যায় ও নির্মম ভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে। এই সমস্ত অন্যায় অবিচার হচ্ছে দুঃশীল, দুরাচার, মাদকাসক্ত ও অযোগ্য ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা যাওয়ার কারণে। তাই আজ জুম্ম সমাজের বিচার ব্যবস্থা অত্যন্ত করুণ। সমাজে চোখ বুলালে দেখা যায় যে, যারা বিচারের ন্যায়-অন্যায় কোন মাথা মন্ডু কিছুই বুঝে না, সে আবার বিচারকের পদে আসীন হয়ে অন্যায়ের বিচার করে। কিংম্বা যার বিরুদ্ধে অন্যায়ের ভুরি ভুরি অভিযোগ সে নাকি আবার বিচারক। এরুপ অযোগ্য লোক কিভাবে অন্যায়ের বিচার করবে? এ অবস্থা হতে উত্তরণে জন্য সৎ, ন্যায়পরায়ণ ও যোগ্য লোকের হাতে বিচারকের দায়িত্ব অর্পন করা উজিত। নচেৎ অন্যায়ের বিচার প্রত্যাশাকারী কোন দিন সুবিচার আশা করা সুদুর পরাহত।
চতুর্থ অপরিহানীয় ধর্ম: বর্জ্জিগণ বায়োবৃদ্ধ ও জ্ঞান বৃদ্ধদের প্রতি সম্মাণ প্রর্দশন করে ও তাঁদের উপদেশ মেনে চলে।
বর্জ্জিগণ তাঁদের মধ্যে যাঁরা বায়োবৃদ্ধ তাঁদের প্রতি সৎকার গৌরব সম্মান ও পূজা করেন এবং তাঁদের হিতোপদেশ মেনে চলেন। ইংরেজীতে একটি কথা আছে, ওল্ড ইজ গোল্ড (ঙষফ রং মড়ষফ)। এ কথাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ জীবনের পথপরিক্রমায় অনেক কিছুর বিনিময়ে সবচেয়ে মূল্যবান যা অর্জন করে তা হলো অভিজ্ঞতা। তাই তো প্রবীণ মানেই অভিজ্ঞতা যা নবীনদের চলার পথে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারে। অভিজ্ঞতার আলো দিয়েই নবীনরা গড়বে দেশ, জাতিকে নেবে সামনের দিকে এগিয়ে আর রচনা করবে কল্যাণকর সুন্দর জীবনের পথ। সনাতনী শিক্ষায় প্রবীণদের অর্থাৎ পিতা-মাতা ও গুরুজনদের ভক্তি, শ্রদ্ধা, সেবা-শুশ্রƒষা করার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হতো। পিতা-মাতা ছেলে-মেয়েদের পক্ষে মহাব্রহ্মা সদৃশ। তাঁরাই আদিগুরু, মহাউপকারী ও মঙ্গলকামী। সে জন্যে মাতা-পিতা বা গুরুজনকে ছেলে-মেয়েরা অত্যাধিক সম্মাণ, গৌরব ও ভক্তি করবেন। পিতা-মাতা বা গুরুজন যে দিকে আছেন ছেলে-মেয়েরা সে দিকে পাদপ্রসারণ করে শয়ন করবেন না। প্রবাসে যাওয়ার সময় মাতা-পিতা বা গুরুজনকে ভক্তিসহকারে অভিবাদন করে যাত্রা করবে। প্রবাস হতে ফিরে আসলেও উত্তমরূপে আভিবাদন করবেন। পিতা-মাতা বা গুরুজনকে কখনও “তুই” শব্দ ব্যবহার করবেন না। তাঁদের সম্মূখে ক্রোধান্বিত হয়ে কোন অগৌরবনীয় কথা বলবে না। পিতা-মাতা বা গুরুজন দাঁড়িয়ে থাকলে বা কোন নীচাসনে উপবিষ্টাবস্থায় থাকলে তাঁদের সম্মূখে কখনও উচ্চাসনে উপবেশন করবে না। মাতা-পিতা বা গুরুজনকে পূর্বে খাইয়ে পরে নিজে খাবে। নতুন বা ভাল খাদ্য দ্রব্য পেলে তা হতে কিছু অংশ প্রথমে ভিক্ষুসংঘকে ও মাতা-পিতা বা গুরুজনকে দিয়ে পরে অবশিষ্টাংশ নিজে ভোগ করবেন। বৃদ্ধকালে মাতা-পিতা বা গুরুজনকে সেবা-শ্রশ্রƒষা, খাওয়া-পরা এবং সে সময়ে যা প্রয়োজন তা ব্যবস্থা করা পুত্র-কন্যার একান্ত কর্তব্য। কনিষ্ঠরাও জৈষ্ঠ ভ্রাতার প্রতি পূর্বোক্ত নিয়মে গৌরবনীয় আচরণ করবে। পিতা-মাতাসহ গুরুজনদের কোন প্রকার দুঃখ বা অসুবিধার সৃষ্টি হলে তা নিরসনের চেষ্টা করবে। পিতা-মাতার মৃত্যু হলে তাঁদের সৎগতির জন্য কুশলকর্ম করে পূন্যদান করা একান্তই উচিত। বংশ পরম্পরা কুল ধর্ম রক্ষা করার জন্য কালগত ব্যক্তিদের উদ্দেশ্য করে শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান করা একান্তই অপরিহার্য। পিতা-মাতাকে সর্বদা কুশল কর্মে নিয়োজিত করা ছেলে-মেয়েদের একান্তই কর্তব্য।
সিঙ্গলাবাদ সূত্রে বুদ্ধ সিগালকে বলেছিলেন যে, আচার্যের সামনে উচ্চ আসনে না বসা, তাঁর সেবা করা, আদেশ পালন করা, বৃদ্ধ মাতা-পিতার ভরণ-পোষণ ও উপদেশ শ্রবণ প্রতিটি গৃহস্থের কর্তব্য (সর্দ্ধমনীতি মঞ্জুরী, ড. জিন বোধি ভিক্ষু, প্রকাশকাল- চট্টগ্রাম ২০০৮, পৃ: ১৯৩)। বলতে দিধা নেই বায়োবৃদ্ধ ও জ্ঞান বৃদ্ধদের প্রতি সম্মান প্রর্দশন করা প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য। পরিবারে বড়জনদের প্রতি আদেশ ও উপদেশ মেনে চলা উচিত। বায়োবৃদ্ধ ও জ্ঞান বৃদ্ধদের মর্যাদা দিতে হবে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে, সমাজ কর্মে, শিক্ষায়, সাহিত্যে, ধর্মে, শিল্পে ও সাংস্কৃতিক অঙ্গণে যাঁদের অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁদেরকে সম্মান ও মর্যাদা দান করতে হবে। এতে পরস্পরের মধ্যে শ্রদ্ধাবোধ, বন্ধুত্ব, সৌভ্রাতৃত্ব ও ¯েœহ ভালবাসার বন্ধন গড়ে উঠবে।
পাশাপাশি ধর্মীয় অনুশাসনে প্রবীণদের সেবা, যতœ করার অনুপ্রেরণা ছিল যা আজ তথাকথিত আধুনিকতার আঘাতে বিলুপ্ত হতে চলেছে। আবার প্রবীণদের অবস্থা পারিবারিক পর্যায়ে ঐতিহ্যগতভাবে ভালো থাকলেও ক্রমান্বয়ে একান্নভুক্ত পরিবার প্রথা বিলুপ্তি ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে পরিবারে প্রবীণ ব্যক্তির জীবনের নিরাপত্তা আজ কঠিন অবস্থার মুখোমুখি। আধুনিকতার প্রভাবে বিবাহের পর নিজ সন্তানেরা দ্রুত ভিন্ন পরিবার গঠন করে, ফলে যৌথ পরিবার ভিত্তি ভেঙে পড়েছে। যার ফলশ্রুুতিতে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে প্রবীণরা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় অসহায়বোধ করে। পুত্র ও পুত্রবধূর সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে প্রবীণদের বার্ধক্যে নিজের জীবনধারণের জন্য অন্যের সাহায্য প্রার্থনা করতে হয়। আবার ধনী পরিবারের ছেলে-মেয়েরা পিতা-মাতাকে ফেলে বিদেশে পাড়ি জমানোর কারণে আর্থিক সচ্ছলতা থাকা সত্ত্বেও প্রবীণদের একাকিত্ব নিয়ে নিঃসঙ্গভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয় যা খুবই বেদনাদায়ক। এ কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, আজকের সব নবীনকে একদিন বার্ধক্যের স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। প্রবীণ কৃতী নাগরিকদের কোনো অবস্থাতেই বোঝা মনে না করে বরং তাঁদের কল্যাণে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র যথার্থ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে ঋণ পরিশোধ করবেন আজকের দিনে এ প্রত্যাশাই করি।
পঞ্চম অপরিহানীয় ধর্ম: বর্জ্জিগণ যেন কুলবধু ও কুলকমারীদের প্রতি কুব্যবহার বা কোন প্রকার জবর দস্তি না করে।
বর্জ্জিগণ কুলবধু ও কুলকুমারিদের প্রতি কুব্যবহার বা বলপূর্বক ধরে এনে স্বীয় গৃহে বাস করান না বা বলাৎকার করেন না। সিগালবাদ সূত্রে বুদ্ধ বলেছিলেন যে, স্ত্রীর প্রতি সম্মাণ প্রর্দশন করা, সুন্দর ব্যবহার করা, বৈষয়িক বিষয়ে তাঁকে কর্তৃত্ব দেওয়া, যথাসম্ভব বস্ত্রালংকার প্রদান করা, পরস্ত্রীর প্রতি আসক্ত না হয়ে নিজ নিজ স্ত্রীর প্রতি সন্তুষ্ট থাকা প্রতিটি গৃহপতির কর্তব্য (সদ্ধর্ম নীতি মঞ্জুরী, ড. জিন বোধি ভিক্ষু, প্রাগুক্ত)। ভগবান বুদ্ধ কর্তৃক প্রণীত গৃহীদের নিত্য প্রতিপালনীয় পঞ্চশীলের মধ্যে ততৃীয় শীলে দেখা যায় যে, কামেসু মিচ্ছাচারা বেরমণী সিক্খাপদং সমাদিযামি। অর্থাৎ- মিথ্যা কামাচার থেকে বিরত থাকার শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি। মিথ্যাকামাচার হতে বিরত নরনারীরা শক্রহীন হন। দেব-নরের প্রিয় হন। উকৃষ্ট খাদ্য-ভোজ্য-অন্ন-পানীয়. মনোজ্ঞ পোষাক-পরিচ্ছদ ও শষ্যাদি প্রচুর পরিমাণে লাভ হয়। সুখে নিদ্রা যান, সুখে জাগ্রত হন, চর্তুবিধ অপায়ে জন্মগ্রহণ করেন না। পুরুষগণ স্ত্রীত্ব বা নপুংসকত্ব আর নারীগণ নপুংসকত্ব ও বন্যাত্ব হতে মুক্ত হন। সতী-সাধ্বী রমনীগণ ক্রমান্বয়ে পুরুষত্ব প্রাপ্ত হয়। তাঁদের ক্রোধ ও শত্রু হীনবল হয়। তাঁরা প্রত্যক্ষদর্শী হন, সভা-সমিতিতে নির্ভীক ও নিঃসঙ্কোচ চিত্তে গমন ও উপবেশন করেন। কামমিথ্যাচার বিরত স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে পরস্পরের প্রিয়ভাব বর্দ্ধিত হয়, ইন্দ্রিয় ও লক্ষণসমূহ পরিপূর্ণ হয়, শঙ্কা ও কৌতুহল শূণ্য হয়, ভয় ও প্রিয় বিচ্ছেদ-দুঃখবিহীন হয়ে সুখে কালযাপন করেন। মুত্যুর পর স্বর্গপরাষণ হন। আর দুশ্চরিত্র নর-নারীগণ এর বিপরীত ফলই ভোগ করে থাকে (তথ্যসূত্র: সর্দ্ধম-রতœচৈত্য, জিনবংশ মহাস্থবির, ১৩৬৬ বঙ্গাব্দ, পৃষ্ঠা- ৬০)। এখানে শুধু একটি মাত্র শীলের সম্পর্কে আলোচনা করবো না। পুরা পঞ্চশীলের সম্পর্কে আলোচনা করবো।
১. পাণাতিপাতা বেরমনী সিক্খাপদং সমাদিযামি, ২. অদিন্নাদানা বেরমণী সিক্খাপদং সমাদিযামি, ৩. কামেসু মিচ্ছারানা বেরমণী সিক্খাপদং সমাদিযামি, ৪. মুসাবাদা বেরমণী সিক্খাপদং সমাদিযামি, ৫. সুরামেরেয মজ্জপমাদটঠনা বেরমণী সিক্খাপদং সমাদিযামি।
পঞ্চশীলের বাংলা অনুবাদ: ১. প্রাণী হত্যা করা থেকে বিরত থাকার শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি, ২. অদত্ত বন্তু (যা দেওয়া হয়নি) গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকার শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি, ৩. মিথ্যা কামাচার থেকে বিরত থাকার শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি, ৪. মিথ্যাকথা বলা থেকে বিরত থাকার শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি, ৫. নেশাদ্রব্য সেবন করা থেকে বিরত থাকার শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি (তথ্যসূত্র: সর্দ্ধম-রতœচৈত্য, জিনবংশ মহাস্থবির, ১৩৬৬ বঙ্গাব্দ, পৃষ্ঠা-৫৮)।
শীল মানব জীবন গঠনের ভিত্তি স্বরূপ। ব্যক্তি জীবন প্রতিষ্ঠার শ্রেষ্ঠ উপাদান। প্রব্রজিত হোক কিংবা গৃহী হোক প্রত্যেকে শীল পালন করা একান্ত কর্তব্য। সবাই সুখ আকাক্সক্ষা করে। শীলের মাধ্যমেই সুখ লাভ করা যায়। যে যত বেশি নিখুঁতভাবে শীল পালন করেন, তিনি তত বেশি সুখ লাভ করেন। শীলবান ব্যক্তিরা ক্ষমাশীল। তাঁরা দুষ্কর্ম করেন না। শীল লঙ্ঘনকারীরা পাপ-পুণ্য, ভালো-মন্দ, ধর্ম-অধর্ম জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। সৎকর্ম ছাড়া আতœমুক্তি সম্ভব নয়। শীল মানুষের জীবনকে সুন্দর ও সুশৃঙ্খল করে। সবাই তাঁদের প্রশংসা করেন। তাঁরা যশ-কীর্তির অধিকারী হন। সুতরাং সকলকে বিশুদ্ধভাবে শীল পালন করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
বিশুদ্ধিমার্গে শীল দুই প্রকার বলা হয়েছে, চারিত্র ও বারিত্রশীল। যা ভগবান বুদ্ধ কর্তৃক কর্তব্য বলে প্রজ্ঞাপ্ত হয়েছে সে সব শিক্ষাপদ পূরণ করাই চারিত্রশীল অর্থাৎ চারিত্র হল স্বভাব, চরিত্র, দেশাচার, দেশের প্রথা বা রীতি, আচরণ, নৈতিকতার নিয়ম, কর্তব্য বিষয়ক জ্ঞানের পদ্ধতি, ধর্মাচরণের নীতি, ধর্মের নিয়মাবলী এগুলোই হল চারিত্রশীল। এটি করা উচিত নয়, বলে ভগবান যা প্রত্যাখান করেছেন এবং অকরণীয় বিষয় যা নিদ্দিষ্ট করেছেন, সমস্ত শিক্ষাপদ এবং দশ অকুশল বর্জনও দশ কুশল কর্ম আচরণ ইত্যাদি সমন্ত শীল পরিপূর্ণ করার নাম বারিত্রশীল।
যাঁরা পঞ্চশীল পালন করেন তাঁরা ভোগ-সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন। সকলে তাঁদের প্রশংসা করেন। স্বর্গে গমন করেন। তাঁরা নির্ভয়ে ও নিঃসংকোচে স্বজ্ঞানে মৃত্যুবরণ করেন। নির্ভয়ে সর্বত্র বিচরণ করেন। শীলাচরণ ছাড়া পাপ-মল বিশুদ্ধ হয় না। শীলবানের সুগন্ধি বায়ুর অনুকূলে ও প্রতিকূলে প্রবাহিত হয়। শীল নির্বাণ লাভের সোপান বা সিঁড়ি। সকল নীতির মধ্যে শীলই উত্তম নীতি। তাই শীল পালন অত্যন্ত প্রয়োজন। প্রত্যেকে পঞ্চশীল পালন করা উচিত। এতে মানুষের মন সংযত থাকবে। পঞ্চশীল পালনের দ্বারা চরিত্রবান হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা যায়। বলতে গেলে, নৈতিক গুণে গুণান্বিত হয়।
বুদ্ধের এ পঞ্চনীতি যদি মানুষ মেনে চলে তাহলে বর্তমান সমাজে, জাতিতে, রাষ্ট্রে কোন অশান্তি সৃষ্টি হতে পারে না। মানুষ মানুষে হত্যা, সন্ত্রাস, খুনাখুনি যদি বন্ধ হয়; চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি থেকে মানুষ যদি বিরত হয়; নারীর প্রতি ব্যাভিচার বা নারী-ধর্ষণ যদি সমাজে অদৌ না থাকে; মিথ্যা কথন থেকে বিরত হয়ে মানুষ যদি সত্যবাদী হয় এবং মাদকাসক্তি থেকে মানুষ যদি নিস্কৃতি পায়- তাহলেই মানুষ মানুষের প্রেমপ্রীতি-ভালবাসা সৃষ্টি হবে। সমাজে, জাতিতে বা রাষ্ট্রে চলে আসবে পরস্পরে সহিষ্ণুতা, সত্যবাদিতা, ন্যায় পরায়ণতা এবং মানুষের সবচেয়ে মূল্যবান গুণ নৈতিকতা। যার ফলে সমাজে, জাতিতে বা রাষ্ট্রে কোন প্রকার অশান্তি থাকবে না। প্রতিটি মানুষের সহাবস্থানের মাধ্যমে সমাজে, জাতিতে বা রাষ্ট্রে বিরাজ করবে শান্তির সুবাতাস।
আমাদের পাহাড়ি বৌদ্ধ সমাজে যুবক-যুবতীর অবৈধ সম্পর্ক, ধর্ষণ বা বলাৎকার ব্যাপারে সমাজ খুব কঠোর ছিল। গ্রামে বা মহল্লায় এরুপ অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে থাকলে তাদেরকে কঠোর গ্রাম্য বিচার বা শালিশের সম্মূখীন হতে হতো। এরুপ বিচার ব্যবস্থার কারণে পাহাড়ি মেয়েরা অনেক সুরক্ষিত থেকে নিরাপদে অবস্থান করতো। তাই বাঙালি মেয়েদের তুলনায় পাহাড়ি মেয়েরা একটু স্বাধীন চেতার অভ্যাস্ত হয়ে পড়েছে। কিন্ত বর্তমানে পারিপার্শ্বিকতা ও পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে সে স্বাধীন চেতার পরিহার করা উচিত এবং অভিভাবকদেরও এ বিয়য়ে সচেতন হওয়া অত্যন্ত জুরুরী। আগেকার দিনে পুরানা চাকমা জাতীয় বিচার ও সমাজবিধির সংক্ষিপ্ত বিবরন আলোচনা করা গেল:
১। কোন যুবক-যুবতী পরস্পর প্রনয়াবদ্ধ হয়ে পিতামাতা বা অবিভাবকগণের অজ্ঞাতের বা অসম্মতিতে পালিয়ে গেলে ঐ মিলন অবৈধ গণ্য হয়ে বিচারে উভয়ের অর্থদন্ড হয়। পুরুষ অপেক্ষা মেয়ের শাস্তি লঘুতর হলেও এই অপরাধ কারো ২৫ টাকার অধিক অর্থদন্ড হয় না। এতদ্বব্যতীত সামাজিক লোকেরা যুবক হতে ৪/৫ মুট শূকর ও যুবতী হতে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যের ১টা শূকর বা মোরগ প্রাপ্ত হয়। এর দ্বারা সামাজিক লোকেরা এক ভোজের আয়োজন করে থাকে।
২। কোন যুবক কোন যুবতীকে নানা উপায়ে ভূলিয়ে বা বল প্রয়োগে তার সম্মতি বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধরে নিয়ে যায়, তবে তজ্জন্য যুবতী বা স্ত্রীলোক তার মর্যাদা হানির জন্য যুবক হতে ক্ষতিপূরন স্বরুপ অনধিক ২৫ টাকা প্রাপ্য হয় এবং যুবকের উপর প্রায় ঐ পরিমাণ অর্থদন্ড হয়।
৩। এই বিষয়ের বিচার নিষ্পত্তির পর যুবকের পক্ষ হতে যুবতীর সঙ্গে যদি বিবাহ সম্বন্ধ স্থাপনের ইচ্ছা করে, তাহলে যুবতীর পিতা বা অবিভবাবকের অনম্মতিতে ইহা সম্ভব হয় না, কিন্তু উক্ত যুবক যদি অপ্রতিহত উপায়ে বারংবার ঐভাবে দন্ডিত হয়েও যুবতীর সম্মতিতে তৃতীয়বার তাকে নিয়ে পলায়নে সমর্থ হয় তবে ঐ স্থলে অভিভাবকের অসম্মতি বা কোন আপত্তি এর ঐ সম্বন্ধকে রোধ করতে পারবে না।
৪। অবৈধ প্রণয়ে পলাতক আসামীদরে বিরুদ্ধে “শূকর প্রদানের” প্রথা চাকমাদের ধামাই গোজা সম্প্রদায়ের মধ্যে অপরিহার্য নহে কারণ এই প্রথা তাহাদের মধ্যে পূর্বে ছিলনা এবং এখনও অধিকাংশ ক্ষেত্রে কেহ কদাচিৎ তাদের মধ্যে অপর গোজার সঙ্গে ঐরুপ জাতীয় বিচারের কারণ উপস্থিত হলে তাতে উভয় পক্ষ ঐ “শূকর প্রদান” প্রথা পালন করে।
৫। অশিক্ষিত ও সাধারণ চাকমা সমাজের মধ্যে এখনও বিবাহে পণ প্রথা প্রচলিত আছে যদিও শিক্ষিত এবং সম্ভ্রান্ত শ্রেণীর ব্যক্তিরা এই প্রথা গ্রহণ করে না। হিন্দু জাতিদের মধ্যে মেয়ে পক্ষের উপরই পণের দাবী করা হয় কিন্তু সাধারণ সম্প্রদায়ের মধ্যে পুরুষের পক্ষে এই দাবী করা হয়ে থাকে। এই পণ বা যৌতুক প্রথার নাম চাকমাদের মধ্যে “দাভা” নামে পরিচিত। এই দাভার কোন নির্দিষ্ট পরিমাণ নেই। নগদ টাকা বস্ত্রলংকার ও ভোজ্য দ্রবাদি যে কোন প্রকার দাবীতে কিংবা বিভিন্ন প্রকার দাবীতে এর পূরণ করা যেতে পারে। অবস্থা অনুযায়ী এর প্রকার ও পরিমাণ স্থল বিশেষে নির্ণয় হয়ে থাকে। সাধারণতঃ এর পরিমাণ উর্ধ্ব সংখ্যা ৫০০ (পাঁচ শতাধিক) টাকার অধিক অতিক্রম করে না।
৬। একই বংশের মধ্যে বিবাহ সম্বন্ধ চাকমা জাতীয় প্রথার বিরুদ্ধ, খুড়ী, মাসী, পিসি, জেটি ইত্যাদি মাতৃ স্থানীয় স্ত্রীলোক কিংবা কনিষ্ঠ ভ্রাতৃবধু, ভ্রাতৃ কন্যা, ভাগিনী ইত্যাদি স্ত্রীলোকের সাথে বিবাহ সম্বন্ধ সমাজ নিয়ম বিরুদ্ধ এবং নিষিদ্ধ প্রথারুপে চলে আসতেছে। কেহ ঐ প্রথা লঙ্ঘন করলে তাদেরকে শুধু গুরুতর অর্থদন্ড করা হয় তেমন নহে, যতদিন যাবৎ প্রবজ্যা ধর্ম গ্রহণ করে বাড়িতে মঙ্গলসূত্র শ্রবণ করতে হয় ইত্যাদি যথাবিধি দ্বারা প্রায়চিত্ত করে পরিশুদ্ধ না হবে ততদিন সে সমাজচ্যুত হয়ে থাকতে বাধ্য হবে। চাকমাদের সমাজে আচার ও ব্যবহারিক জীবনে এই প্রথা প্রচলিত রয়েছে যে কেহ ভ্রাতৃবধু, পুত্রবধু কিংবা ভাগিনার স্ত্রীকে স্পর্শও করতে পারবেনা।
৭। অবৈধ মিলন কিংবা ঐ প্রকারের ঘটনা দুই কিংবা ততোধিক মৌজাবাসীর মধ্যে সংঘটিত হলে সংশ্লিষ্ট মৌজার হেডম্যানরা মিলিতভাবে এর বিচার করবেন কিংবা এতে কোন অসুবিধার কারণ দেখা দিলে সার্কেল চীপ ঐ মোকর্দ্দমার বিচার করেন।
৮। কোন ব্যক্তি পর স্ত্রীর সঙ্গে অবৈধ প্রণয়বদ্ধ হলে, উভয়কে গুরুতর অর্থ দন্ডে দন্ডিত করা হয়। কিন্তু ঐরুপ ঘটনাজনিত স্ত্রীলোকটির স্বামী যদি তার স্ত্রীকে তালাক বা ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় তবে পুরুষ অপরাধীকে আদালতের বিবেচনা ও নির্দেশ মতে তাদের মধ্যে কৃত বিবাহ ব্যয়ের আংশিক ক্ষতিপূরণ বহনে বাধ্য করা হয় এবং এরুপ ঘটনার স্ত্রী স্বামী ত্যাগে বাধ্য হলেও (নিজ স্বামীর অবৈধ প্রণয়ের ফলে) সেই স্ত্রীলোক বিচ্ছেদ প্রাপ্ত স্বামী হতে কিছু ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকারী হয়।
৯। অবৈধভাবে পলাতক স্ত্রী পুরুষ আসামীদ্বয় ধৃত বা স্বেচ্ছায় আত্মপ্রকাশ করার পর তাদেরকে আংশিক বা সম্পুর্ন দায়ী প্রমাণ করতে স্ত্রীলোকটির সত্য যাচায়ের উপর অনেকটা নির্ভরশীল। এই জন্য উভয়পক্ষ স্ত্রী লোকটিকে নিজ হেফাজতে নিয়া রাখতে ইচ্ছা প্রকাশ করে। এজন্য মোকর্দ্দমা নিষ্পত্তিকাল যাবৎ কিংবা প্রয়োজনীয় কাল যাবৎ স্ত্রীলোকটি হেডম্যানের হেফাজতে তার গৃহে অবস্থান করার প্রথা রয়েছে।
১০। কোন কোন ক্ষেত্রে অবৈধ প্রণয়বদ্ধ যুবক যুবতী পলায়নে পর আত্ম প্রকাশ করলে ঐ অপরাধে নিয়মিত অর্থদন্ড স্বীকার করে উভয় পক্ষের সম্মতিতে যুবক যুবতী মধ্যে বিবাহ সম্বন্ধ সাব্যস্থ হওয়ার পর পণের টাকা আদায় হওয়ার পূর্বে বিবাহ কার্য সম্পন্ন হয়ে গেলেও নির্দিষ্ট দিনে যুবকের পক্ষে পণের টাকা আদায়ের অসমর্থ হওয়ার দরুন বিবাহ অসিদ্ধ সাব্যস্থ হলে তজ্জন্য যুবককে দায়ী করে মেয়ের অভিভাবক অবস্থানুযায়ী ক্ষতিপূরণাদিও পেয়ে থাকে।
১১। কোন মোকর্দ্দমা বিচারের জন্য যদি মৌজার বিভিন্ন স্থানের বিশিষ্ট লোকগণের সমাবেশে সালিশী ধরনের বিচার করতে হয়, তবে অপরাধীকে অপরাধের দন্ডের অতিরিক্ত ৭ টাকা ব্যয় করতে হয়। ঐ মোকদ্দর্মায় উপস্থিত লোকজনের পান ও তামাকের জন্য ঐ টাকা ব্যয় করা হয়। এটিকে “খোয়া ভাঙনী” খরচ বলা হয়।
১২। যে কোন বিবাহ জাতীয় প্রথানুযায়ী “চুঙলাংপূজা” নামক বিবাহ পূজা অনুষ্ঠানক্রমে সম্পন্ন না হলে ঐ বিবাহ অসিদ্ধ বলে গণ্য হয়ে থাকে। এরুপ লোকের মৃত্যু হলে হাঁটুর নীচে করে শব বহন করার রীতি রয়েছে। তবে ঐ সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অপরাধের জন্য ভোজ্যানুষ্ঠানের মাধ্যমে সামাজিক লোককে তুষ্ট করতে পারলে তার ঐ অপরাধজনিত ক্রুটির জন্য আর কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
১৩। কোন কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ হলে এর “সুর কাগজ বা ডির্ভোস লেটার” নামক চুক্তিপত্র সম্পাদন করতে হয়। অন্যথা ঐ বিচ্ছেদ বলবৎ বা সিদ্ধ বলে গন্য করা হয় না। ঐ “সুর কাগজ” স্বামী-স্ত্রী উভয়েই সম্পাদন করে পরস্পরকে দিতে হয়। (চাকমা জাতি (জাতীয় চিত্র ও ইতিবুত্ত)- সতীশ চন্দ্র ঘোষ, ১৩১৬ বাংলা, ১-৬ পৃষ্ঠা, )।
ষষ্ঠ অপরিহানীয় ধর্ম: বর্জ্জিগণ বর্জ্জিদেশের অভ্যন্তরে ও বর্হিভাগে বর্জ্জিদের প্রতিষ্ঠিত যত চৈত্য আছে, সে গুলো পূজার্চ্চানাদি দ্বারা সম্মান প্রর্দশন করে এবং তাঁদের প্রাপ্য রাজস্বাদি আত্মসাৎ না করে।
বর্জ্জিগণ তাঁদের স্বীয় নগরে ও বর্হিনগরে বর্জ্জীদের যে সমন্ত চৈত্য আছে তৎসমুদয় সৎকার গৌরব, সম্মান, পূজা যথাবিহিত ভাবে পূজা করে থাকেন এবং পূর্বে যে সমস্ত রাজস্ব দেশ সেবার্থে প্রদত্ত তা ফেরত নেয় না ও পূর্বকৃত ধর্ম্মত পূজার পরিহানি করে না।
বুদ্ধের সময়ে ভারতে অনেক রাজা-মহারাজা, ধনাঢ্য ও উদার ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিবর্গের বদান্যতায় বহু বিহার ও চৈত্য নির্মাণ করে বুদ্ধ প্রমূখ ভিক্ষুসংঘকে দান দিয়ে এগুলো যথারীতি রক্ষাণাবেক্ষণসহ পূজা সৎকার করে ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের সুব্যবস্থা করেছিলেন। শাক্যমুনি গৌতম বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পর তাঁর দেহাবশেষ গুলো রাজা অজাতশক্র, লিচ্ছবি, শাক্য, কোলিয়, মল্ল, বেদদ্বীপের ব্রাহ্মণগণ ও দ্রোণ ব্রাহ্মণ ভাগ করে নিয়ে স্বীয় স্বীয় রাজ্যে নিয়ে গিয়ে এর উপর চৈত্য নির্মাণকরে সংরক্ষণ, সৎকার ও পূজার ব্যবস্থা করেছিলেন (মহাপরিনিব্বান সুত্তং, রাজগুরু র্ধমরতœ মহাস্থবির, ১৯৪১ খৃষ্টাব্দ, পৃষ্ঠা- ১৭০, ১৭১)। এমনকি বুদ্ধ শিষ্য আনন্দ, মৌদ্গল্যায়ন, সারিপুত্র প্রমূখ শ্রাবক-মহাশ্রাবকদের দেহাবশেষের উপর স্তুপ নির্মাণ করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় স¤্রাট অশোক, কনিস্ক, পাল, দেব, খড়গ, চন্দ্রবংশীয় ইত্যাদি রাজা-মহারাজারা বুদ্ধ ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধান্বিত হয়ে বহু বিহার, চৈত্য, স্তুপ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে বুদ্ধধর্ম প্রচারে অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু এ সমস্ত স্থাপনা গুলো কালের গর্ভে বিলিন হয়ে গেলেও ঐতিহাসিক পুরাতত্ত্ব স্থান হিসেবে সংরক্ষণ করে দেশী-বিদেশীদের অমূল্য স্থাপনা গুলো পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। শুধু তাই নয় বৌদ্ধদের নিকট এই সব স্থাপনা গুলোর মধ্যে চারি মহাতীর্থস্থান গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সে সব স্থাপনা গুলো বুদ্ধগয়া (যে স্থানে ছয় বছর কঠোর সাধনা করে বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন), সারানাথ (যে স্থানে বুদ্ধত্ব লাভ করার পর পঞ্চবর্গীয় শিষ্যের নিকট ধম্মচক্র প্রর্বতন সুত্র দেশনা করেছিলেন), কুশীনগর (যে স্থানে দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর ধর্ম দেশনা করার পর মহাপরির্নিবাণ লাভ করেছিলেন), লুম্বিনী (যে স্থানে তথাগত বুদ্ধ ভূমিষ্ট হয়েছিলেন) এবং ভগবান বুদ্ধ স্মৃতিবিজরিত স্থাপনা গুলো বৌদ্ধরা তর্থীস্থান হিসেবে মনে করে প্রতি বছর বিভিন্ন বৌদ্ধ দেশ থেকে হাজার হাজার টাকা খরচ করে তীর্থদর্শনের জন্য ভারতে গমন করে থাকেন।
কিন্তু আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে এক শ্রেণী অন্ধ ভক্ত রয়েছে তারা বুদ্ধে নীতি ধর্মের কোন তোয়াক্তা না করে পূর্বে প্রতিষ্টিত বৌদ্ধ বিহারকে ঐতিহাসিকত্ব ও পরিত্রতার গুরুত্ব না দিয়ে নাম পরিবর্তন করে অন্য নামে নামকরণ করে সেই ঐতিহাসিকত্ব বিলুপ্ত করা হচ্ছে। একটা কথা আছে “অতীতের ইতিহাস ভবিষ্যৎ চলার পথ সুগম করে থাকে”। সেই ঐতিহাসিকত্ব গুরুত্ব না দিয়ে জাতি, সমাজের ইতিহাস ঐতিহ্যকে বিলুপ্ত করা হচ্ছে। এমনও অভিযোগ পাওয়া গেছে যে, অনেক পবিত্র বুদ্ধমূর্তি গুলো পার্বত্য বুদ্ধমুর্তি ও অপবিত্র আখ্যা দিয়ে পরিত্যক্ত জায়গায় ফেলে রাখা হয়েছে যা অত্যন্ত অযতœ, অবহেলায় এবং এ সমস্ত স্থান গোচরণ ভূমি বানানো হয়েছে। এভাবে বিভিন্ন মতাবাদ, মতাদর্শ প্রর্বতন করে জুম্ম বৌদ্ধ সমাজকে নানা ভাবে বিভাজন করে রাখা হয়েছে। যা একজন বৌদ্ধ হিসেবে মেনে নিতে খুবই কষ্ঠ হয়। যার ফলে আমাদের জুম্ম বৌদ্ধরা সমাজ নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে নির্দয়, নিষ্টুর জঘন্য ভাতৃত্ব সংঘাতে লিপ্ত হয়ে নানা দুঃখ, দুর্দশা, উপদ্রব সৃষ্টি করা হয়েছে। ভ্রাতৃঘাতী নির্দয় নিষ্টুর সংঘাতে অকাতরে তর-তাজা প্রাণ ঝড়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন? তাই আমাদের উচিত সপ্ত অপরিহানীয় ধর্মে প্রতিষ্ঠিত থেকে এরুপ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যে সমস্ত পার্বত্য বৌদ্ধ বিহার বনবিহার নামে পরিবর্তন করা হয়েছে তার একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা দেয়া হল:
রাঙ্গামাটি সদর উপজেলা: ১) গোলাছড়ি জনকল্যাণ বৌদ্ধ বিহার, বর্তমান জুম্ম স্মৃতি বন বিহার, ২) কাইন্দা নালন্দা বৌদ্ধ বিহার, বর্তমান কাইন্দা বন বিহার, ৩) ধুতাঙ্গ বৌদ্ধ বিহার, বর্তমান ধুতাঙ্গ বন বিহার। বরকল উপজেলা: ১) ভূষণছড়া জনকল্যাণ বৌদ্ধ বিহার পরিবর্তে ভূষণছড়া ত্যাগেই সুখ বন বিহার, ২) মিটিঙ্গাছড়ি বৌদ্ধ বিহার পরিবর্তে সুবলং শ্রাবস্তী বন বিহার করা হয়েছে। নানিয়াচর উপজেলা: ১) পতিখালি ফলবন বৌদ্ধ বিহার, বর্তমান পতিখালি বন বিহার, ২) গরখেদ চিত্তারাম বৌদ্ধ বিহার, বর্তমান গরখেদ বন বিহার। বাঘাইছড়ি উপজেলা: ১) নলবনিয়া সংঘ শক্তি বৌদ্ধ বিহারের পরিবর্তে নলবনিয়া নালন্দা বন বিহার করা হয়েছে। পানছড়ি উপজেলা: ১) দেবগিরি বৌদ্ধবিহার, বর্তমানে দেবগিরি বনবিহার, ২) বিনয়পুর অরণ্য কুটির বৌদ্ধ বিহারের বর্তমানে প্রজ্ঞা সাধনা বনবিহার, ৩) উদয় গিরি বৌদ্ধ বিহার বর্তমানে-হারুবিল বন বিহার।
সপ্তম অপরিহানীয় ধর্ম: বর্জ্জিগণ যেন বর্জ্জি রাজ্যে অর্হৎদের রক্ষণাবেক্ষণ ও ভরণ পোষণের সুব্যবস্থা করে যাতে তদ্দেশাস্থিত অর্হৎতেরা নিবিঘেœ ও শাস্তিতে বসবাস করতে পারে এবং ভিন্ন দেশের অর্হৎতেরা ও তাঁদের রাজ্য আগমণ করে শাস্তিতে বাস করতে পারে।
সিগালবাদ সূত্রে বুদ্ধ বলেছিলেন যে, ভক্তিপূর্ণ চিত্তে শ্রামণ ভিক্ষুদের সেবা শুশ্রƒষা করা, তাঁদের পূজা করা, ধর্মশ্রবণ করা, ইহলোকে আর্য শিষ্যগণ ভিক্ষুসংঘকে চীবর দিয়ে সেবা করা, আহার্য ও ঔষধ পথ্যাদি দিয়ে সেবা করা এই চারটি বিষয়কে আমি গৃহীদের স্বর্গ ও যশলাভের পন্থা বলছি। (সদ্ধর্ম নীতি মঞ্জুরী, ড. জিন বোধি ভিক্ষু, প্রাগুক্ত)। বৌদ্ধ ধর্মে শীলবান, সংসারত্যাগী, কল্যাণমিত্র ধর্মচার্যদের উদ্দেশ্য সংঘদান, অষ্টপরিস্কার দান ও কঠিন চীবর দান দেওয়ার রীতি রয়েছে। মহাউপসিকা বিশাখা বুদ্ধের কাছে ভিক্ষুদের জন্য ৮টি বর প্রার্থনা করেছিলেন। তথাগত বুদ্ধ ভিক্ষুসংঘের শ্রীবৃদ্ধি এবং বুদ্ধ শাসনের সমৃদ্ধির কথা চিন্তা করে তা অনুমোদন করেছিলেন। সে গুলো হল: ১) ভিক্ষু সংঘকে আজীবন ¯œানবস্ত্র প্রদান বা বর্ষাচীবর দান, ২) আগস্তুক ভিক্ষুকে আহার্যদান, ৩) গমনকারী ভিক্ষুকে সাহায্য দান, ৪) রুগ্ন ভিক্ষুকে আহার্য দান, ৫) রোগীর পরিচায়ককে আহার্য দান, ৬) রোগী ভিক্ষুকে ভৈষজ্য দান, ৭) নিত্য জবাগু প্রদান এবং ৮) ভিক্ষুনী সংঘকে আহার্য দান (ত্রিপিটক, সুর্দশন বড়–য়া, ১৯৯৯ইং, পৃষ্ঠা- ১২১)। মহাউপাসিকা বিশাখার এ মহান আদর্শ সর্বস্তরের মানুষ মনে প্রাণে গ্রহণ করে বাস্তবে রুপদান করলে সমাজ ও সদ্ধর্মের মহাউপকার হবে এতে কোন সন্দেহ নেই। এছাড়া তৎকালীন রাজা, শ্রেষ্ঠী ও শ্রদ্ধাবান উপাসক-উপাসিকাগণ বুদ্ধ প্রমূখ ভিক্ষু সংঘের জন্য বিহার নির্মাণ ও তাঁদের যাবতীয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করতেন।
ভিক্ষুত্ব ধর্ম পালনের সহায়স্বরুপ শয়নাসন, চীবর, আহার ও ঔষধ-পথ্যাদি বৌদ্ধ শাসনের চিরস্থিতি কামনা করে প্রিয়শীল, শিক্ষাকামী ও শীলবান ভিক্ষু-শ্রমণদের শ্রদ্ধার সাথে দান করবেন। নিজের সামর্থ্য না থাকলেও অপরে দ্বারা দান করাতে হবে। ন্যুনতম দিনে একবার হলেও ভিক্ষুর নিকট উপস্থিত হয়ে তাঁদের সুখ-দুঃখ ও সুবিধা-অসুবিধার জিজ্ঞাসা করতে হবে। কোন বস্তুর অভাব হলে সে গুলো নিজে বা অন্যে নিকট হতে সংগ্রহ করে দিতে হবে। প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে ভিক্ষুদের “ভন্তে” ব্যতীত “ঠাকুর বলবেন না। ভিক্ষুদের প্রতি “ঠাকুর” শব্দটা ব্যবহার করাটা সদ্ধর্মে অশিক্ষিত ও অশ্রদ্ধাবানের পরিচায়ক। আত্মত্যাগী বৌদ্ধ ভিক্ষু-সংঘকে যথোচিত শ্রদ্ধা, পূজা ও সম্মাণ করা উচিত। আমরা কিছু সংখ্যক পাহাড়ি বৌদ্ধরা এসবের তোয়াক্কা না প্রতিনিয়ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্মীয় গুরুদের সমালোচনা, দুর্নাম করেই যাচ্ছি অর্থকভাবে। শুধু এখানেই থেমে নেই ধর্মের আশ্রয় নেয়া গৈরিক বসনধারীদের রং কাপড় খুলে টেনে হিজড়ে নিয়ে হত্যার মতো জগন্য ঘটনা পর্যন্ত সংগঠিত হওয়া পরিলক্ষিত হয়েছে। এরুপ ঘটনা যা বৌদ্ধ ধর্মকে কলঙ্কিত করা হয়েছে। এমনিতেই অভিযোগ রয়েছে যে, “অতীতে অর্হৎ ভিক্ষু হত্যার কারণে জুম্মজাতির এমন দুর্দশা”। তাই আমাদের সজাগ থাকতে হবে যাতে আমাদের দ্বারাই এমন কোন হীনকর্ম সংগঠিত না হয় যে কর্মের দ¦ারাই জাতি, ধর্ম ও সমাজে ক্ষতি হয়। ধর্মের যেন পরিহানি না হয়, অশ্রদ্ধা উৎপন্ন না হয়, অগৌবর প্রর্দশন করা না হয়।
বিমুক্ত মহাপুরুষ অর্হৎ এবং অবিদ্যা-তৃষ্ণার নিরবশেষ নিবৃত্তিতে নিবিষ্ট শীলবানদের সান্নিধ্য লাভ খুবই প্রীতিদায়ক ও সদ্ধর্মানন্দময় অনুভূতি সঞ্চারক। এরুপ পূন্যপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধাচিত্তে দান দেওয়া তাঁদের জন্য প্রয়োজনীয় সুব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং এতোদৃশ গুণীদের এলাকায় শুভাগমনের লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেওয়া ও তাঁদের নিরাপদ অবস্থান নিশ্চিতকরণে ব্যক্তি ও সমাজের অশেষ পূন্য কর্ম সম্পাদিত হয়। এহেন কৃত সুকর্মের ফল্গুধারায় ব্যক্তি ও সমাজ ঐশ্বমন্ডিত ও নিরুবিঘœ থাকে। কাঁদায় শাপলার জন্ম হয়ে পানির উপর বিশুদ্ধ থেকে অবস্থান করতঃ পুকুরের শোভা বর্ধন করে। আত্মত্যাগী এবং গৈরিক বসনধারী ভিক্ষুগণকে তদ্রুপ সমাজে অবস্থান করে বিশুদ্ধ অবস্থায় সমাজের বা জাতির কল্যাণ কর্ম করতে হবে। তাই এই আদর্শে যাঁরা বৌদ্ধ ভিক্ষু আছেন, তাঁরা সামর্থ্য অনুসারে জাতির জন্য আত্মনিবেদিত প্রাণ হয়ে কল্যাণ কর্ম করে যাচ্ছেন। তবে সমাজের জন্য যা করা হচ্ছে তা প্রয়োজনীয় তুলনায় অপ্রতুল। আরো একটু এগ্রেসিভ হয়ে সমাজ, ধর্ম ও জাতির মঙ্গলার্থে কাজ করতে হবে। কিস্তু দুঃখের বিষয় আমাদের সমাজে কিছু সংখ্যক ভিক্ষু রয়েছেন নরকের ভয় দেখিয়ে, স¦র্গে সুখে প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ আদায় করে নিজের আরাম-আয়াসে, সুঃখ-স্বাচ্ছন্দ্যে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত রয়েছেন। ধর্মকে অধর্ম অধর্মকে ধর্ম বলে প্রচার করে ধর্মকে তথা সমাজকে বিপথে পরিচালিত করে বর্তমান জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগের জ্ঞানের আলো হতে দুরে ছড়িয়ে দিয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন জগতে ঠেলে দিচ্ছে যা কখনও কামন্য নয়। এভাবে সমাজকে অন্ধত্ব করে রাখা হচ্ছে দিনের পর দিন। এর ফলে আমাদের জুম্ম বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও নানা মতবাদ, নানা মতভেদে বন-পার্বত্য-উচলা-নন্দপাল-প্রজ্ঞালংকার ইত্যাদি নিকায়ে বা মতবাদে বিভক্ত হয়ে আজ ক্ষতবিক্ষত। পাশাপাশি দায়কেরাও বন-পার্বত্য-উচলা ইত্যাদি ভক্তে বিভক্ত। আমাদের এ বিষয় গুলো হতে বেরিয়ে আসতে হবে। কারণ বৌদ্ধ ধর্ম মিথ্যা দৃষ্টি ধর্ম নয়, এটি সম্যক দৃষ্টি ধর্ম। সম্যক ভাবে উপলদ্ধি করে, হৃদয়ঙ্গম করে বাস্তব কর্মক্ষেত্রে কায়-মন-বাক্যে প্রয়োগ করতে হবে। তবেই সমাজে, ধর্মে ও জাতিতে শাস্তি আনয়ন করতে পাবরো। নচেৎ নয়।
পরিশেষে বলবো অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজের হিংসা, বিদ্বেষ, হানা-হানি, মারা-মারি ভুলে গিয়ে ও হীন স্বার্থ পরিত্যাগ করে, অর্থ লোভে নিজেকে বিক্রি না করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জুম্ম জাতি মুক্তির জন্য সংগ্রাম করতে হবে, আন্দোলন করতে হবে। তবে একটি কথা বলা প্রয়োজন আমাদের সমাজে বা জাতিতে কুচক্রী বর্ষাকর নামক ব্রাহ্মণ অগাধে বিচরণ রয়েছে। আমাদের সেই সমস্ত বর্ষাকর ব্রাহ্মণকে চিহ্নিত করে তাদেরকে বর্জন করে চলতে হবে। তাদের কাছ থেকে দুরে গিয়ে সর্তকভাবে অবস্থান করতে হবে। তারা যাতে সমাজে বা জাতিতে বা ধর্মে কোন ক্ষতি কনতে না পারে সেদিকে তীক্ষè নজর রাখতে হবে। আমার এ লেখাগুলো কোন পক্ষপাতিত্ব অবলম্বন বা সমর্থন করে লেখার চেষ্টা করেনি। বর্তমান পরিস্থিতিকে উপলদ্ধি করে বাস্তব সত্যটুকু উৎঘাতন করার চেষ্টা করেছি মাত্র। এ লেখা অপ্রিয় সত্য হলেও সুন্দর মন মানসিকতা নিয়ে মনোনিবেশ পূর্বক চিন্তা করে দেখবেন। এতে যদি জুম্ম জাতির সামান্যতম উপকার সাধন করতে পারি, তাহলে আমার এ শ্রম স্বার্থক হবে। বুদ্ধও নিজের জ্ঞাতি শাক্যবংশের বাঁচানোর জন্য ছায়া বিহীন বৃক্ষতলার উপবেশন করে অবস্থান করেছিলেন। তদ্রুপ আমারও এরুপ প্রচেষ্ঠা মাত্র। এতে যদি আমার ভুলত্রুুতি হয়ে থাকে বা আমার অজানায় কারও মনে দুঃখ-কষ্ট দিয়ে থাকি তাহলে আমাকে ক্ষমা সুন্দর মন মানসিকতা নিয়ে দেখবেন।
লেখক পরিচিতি: সাধনাজ্যোতি ভিক্ষু, বি, এ (অনার্স) এম, এ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, এম, এড দারুল আহসান বিশ্ববিদ্যালয়, অধ্যক্ষ হিল চাদিগাং বৌদ্ধ বিহার, প্রধান এডমিন, হিল চাদিগাং ডটকম পেইজ।
আমাদের বিবাদমান চর্তুমূখী ভ্রাতৃত্ব সংঘাতের সুযোগ নিয়ে শাসকগোষ্টি নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। সে দিন বেশী দুরে নয় রামগড়ে. ভূঁয়াছড়ি, মহালছড়ি, লংগদুতে শত শত পাহাড়ি বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দিয়ে লুটপাত চালিয়ে ছিলো। এই হৃদয় বিদারক ঘটনা গুলোর করুণ দৃশ্য দেখেও কি ইচ্ছা জাগে না অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়নের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ভাবে জাতির মুক্তির সংগ্রাম করতে। তা না করে বরঞ্চ আত্মকলহে, আত্মদ্বন্দে, আত্মযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে নানা দলে উপদলে বিভক্ত হয়ে আজ ক্ষতবিক্ষত পুরো জাতি। আমরা ক্ষুদ্র তির্যক প্রাণী পিপিলিকা গুলো দেখেও কি শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি না? যখন বন্যার পানিতে সব কিছু পানিতে ডুবে যায় তখন তারা পানিতে ডুবে ভেসে যাওয়া হতে রক্ষা পেতে এক জোটা হয়ে পানিতে ভেসে যাওয়া বিপদকে মোকাবিলা করে প্রাণে রক্ষা পায়। তেমনি আমাদের জুম্মদেরও একতাবদ্ধ হয়ে যে কোন প্রতিকুলতাকে মোকাবিলা করতে হবে। আমাদের এরুপ সংকটের মহুুর্ত থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হলো সপ্ত অপরিহানীয় ধর্ম অনুশীলন ও পালনের কোন বিকল্প নেই। জুম্ম জাতিকে সুসংগঠিত, সংঘবদ্ধ ও একতাবদ্ধ জাতি গঠনে এবং রাষ্ট্রীয় জীবনের কল্যাণ সাধনার্থে বুদ্ধের সপ্ত অপরিহানীয় ধর্ম অতিব গুরুত্বপূর্ণ। বুদ্ধের এই সপ্ত অপরিহানীয় ধর্ম ব্যক্তি, সমাজ, জাতি সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করবে এতে কোন সন্দেহ নেই।
ভগবান বৈশালী সারন্দন চৈত্যে অবস্থান করার সময় বৃজি রাজ্যের শাসক মন্ডলীকে এই সাতটি উপদেশ দিয়েছিলেন। যে গুলো পালন করলে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে পরিহানি বা বিপর্যয় আসতে পারে না। সে জন্য এগুলোকে সপ্ত অপরিহানীয় বা অপরাজিত ধর্ম বলা হয়। বৃজিরা এ নীতিগুলো পালন করে তাঁদের জাতীয় জীবনে উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছিল। সেই সপ্ত অপরিহানীয় ধর্ম গুলো হল :
১। অভিণহং সন্নিপাতা ভবিস্সন্তি; অর্থাৎ- তাঁরা যেন সদা সর্বদা অভিন্ন হৃদয়ে সাধারণ সভায় সম্মিলিত হয়।
২। বহুলা সমগ্গা সন্নিপতন্তি বুট্ঠহন্তি, সমগ্গা করণীয়ানি করোন্তি; অর্থাৎ- তাঁরা যেন সকলে একমত হয়ে সংঘবদ্ধ ভাবে সভায় উপস্থিত হয় ও সভা ত্যাগ করে এবং একমতে সাধারণ কর্তব্য কার্য সম্পাদন করে।
৩। অপঞ্ঞত্তং ন পঞ্ঞাপোন্তি, পঞ্ঞত্তং ন সমুচ্ছিন্দন্তি, য়থা পঞ্ঞত্তে পোরাণে ধম্মে সমাদায় বত্তন্তি; অর্থাৎ- তাঁরা যেন হঠাৎ অবিহিত বিধি ব্যবস্থা গ্রহণ না করে বিহিত বিধি ব্যবস্থার উচ্ছেদ না করে এবং যথা বিহীত প্রাচীন বিধি ব্যবস্থা সমূহ পালন করেন।
৪। মহল্লকে সক্করোন্তি, গরু করোন্তি, মানেন্তি, পুজেন্তি, তেসং চ সোতধ্বং মঞ্ঞন্তি; অর্থাৎ- বায়োবৃদ্ধ ও জ্ঞান বৃদ্ধদের প্রতি সম্মান প্রর্দশন করে ও তাঁদের উপদেশ মেনে চলে।
৫। য়া কুলিত্থিয়ো কুল কুমারিয়ো ন ওকস্স পসয়হ বাসেন্তি; অর্থাৎ- তাঁরা যেন কুলবধু ও কুলকমারীদের প্রতি কুব্যবহার বা কোন প্রকার জবর দস্তি না করে।
৬। য়ানি য়ানি চেতিয়ানি অব্ভন্তরানি চেব বাহিরানি তানি সাক্কারোন্তি, গরুকরোন্তি, মানেন্তি, পুজেন্তি, তেসঞ্চ, দিন্নপূব্বং কতপুব্বং ধম্মিকং বলিং নো পরিহাপেন্তি; অর্থাৎ- বর্জ্জিদেশের অভ্যন্তরে ও বর্হিভাগে বর্জ্জিদের প্রতিষ্ঠিত যত চৈত্য আছে, সে গুলো পূজার্চ্চানাদি দ্বারা সম্মান প্রর্দশন করে এবং তাদের প্রাপ্য রাজস্বাদি আত্মসাৎ না করে।
৭। অরহন্তেসু ধম্মিকা রক্খাবরণগুত্তি সুসংবিহিতা হোতি, কিন্তে অনগতা চ অরহন্তা বিজিতং আগচ্ছেয়্যু, আগতা চ অরহস্তা বিজিতে ফাসুং বিহরেয়্যু বিজরেয়্যুং, বুডঢিয়েব পটিকঙ্খা নো পরিজানী; অর্থাৎ- তাঁরা যেন বর্জ্জি রাজ্যে অর্হৎদের রক্ষণাবেক্ষণ ও ভরণ পোষণের সুব্যবস্থা করে যাতে তদ্দেশাস্থিত অর্হৎতেরা নিবিঘেœ ও শাস্তিতে বসবাস করতে পারে এবং ভিন্ন দেশের অর্হৎতেরা ও তাঁদের রাজ্য আগমন করে শান্তিতে বাস করতে পারে। (তথ্যসূত্র: মহাপরিনিব্বাণ সূত্তং, রাজগুরু শ্রƒধম্মরতœ মহাস্থবির, ১৯৮১ খৃষ্টাব্দ, ২৩-৩৩ পৃষ্ঠা)।
সপ্ত অপরিহানীয় ধর্ম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা:
প্রথম অপরিহানীয় ধর্ম: বর্জ্জিগণ যেন সদা সর্বদা অভিন্ন হৃদয়ে সাধারণ সভায় সম্মিলিত হয়। দ্বিতীয় অপরিহানীয় ধর্ম: বর্জ্জিগণ যেন সকলে একমত হয়ে সংঘবদ্ধ ভাবে সভায় উপস্থিত হয় ও সভা ত্যাগ করে এবং একমতে সাধারণ কর্তব্য কার্য সম্পাদন করে।
প্রথম ও দ্বিতীয় অপরিহানীয় ধর্মে সুসংগঠিত, সংঘবদ্ধ ও একতাবদ্ধ জাতি গঠনে এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে কল্যাণ সাধনার্থে অতিব গুরুত্বসহকারে আলোচনা করা হয়েছে। বর্জ্জিগণ সর্বদা সম্মিলিত হন; সর্বদা সম্মিলিত হতে অথার্ৎ- গতকল্য সম্মিলিত হয়েছি পরশুও পূনঃ অদ্য কেন সম্মিলিত হব, তাঁরা এরূপ বলে না। বর্জ্জিগণ সম্মিলিত হওয়ার সংকেত পেলেই তাঁদের মধ্যে কেউ এখনতো আমার কাজ আছে বা আমি তো মাঙ্গলিক কাজে ব্যাপৃত আছি, এরূপ কোন আপত্তি না করে, যে যেভাবে থাকুক না কেন, যথা সময়ে সকলে সম্মিলিত হয়ে থাকেন ও কার্য্যাদি সকলে একমত হয়ে সম্পাদন করতঃ এক সঙ্গে বৈঠক হতে উঠে থাকেন এবং এক জনের রোগ, দুঃখ অভাবাদি ঘটলে সকলে মিলিত হয়ে তা প্রতিকার করেন। একের কার্য হলেও তা সকলে মিলে সম্পাদন করেন। বৃজিরা বুদ্ধের এ শিক্ষা গ্রহণ করে এমন কর্তব্য পরায়ণ ও সংঘবদ্ধ জাতি ছিল যে, জুরুরি সভার অধিবেশনের সময় ভেরি ধ্বনি করলে আহারেরত, প্রসাদনেরত, বস্ত্রপরিধানেরত, অদ্ধ ভোজন হয়েছে এমন সময়, বস্ত্র পরিধান সমাপ্ত হয়নি এমন সময়ও সভাস্থলে উপস্থিত হয়ে সকলে পরামর্শ করে কর্তব্য কার্য সমাধা করত। এই সমস্ত আদর্শ বা ধর্মগুলো আচরণ করে বর্জ্জিগণ একটি অপরাজেয় জাতি হিসেবে তৎকালিন ভারতবর্ষে প্রতিষ্টিত হয়েছিল। সে জন্যে অজাতশক্রর মতো শক্তিশালী রাজার পক্ষে বৃজিদের আক্রমণ করতে সাহস করে উঠতে পারছিলেন না। পরে তাঁর মন্ত্রী বর্ষাকর ব্রাহ্মণের সাথে পরামর্শক্রমে সরাসরি যুদ্ধে না গিয়ে কুটনৈতিক যুদ্ধে অগ্রসর হয়। এক সময় রাজা অজাতশক্র মন্ত্রী বর্ষাকর ব্রাহ্মণকে মাথা মুন্ডিত করে রাজ্য হতে তাঁড়িয়ে দিয়েছিলেন। সুচঁতুর, বুদ্ধিমান ব্রাহ্মণ কৌশলে বর্জ্জিদের সাথে একত্রিত হয়ে অল্পদিনের মধ্যে বিশ্বাসী হয়ে উঠেন। তিনি বিচারকের পদে আসীন হয়ে রাজপুত্রদের শিল্পবিদ্যা শিক্ষা দিতে লাগলেন। বর্ষাকর ব্রাহ্মণ রাজপুত্র বিদ্যা শিক্ষা দেয়ার সময় এক একেক সময় এক একেক জনকে আলাদা করে ডেকে জিজ্ঞাসা করতেন “বৎস! কি তরকারী দিয়ে ভাত খেয়েছ? কয়টি গরু দিয়ে হাল কর্ষণ করেছো ইত্যাদি। তখন অন্য ছাত্ররা জিজ্ঞাসা করতো আমাদের আচার্য্য কি জিজ্ঞাসা করেছেন? তখন তারা উত্তর দেয়, কি আর জিজ্ঞাসা করবে ভাই? কি তরকারী দিয়ে ভাত খেয়েছ? কয়টি গরু দিয়ে হাল কর্ষণ করেছো? এই সব আর কি? তখন অন্য ছাত্ররা বিশ্বাস না করে বলে থাকে, এসব বলার জন্য কি তোদেরকে অন্যত্র ডেকে নিতে হয়? আমাদের সামনে বলতে পারলেন না কেন? তোমরা নিশ্চয় সত্যি কথা গোপন করতেছো, আমাদের অবিশ্বাস করতেছো না। এভাবে একের অপরের প্রতি অবিশ্বাস ও মন-মালিন্যসৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় তিন বছর অবস্থান করে বর্জ্জিদের মধ্যে এমন দলাদলির সৃষ্টি করলেন যে, এক সঙ্গে একই পথে দুইজন রাজকুমার যেতেন না। ব্রাহ্মণের চক্রান্তে তাঁরা সপ্ত অপরিহানীয় ধর্ম হতে চ্যুত হলে, তখন ব্রাহ্মণ সুযোগ বুঝে মগধরাজ অজাতশক্রকে খবর দিলে রাজা সসৈন্য এসে বিনা বাঁধায় বৈশালি জয় করে বর্জ্জিদের পরাজয় করলেন (মহাপরিনিব্বান সুত্তং, রাজগুরু শ্রীধর্মরতœ মহাস্থবির, ১৯৪১ খৃষ্টাব্দ, পৃ:১০)।
অনুরুপভাবে শাসকগোষ্ঠী আমাদের জুম্মদের কোনদিন ভালো চক্ষে দেখে না। সে জন্য তারা ছলে-বলে কৌশলে আমাদের নানা ভাবে বিভক্ত করে দুর্বল করে রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। উক্ত বর্ষাকর ব্রাহ্মণ নামক ব্যক্তিদের লেলিয়ে দিয়ে গোপনে এর পিছনে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করতেছে। আর সেই বর্ষাকর ব্রাহ্মণ আমাদের জাতিতে, সমাজে কৌশলে ডুকে নানা কটুকৌশলে অবিশ্বাস সৃষ্টি করে নানা দলে নানা ভাগে বিভক্ত করতেছে। তাই আমাদের বিচক্ষণতার সাথে এসব বর্ষাকর ব্রাহ্মণকে চিহিৃত করে আসন্ন নানা প্রতিকুলতাকে কাঠিয়ে উঠতে হবে। আগের তুলনায় আমরা আমাদের অনেক আদর্শ হতে চ্যুত হয়েছি বিধায় আজ জাতি নানা প্রতিকুলতার সম্মূখীন হয়েছে। আগে আমাদের জুম্মজাতি অনেক ঐক্যবদ্ধ, সংহতি ও আদর্শ সম্পন্ন পরিলক্ষিত হতো। যেমন বর্ষাঋতুকে ধানচারা রোপন করার সময় গ্রামের কেউ যদি সাহায্য চাইত, তাহলে তাকে সবাই গিয়ে সাহায্য করে ধানচারা রোপন সম্পন্ন করে দিতো। শুধু তাই নয় গ্রামে যে কোন কাজের সাহায্য চাওয়া হলে অথবা গ্রামের কোন বিপদ আসন্ন হলে সবাই একত্রিত হয়ে মোকাবিলা করা হয়েছে। বর্তমানে সে সব আদর্শ হতে অনেক চ্যুত হয়েছি বিধায় আজ জুম্মজাতি অবর্ণনীয় দুঃখ দুর্দশার সম্মূখীন। বর্তমান পরিস্থিতির পেক্ষাপটে পূর্বের তুলানায় আমাদের আরো অনেক সুসংগঠিত ও সংঘবদ্ধ হতে হবে। কারণ আগের তুলনায় আমাদের জুম্মদের চলার পথ সুগম নয় আগের চেয়ে অনেক বেশী কন্ঠকময় হয়ে উঠেছে। তাই ভ্রাতৃত্ববোধ বজায় রেখে নিজেদের মধ্যে হিংসা-হানা-হানি, মারা-মারিতে লিপ্ত না হয়ে, প্রতিশোধের নেশায় নিজের ইস্পৃহা চারিতার্থ না করে বুদ্ধের উপদেশ সপ্ত অপরিহানীয় ধর্মে প্রতিষ্টিত হয়ে মৈত্রীপূর্ণ হৃদয়ে একত্রিত হয়ে সম্মূখস্থ কন্ঠকময়পদ পরিস্কার করে চলারপথ সুগম করা অত্যন্ত জুরুরী হয়ে পড়েছে।
তৃতীয় অপরিহানীয় ধর্ম: বৃজিরা যেন হঠাৎ অবিহিত বিধি ব্যবস্থা গ্রহণ না করে বিহিত বিধি ব্যবস্থার উচ্ছেদ না করে এবং যথা বিহীত প্রাচীন বিধি ব্যবস্থা সমূহ পালন করেন।
বর্জ্জিগণ পূর্বে যেরুপ বিধি ধর্মতঃ ব্যবস্থাপিত হয়নি এমন কোন বিধি বর্তমানে ব্যবস্থাপিত সুনীতি গুলো লংঘন করে না, পৌরানিক বর্জ্জীরাজ ধর্মে বিচারাদি সম্পর্কে যেরুপ ব্যবস্থা আছে তার অনুবর্তী হয়ে চলেন। এই ধর্মে দেখা যায় যে, সমাজের সুনীতি, রীতিনীতি ও বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে আলোচনা করা হয়েছে। আমাদের সমাজেও আধুনিকতার দোহাই দিয়ে সমাজের আগেকার বিধিবদ্ধ নিয়ম গুলো উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বলা চলে। আমাদের ধর্মীয় গুরুরাও ভালোমন্দ বাদ বিচার না করে পুরাতন বিধিবদ্ধ নিয়ম গুলোর কোন তোয়াক্কা না নিত্য নতুন বিধি বা নিয়ম প্রর্বতন করেই যাচ্ছে। যা সমাজে নানা বির্তকের জন্ম দিয়ে নানা মতভেদ সৃষ্টি হচ্ছে। মোট কথা আধুনিকতার দোহা দিয়ে পুরানা বিধি বা নীতি ধর্ম হতে চ্যুত হয়ে আজ আমরা দিকবেদিক শূন্য হয়ে পড়েছি। আগে আমাদের সমাজে বিবাহ যোগ্যা কন্যা অন্যেষণ করলে বুনন শিল্পে পারদর্শী কিনা যাচাই করা হতো। সে জন্যে মাতা-পিতা কন্যাকে বুনন শিল্পে পারদর্শী করার জন্য তৎপর হতে হতো। কিন্তু বর্তমান সময়ে এ সবের ধার কেউ ধারে না। আমাদের জুম্ম মেয়েরা নিজেদের কাপড় আর বুনন করে না, বুনন করে বাঙালিরা। বাঙালিরা কুঠির শিল্পে এ সব বুনন করে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যবসা করে যাচ্ছে আর আমাদের জুম্মরা তাদের কাছ থেকে ক্রয় করে পরতে হচ্ছে। বিবাহের রীতিনীতি সম্পর্কেও অনেক পরিবর্তন করা হয়েছে। বর্তমানে বিবাহ অনুষ্ঠানে শুধু মন্দিরে গিয়ে পঞ্চশীল ও সুত্রশ্রবণ করলে বিবাহ করা সম্পন্ন হয়েছে বলে মনে করে। অথচ এখানে যে কতগুলো সামাজিক রীতিনীতি রয়েছে তার কোন তোয়াক্ত করেনা। এভাবেই পুরানা নীতিধর্ম হতে চ্যুত আজ পুরো সমাজ।
রাষ্ট্রীয় রীতি-নীতি পালন করা ধর্ম মুলতঃ মানবিক মূল্যবোধকে প্রাধান্য দেয়। জনগণের কল্যাণ ও মঙ্গলের সোপান হল ধর্ম। আত্মকল্যাণ ও পরকল্যাণের নৈতিক শিক্ষার মধ্যে ধর্মের নির্যাস। গভীরতা দিক থেকে আত্মমুক্তি এর পরমুক্তি মৌলিক দিকর্দশন হল ধর্ম। ধর্মের মৌলিক এ আদর্শগুলি দৈনন্দিন জীবনে প্রতিফলিত হলেই মানুষ-মানুষে হিংসা-বিদ্বেষ, মারা-মারি, চুরি-ডাকাতি, যুদ্ধ-বিগ্রহ কোন প্রশ্নই আসে না। বুদ্ধের ধর্ম শিক্ষায় রাষ্ট্রীয় রীতি-নীতি ও প্রাচীন অনুশাসন পালনের কথা বলা হয়েছে। বুদ্ধের সময় রাজা শুদ্ধোধন, বিম্বিসার, প্রসেনজিৎ, উদয়ন, প্রদ্যোত ও লিচ্ছবি ইত্যাদি রাজাগণ বুদ্ধ ভাবাপন্ন শুধু নয় বুদ্ধের শিক্ষায় দীক্ষিত হয়েছিলেন। তাঁেদর অধীনে প্রজাবৃন্দ রাষ্ট্রীয় অনুশাসন মেনে চলতো বিধায় রাজ্যের মধ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা বিরাজ করতো। পরবর্তী সময়ে স¤্রাট অশোক সারা বিশ্বময় কি করে গেছেন তা সর্বজনবিদিত। স¤্রাট অশোকের রাষ্ট্রনীতি এবং ধর্মনীতি থেকে শিক্ষা নেওয়ার প্রয়োজন আছে আমাদের বর্তমান নেতৃবৃন্দদের। তিনি প্রজা কল্যাণের জন্য সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করে ক্ষান্ত হয়নি। নিরীহ পশুর চিকিৎসার ব্যবস্থা করে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। স¤্রাট অশোক রাজ্যভার গ্রহনে পর বৌদ্ধধর্মের অনুসারী হয়ে চন্ডাশোক থেকে ধর্মশোকে পরিণত হলে তখন থেকে রাজ্যে পশু হত্যা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। অশোক ঘোষণা করলেন আর যুদ্ধ নয়, এবার হবে ধর্ম বিজয়। ভ্রাতৃত্ব প্রেম, করুণার মধ্যে দিয়ে অপরকে জয় করতে হবে। শুধু মাত্র নির্দেশ প্রদান করেই নিজের কর্তব্য শেষ করলেন না। তিনি সকল প্রতিবেশী দেশের রাজাদের কাছে দূত পাঠিয়ে ঘোষণা করেছিলেন তিনি তাঁদের সাথে মৈত্রী, প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হতে চান। সকলে যেন নির্ভয়ে আপন রাজ্য শাসন করেন। এমনকি স¤্রাট অশোক তাঁর উত্তরাধিকারীদের কাছেও দেশ জয়ের জন্য যুদ্ধ করতে নিষেধ করেছিলেন। তিনি তাদের উপদেশ দিতেন অস্ত্রের মাধ্যমে নয়, প্রেম, করুণা, সহৃদয়তার মধ্যে দিয়েই মানুষকে জয় কর। এই জয়কে স¤্রাট অশোক বলতেন ধর্ম বিজয়। অশোকে প্রচেষ্টায় পূর্ব ভারতে বৌদ্ধ ধর্ম প্রসার লাভ করে। তবে তিনি ধর্ম প্রচারের জন্য শুধু যে রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচারকদের পাঠাতেন তাই নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্তম্ভ, পর্বত, শিলাখন্ডের ওপর বিভিন্ন উপদেশ উৎকীর্ণ করে দিতেন যাতে সেই অনুশাসন পাঠ করে প্রজারা তা পালন করতে পারে। অশোকের নির্দেশে বহু পথ নির্মাণ করা হয়। এই সমস্ত পথের দুপাশে প্রধানত বট এবং আম গাছ রোপন করা হতো। যাতে মানুষ ছায়ায় পথ চলতে পারে। ক্ষুধার সময় গাছের ফল খেতে পারে। প্রতি আট ক্রোশ অন্তর পথের ধারে কূপ খনন করা হয়েছিল।
ধর্মচরণে অধিক মনোযোগী হলেও রাজ্যশাসনের ব্যাপারে সামান্যতম দুর্বলতা দেখাননি। একজন স¤্রাট হিসেবে রাজ্য শাসনে কি তাঁর কর্তব্য তা পালন করে গেছেন? একদিন গুরুকে প্রশ্ন করলেন, গুরুদেব, সর্বশ্রেষ্ঠ দান কী? বৌদ্ধ সন্ন্যাসী উত্তর দিলেন, সর্বশ্রেষ্ঠ দান ধর্মদান। একমাত্র ধর্মের পবিত্র আলোতেই মানুষের অন্তর আলোকিত হয়ে উঠতে পারে। তুমি সেই ধর্মদান কর। গুরুর আদেশ নতমস্তকে গ্রহণ করলেন অশোক। তারই অনুপ্রেরণায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল বৌদ্ধ ধর্মের সুমহান বাণী। আমাদের জুম্ম রাজারা বা নেতৃবৃন্দরাও এরুপ আর্দশ গ্রহণ করে প্রজা কল্যাণে আত্ম নিয়োগ করা অত্যন্ত জুরুরী। আমাদের জুম্ম সমাজ বা জাতি মাঝি বিহীন নৌকার মতো আজ অসহায় ভাবে দিনাতিপাত করছে কুল কিনারা হীন অথৈই সমুদ্রে। জনগণ বা প্রজাদের এরুপ দুর্দিনে আমাদের জুম্ম রাজারা বা নেতৃবৃন্দরা এগিয়ে আসা অতিব জুরুরী। কারণ প্রজা বিহীন রাজার কোন মূল্যই থাকে না তদ্রুপ জনগণ বিহীন নেতার কোন মূল্যায়ন থাকে না। বর্তমানে সময়ে জুম্মজাতি সমাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও বিচার ব্যবস্থা খুবই করুণ অবস্থা, সে দিকে নজর দেয়া সময়ের দাবী বলে মনে করছি।
আমাদের জুম্ম সমাজে লিখিতভাবে বিচার ব্যবস্থা না থাকলেও আগেকার দিনে আমাদের পূর্বপুরুষরা সৎ ও ন্যায়ের ভিত্তিতে বিচারকার্য করে সমাজকে সুন্দর ও সুশৃঙ্খল রাখতে সক্ষম হয়েছেন। আগেকার দিনে আমাদের জুম্মদের ন্যায় বিচারের জন্য কোন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বা সরকারী বিচার আদালতে যেতে হয়নি। বর্তমানে আমাদের সমাজে যে বিচার ব্যবস্থা রয়েছে বা মুরব্বীরা বিচার-আচার করে যাচ্ছে তা দেখলে গা শিউরে উঠে। অর্থলোভে নিজেকে জলাঞ্জলি দিয়ে বিচারে নামে অবিচার করে যাচ্ছে অহরহ। অন্যায় ভাবে বিচারে জরিমানা নামে হাজার হাজার টাকা আদায় করে আত্মসাৎ করা হচ্ছে, ন্যায় বিচারের পরিবর্তে অন্যায়কে প্রতিষ্টিত করা হচ্ছে। বিচারের শাস্তির নামে অন্যায় ও নির্মম ভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে। এই সমস্ত অন্যায় অবিচার হচ্ছে দুঃশীল, দুরাচার, মাদকাসক্ত ও অযোগ্য ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা যাওয়ার কারণে। তাই আজ জুম্ম সমাজের বিচার ব্যবস্থা অত্যন্ত করুণ। সমাজে চোখ বুলালে দেখা যায় যে, যারা বিচারের ন্যায়-অন্যায় কোন মাথা মন্ডু কিছুই বুঝে না, সে আবার বিচারকের পদে আসীন হয়ে অন্যায়ের বিচার করে। কিংম্বা যার বিরুদ্ধে অন্যায়ের ভুরি ভুরি অভিযোগ সে নাকি আবার বিচারক। এরুপ অযোগ্য লোক কিভাবে অন্যায়ের বিচার করবে? এ অবস্থা হতে উত্তরণে জন্য সৎ, ন্যায়পরায়ণ ও যোগ্য লোকের হাতে বিচারকের দায়িত্ব অর্পন করা উজিত। নচেৎ অন্যায়ের বিচার প্রত্যাশাকারী কোন দিন সুবিচার আশা করা সুদুর পরাহত।
চতুর্থ অপরিহানীয় ধর্ম: বর্জ্জিগণ বায়োবৃদ্ধ ও জ্ঞান বৃদ্ধদের প্রতি সম্মাণ প্রর্দশন করে ও তাঁদের উপদেশ মেনে চলে।
বর্জ্জিগণ তাঁদের মধ্যে যাঁরা বায়োবৃদ্ধ তাঁদের প্রতি সৎকার গৌরব সম্মান ও পূজা করেন এবং তাঁদের হিতোপদেশ মেনে চলেন। ইংরেজীতে একটি কথা আছে, ওল্ড ইজ গোল্ড (ঙষফ রং মড়ষফ)। এ কথাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ জীবনের পথপরিক্রমায় অনেক কিছুর বিনিময়ে সবচেয়ে মূল্যবান যা অর্জন করে তা হলো অভিজ্ঞতা। তাই তো প্রবীণ মানেই অভিজ্ঞতা যা নবীনদের চলার পথে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারে। অভিজ্ঞতার আলো দিয়েই নবীনরা গড়বে দেশ, জাতিকে নেবে সামনের দিকে এগিয়ে আর রচনা করবে কল্যাণকর সুন্দর জীবনের পথ। সনাতনী শিক্ষায় প্রবীণদের অর্থাৎ পিতা-মাতা ও গুরুজনদের ভক্তি, শ্রদ্ধা, সেবা-শুশ্রƒষা করার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হতো। পিতা-মাতা ছেলে-মেয়েদের পক্ষে মহাব্রহ্মা সদৃশ। তাঁরাই আদিগুরু, মহাউপকারী ও মঙ্গলকামী। সে জন্যে মাতা-পিতা বা গুরুজনকে ছেলে-মেয়েরা অত্যাধিক সম্মাণ, গৌরব ও ভক্তি করবেন। পিতা-মাতা বা গুরুজন যে দিকে আছেন ছেলে-মেয়েরা সে দিকে পাদপ্রসারণ করে শয়ন করবেন না। প্রবাসে যাওয়ার সময় মাতা-পিতা বা গুরুজনকে ভক্তিসহকারে অভিবাদন করে যাত্রা করবে। প্রবাস হতে ফিরে আসলেও উত্তমরূপে আভিবাদন করবেন। পিতা-মাতা বা গুরুজনকে কখনও “তুই” শব্দ ব্যবহার করবেন না। তাঁদের সম্মূখে ক্রোধান্বিত হয়ে কোন অগৌরবনীয় কথা বলবে না। পিতা-মাতা বা গুরুজন দাঁড়িয়ে থাকলে বা কোন নীচাসনে উপবিষ্টাবস্থায় থাকলে তাঁদের সম্মূখে কখনও উচ্চাসনে উপবেশন করবে না। মাতা-পিতা বা গুরুজনকে পূর্বে খাইয়ে পরে নিজে খাবে। নতুন বা ভাল খাদ্য দ্রব্য পেলে তা হতে কিছু অংশ প্রথমে ভিক্ষুসংঘকে ও মাতা-পিতা বা গুরুজনকে দিয়ে পরে অবশিষ্টাংশ নিজে ভোগ করবেন। বৃদ্ধকালে মাতা-পিতা বা গুরুজনকে সেবা-শ্রশ্রƒষা, খাওয়া-পরা এবং সে সময়ে যা প্রয়োজন তা ব্যবস্থা করা পুত্র-কন্যার একান্ত কর্তব্য। কনিষ্ঠরাও জৈষ্ঠ ভ্রাতার প্রতি পূর্বোক্ত নিয়মে গৌরবনীয় আচরণ করবে। পিতা-মাতাসহ গুরুজনদের কোন প্রকার দুঃখ বা অসুবিধার সৃষ্টি হলে তা নিরসনের চেষ্টা করবে। পিতা-মাতার মৃত্যু হলে তাঁদের সৎগতির জন্য কুশলকর্ম করে পূন্যদান করা একান্তই উচিত। বংশ পরম্পরা কুল ধর্ম রক্ষা করার জন্য কালগত ব্যক্তিদের উদ্দেশ্য করে শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান করা একান্তই অপরিহার্য। পিতা-মাতাকে সর্বদা কুশল কর্মে নিয়োজিত করা ছেলে-মেয়েদের একান্তই কর্তব্য।
সিঙ্গলাবাদ সূত্রে বুদ্ধ সিগালকে বলেছিলেন যে, আচার্যের সামনে উচ্চ আসনে না বসা, তাঁর সেবা করা, আদেশ পালন করা, বৃদ্ধ মাতা-পিতার ভরণ-পোষণ ও উপদেশ শ্রবণ প্রতিটি গৃহস্থের কর্তব্য (সর্দ্ধমনীতি মঞ্জুরী, ড. জিন বোধি ভিক্ষু, প্রকাশকাল- চট্টগ্রাম ২০০৮, পৃ: ১৯৩)। বলতে দিধা নেই বায়োবৃদ্ধ ও জ্ঞান বৃদ্ধদের প্রতি সম্মান প্রর্দশন করা প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য। পরিবারে বড়জনদের প্রতি আদেশ ও উপদেশ মেনে চলা উচিত। বায়োবৃদ্ধ ও জ্ঞান বৃদ্ধদের মর্যাদা দিতে হবে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে, সমাজ কর্মে, শিক্ষায়, সাহিত্যে, ধর্মে, শিল্পে ও সাংস্কৃতিক অঙ্গণে যাঁদের অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁদেরকে সম্মান ও মর্যাদা দান করতে হবে। এতে পরস্পরের মধ্যে শ্রদ্ধাবোধ, বন্ধুত্ব, সৌভ্রাতৃত্ব ও ¯েœহ ভালবাসার বন্ধন গড়ে উঠবে।
পাশাপাশি ধর্মীয় অনুশাসনে প্রবীণদের সেবা, যতœ করার অনুপ্রেরণা ছিল যা আজ তথাকথিত আধুনিকতার আঘাতে বিলুপ্ত হতে চলেছে। আবার প্রবীণদের অবস্থা পারিবারিক পর্যায়ে ঐতিহ্যগতভাবে ভালো থাকলেও ক্রমান্বয়ে একান্নভুক্ত পরিবার প্রথা বিলুপ্তি ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে পরিবারে প্রবীণ ব্যক্তির জীবনের নিরাপত্তা আজ কঠিন অবস্থার মুখোমুখি। আধুনিকতার প্রভাবে বিবাহের পর নিজ সন্তানেরা দ্রুত ভিন্ন পরিবার গঠন করে, ফলে যৌথ পরিবার ভিত্তি ভেঙে পড়েছে। যার ফলশ্রুুতিতে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে প্রবীণরা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় অসহায়বোধ করে। পুত্র ও পুত্রবধূর সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে প্রবীণদের বার্ধক্যে নিজের জীবনধারণের জন্য অন্যের সাহায্য প্রার্থনা করতে হয়। আবার ধনী পরিবারের ছেলে-মেয়েরা পিতা-মাতাকে ফেলে বিদেশে পাড়ি জমানোর কারণে আর্থিক সচ্ছলতা থাকা সত্ত্বেও প্রবীণদের একাকিত্ব নিয়ে নিঃসঙ্গভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয় যা খুবই বেদনাদায়ক। এ কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, আজকের সব নবীনকে একদিন বার্ধক্যের স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। প্রবীণ কৃতী নাগরিকদের কোনো অবস্থাতেই বোঝা মনে না করে বরং তাঁদের কল্যাণে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র যথার্থ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে ঋণ পরিশোধ করবেন আজকের দিনে এ প্রত্যাশাই করি।
পঞ্চম অপরিহানীয় ধর্ম: বর্জ্জিগণ যেন কুলবধু ও কুলকমারীদের প্রতি কুব্যবহার বা কোন প্রকার জবর দস্তি না করে।
বর্জ্জিগণ কুলবধু ও কুলকুমারিদের প্রতি কুব্যবহার বা বলপূর্বক ধরে এনে স্বীয় গৃহে বাস করান না বা বলাৎকার করেন না। সিগালবাদ সূত্রে বুদ্ধ বলেছিলেন যে, স্ত্রীর প্রতি সম্মাণ প্রর্দশন করা, সুন্দর ব্যবহার করা, বৈষয়িক বিষয়ে তাঁকে কর্তৃত্ব দেওয়া, যথাসম্ভব বস্ত্রালংকার প্রদান করা, পরস্ত্রীর প্রতি আসক্ত না হয়ে নিজ নিজ স্ত্রীর প্রতি সন্তুষ্ট থাকা প্রতিটি গৃহপতির কর্তব্য (সদ্ধর্ম নীতি মঞ্জুরী, ড. জিন বোধি ভিক্ষু, প্রাগুক্ত)। ভগবান বুদ্ধ কর্তৃক প্রণীত গৃহীদের নিত্য প্রতিপালনীয় পঞ্চশীলের মধ্যে ততৃীয় শীলে দেখা যায় যে, কামেসু মিচ্ছাচারা বেরমণী সিক্খাপদং সমাদিযামি। অর্থাৎ- মিথ্যা কামাচার থেকে বিরত থাকার শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি। মিথ্যাকামাচার হতে বিরত নরনারীরা শক্রহীন হন। দেব-নরের প্রিয় হন। উকৃষ্ট খাদ্য-ভোজ্য-অন্ন-পানীয়. মনোজ্ঞ পোষাক-পরিচ্ছদ ও শষ্যাদি প্রচুর পরিমাণে লাভ হয়। সুখে নিদ্রা যান, সুখে জাগ্রত হন, চর্তুবিধ অপায়ে জন্মগ্রহণ করেন না। পুরুষগণ স্ত্রীত্ব বা নপুংসকত্ব আর নারীগণ নপুংসকত্ব ও বন্যাত্ব হতে মুক্ত হন। সতী-সাধ্বী রমনীগণ ক্রমান্বয়ে পুরুষত্ব প্রাপ্ত হয়। তাঁদের ক্রোধ ও শত্রু হীনবল হয়। তাঁরা প্রত্যক্ষদর্শী হন, সভা-সমিতিতে নির্ভীক ও নিঃসঙ্কোচ চিত্তে গমন ও উপবেশন করেন। কামমিথ্যাচার বিরত স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে পরস্পরের প্রিয়ভাব বর্দ্ধিত হয়, ইন্দ্রিয় ও লক্ষণসমূহ পরিপূর্ণ হয়, শঙ্কা ও কৌতুহল শূণ্য হয়, ভয় ও প্রিয় বিচ্ছেদ-দুঃখবিহীন হয়ে সুখে কালযাপন করেন। মুত্যুর পর স্বর্গপরাষণ হন। আর দুশ্চরিত্র নর-নারীগণ এর বিপরীত ফলই ভোগ করে থাকে (তথ্যসূত্র: সর্দ্ধম-রতœচৈত্য, জিনবংশ মহাস্থবির, ১৩৬৬ বঙ্গাব্দ, পৃষ্ঠা- ৬০)। এখানে শুধু একটি মাত্র শীলের সম্পর্কে আলোচনা করবো না। পুরা পঞ্চশীলের সম্পর্কে আলোচনা করবো।
১. পাণাতিপাতা বেরমনী সিক্খাপদং সমাদিযামি, ২. অদিন্নাদানা বেরমণী সিক্খাপদং সমাদিযামি, ৩. কামেসু মিচ্ছারানা বেরমণী সিক্খাপদং সমাদিযামি, ৪. মুসাবাদা বেরমণী সিক্খাপদং সমাদিযামি, ৫. সুরামেরেয মজ্জপমাদটঠনা বেরমণী সিক্খাপদং সমাদিযামি।
পঞ্চশীলের বাংলা অনুবাদ: ১. প্রাণী হত্যা করা থেকে বিরত থাকার শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি, ২. অদত্ত বন্তু (যা দেওয়া হয়নি) গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকার শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি, ৩. মিথ্যা কামাচার থেকে বিরত থাকার শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি, ৪. মিথ্যাকথা বলা থেকে বিরত থাকার শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি, ৫. নেশাদ্রব্য সেবন করা থেকে বিরত থাকার শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি (তথ্যসূত্র: সর্দ্ধম-রতœচৈত্য, জিনবংশ মহাস্থবির, ১৩৬৬ বঙ্গাব্দ, পৃষ্ঠা-৫৮)।
শীল মানব জীবন গঠনের ভিত্তি স্বরূপ। ব্যক্তি জীবন প্রতিষ্ঠার শ্রেষ্ঠ উপাদান। প্রব্রজিত হোক কিংবা গৃহী হোক প্রত্যেকে শীল পালন করা একান্ত কর্তব্য। সবাই সুখ আকাক্সক্ষা করে। শীলের মাধ্যমেই সুখ লাভ করা যায়। যে যত বেশি নিখুঁতভাবে শীল পালন করেন, তিনি তত বেশি সুখ লাভ করেন। শীলবান ব্যক্তিরা ক্ষমাশীল। তাঁরা দুষ্কর্ম করেন না। শীল লঙ্ঘনকারীরা পাপ-পুণ্য, ভালো-মন্দ, ধর্ম-অধর্ম জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। সৎকর্ম ছাড়া আতœমুক্তি সম্ভব নয়। শীল মানুষের জীবনকে সুন্দর ও সুশৃঙ্খল করে। সবাই তাঁদের প্রশংসা করেন। তাঁরা যশ-কীর্তির অধিকারী হন। সুতরাং সকলকে বিশুদ্ধভাবে শীল পালন করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
বিশুদ্ধিমার্গে শীল দুই প্রকার বলা হয়েছে, চারিত্র ও বারিত্রশীল। যা ভগবান বুদ্ধ কর্তৃক কর্তব্য বলে প্রজ্ঞাপ্ত হয়েছে সে সব শিক্ষাপদ পূরণ করাই চারিত্রশীল অর্থাৎ চারিত্র হল স্বভাব, চরিত্র, দেশাচার, দেশের প্রথা বা রীতি, আচরণ, নৈতিকতার নিয়ম, কর্তব্য বিষয়ক জ্ঞানের পদ্ধতি, ধর্মাচরণের নীতি, ধর্মের নিয়মাবলী এগুলোই হল চারিত্রশীল। এটি করা উচিত নয়, বলে ভগবান যা প্রত্যাখান করেছেন এবং অকরণীয় বিষয় যা নিদ্দিষ্ট করেছেন, সমস্ত শিক্ষাপদ এবং দশ অকুশল বর্জনও দশ কুশল কর্ম আচরণ ইত্যাদি সমন্ত শীল পরিপূর্ণ করার নাম বারিত্রশীল।
যাঁরা পঞ্চশীল পালন করেন তাঁরা ভোগ-সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন। সকলে তাঁদের প্রশংসা করেন। স্বর্গে গমন করেন। তাঁরা নির্ভয়ে ও নিঃসংকোচে স্বজ্ঞানে মৃত্যুবরণ করেন। নির্ভয়ে সর্বত্র বিচরণ করেন। শীলাচরণ ছাড়া পাপ-মল বিশুদ্ধ হয় না। শীলবানের সুগন্ধি বায়ুর অনুকূলে ও প্রতিকূলে প্রবাহিত হয়। শীল নির্বাণ লাভের সোপান বা সিঁড়ি। সকল নীতির মধ্যে শীলই উত্তম নীতি। তাই শীল পালন অত্যন্ত প্রয়োজন। প্রত্যেকে পঞ্চশীল পালন করা উচিত। এতে মানুষের মন সংযত থাকবে। পঞ্চশীল পালনের দ্বারা চরিত্রবান হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা যায়। বলতে গেলে, নৈতিক গুণে গুণান্বিত হয়।
বুদ্ধের এ পঞ্চনীতি যদি মানুষ মেনে চলে তাহলে বর্তমান সমাজে, জাতিতে, রাষ্ট্রে কোন অশান্তি সৃষ্টি হতে পারে না। মানুষ মানুষে হত্যা, সন্ত্রাস, খুনাখুনি যদি বন্ধ হয়; চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি থেকে মানুষ যদি বিরত হয়; নারীর প্রতি ব্যাভিচার বা নারী-ধর্ষণ যদি সমাজে অদৌ না থাকে; মিথ্যা কথন থেকে বিরত হয়ে মানুষ যদি সত্যবাদী হয় এবং মাদকাসক্তি থেকে মানুষ যদি নিস্কৃতি পায়- তাহলেই মানুষ মানুষের প্রেমপ্রীতি-ভালবাসা সৃষ্টি হবে। সমাজে, জাতিতে বা রাষ্ট্রে চলে আসবে পরস্পরে সহিষ্ণুতা, সত্যবাদিতা, ন্যায় পরায়ণতা এবং মানুষের সবচেয়ে মূল্যবান গুণ নৈতিকতা। যার ফলে সমাজে, জাতিতে বা রাষ্ট্রে কোন প্রকার অশান্তি থাকবে না। প্রতিটি মানুষের সহাবস্থানের মাধ্যমে সমাজে, জাতিতে বা রাষ্ট্রে বিরাজ করবে শান্তির সুবাতাস।
আমাদের পাহাড়ি বৌদ্ধ সমাজে যুবক-যুবতীর অবৈধ সম্পর্ক, ধর্ষণ বা বলাৎকার ব্যাপারে সমাজ খুব কঠোর ছিল। গ্রামে বা মহল্লায় এরুপ অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে থাকলে তাদেরকে কঠোর গ্রাম্য বিচার বা শালিশের সম্মূখীন হতে হতো। এরুপ বিচার ব্যবস্থার কারণে পাহাড়ি মেয়েরা অনেক সুরক্ষিত থেকে নিরাপদে অবস্থান করতো। তাই বাঙালি মেয়েদের তুলনায় পাহাড়ি মেয়েরা একটু স্বাধীন চেতার অভ্যাস্ত হয়ে পড়েছে। কিন্ত বর্তমানে পারিপার্শ্বিকতা ও পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে সে স্বাধীন চেতার পরিহার করা উচিত এবং অভিভাবকদেরও এ বিয়য়ে সচেতন হওয়া অত্যন্ত জুরুরী। আগেকার দিনে পুরানা চাকমা জাতীয় বিচার ও সমাজবিধির সংক্ষিপ্ত বিবরন আলোচনা করা গেল:
১। কোন যুবক-যুবতী পরস্পর প্রনয়াবদ্ধ হয়ে পিতামাতা বা অবিভাবকগণের অজ্ঞাতের বা অসম্মতিতে পালিয়ে গেলে ঐ মিলন অবৈধ গণ্য হয়ে বিচারে উভয়ের অর্থদন্ড হয়। পুরুষ অপেক্ষা মেয়ের শাস্তি লঘুতর হলেও এই অপরাধ কারো ২৫ টাকার অধিক অর্থদন্ড হয় না। এতদ্বব্যতীত সামাজিক লোকেরা যুবক হতে ৪/৫ মুট শূকর ও যুবতী হতে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যের ১টা শূকর বা মোরগ প্রাপ্ত হয়। এর দ্বারা সামাজিক লোকেরা এক ভোজের আয়োজন করে থাকে।
২। কোন যুবক কোন যুবতীকে নানা উপায়ে ভূলিয়ে বা বল প্রয়োগে তার সম্মতি বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধরে নিয়ে যায়, তবে তজ্জন্য যুবতী বা স্ত্রীলোক তার মর্যাদা হানির জন্য যুবক হতে ক্ষতিপূরন স্বরুপ অনধিক ২৫ টাকা প্রাপ্য হয় এবং যুবকের উপর প্রায় ঐ পরিমাণ অর্থদন্ড হয়।
৩। এই বিষয়ের বিচার নিষ্পত্তির পর যুবকের পক্ষ হতে যুবতীর সঙ্গে যদি বিবাহ সম্বন্ধ স্থাপনের ইচ্ছা করে, তাহলে যুবতীর পিতা বা অবিভবাবকের অনম্মতিতে ইহা সম্ভব হয় না, কিন্তু উক্ত যুবক যদি অপ্রতিহত উপায়ে বারংবার ঐভাবে দন্ডিত হয়েও যুবতীর সম্মতিতে তৃতীয়বার তাকে নিয়ে পলায়নে সমর্থ হয় তবে ঐ স্থলে অভিভাবকের অসম্মতি বা কোন আপত্তি এর ঐ সম্বন্ধকে রোধ করতে পারবে না।
৪। অবৈধ প্রণয়ে পলাতক আসামীদরে বিরুদ্ধে “শূকর প্রদানের” প্রথা চাকমাদের ধামাই গোজা সম্প্রদায়ের মধ্যে অপরিহার্য নহে কারণ এই প্রথা তাহাদের মধ্যে পূর্বে ছিলনা এবং এখনও অধিকাংশ ক্ষেত্রে কেহ কদাচিৎ তাদের মধ্যে অপর গোজার সঙ্গে ঐরুপ জাতীয় বিচারের কারণ উপস্থিত হলে তাতে উভয় পক্ষ ঐ “শূকর প্রদান” প্রথা পালন করে।
৫। অশিক্ষিত ও সাধারণ চাকমা সমাজের মধ্যে এখনও বিবাহে পণ প্রথা প্রচলিত আছে যদিও শিক্ষিত এবং সম্ভ্রান্ত শ্রেণীর ব্যক্তিরা এই প্রথা গ্রহণ করে না। হিন্দু জাতিদের মধ্যে মেয়ে পক্ষের উপরই পণের দাবী করা হয় কিন্তু সাধারণ সম্প্রদায়ের মধ্যে পুরুষের পক্ষে এই দাবী করা হয়ে থাকে। এই পণ বা যৌতুক প্রথার নাম চাকমাদের মধ্যে “দাভা” নামে পরিচিত। এই দাভার কোন নির্দিষ্ট পরিমাণ নেই। নগদ টাকা বস্ত্রলংকার ও ভোজ্য দ্রবাদি যে কোন প্রকার দাবীতে কিংবা বিভিন্ন প্রকার দাবীতে এর পূরণ করা যেতে পারে। অবস্থা অনুযায়ী এর প্রকার ও পরিমাণ স্থল বিশেষে নির্ণয় হয়ে থাকে। সাধারণতঃ এর পরিমাণ উর্ধ্ব সংখ্যা ৫০০ (পাঁচ শতাধিক) টাকার অধিক অতিক্রম করে না।
৬। একই বংশের মধ্যে বিবাহ সম্বন্ধ চাকমা জাতীয় প্রথার বিরুদ্ধ, খুড়ী, মাসী, পিসি, জেটি ইত্যাদি মাতৃ স্থানীয় স্ত্রীলোক কিংবা কনিষ্ঠ ভ্রাতৃবধু, ভ্রাতৃ কন্যা, ভাগিনী ইত্যাদি স্ত্রীলোকের সাথে বিবাহ সম্বন্ধ সমাজ নিয়ম বিরুদ্ধ এবং নিষিদ্ধ প্রথারুপে চলে আসতেছে। কেহ ঐ প্রথা লঙ্ঘন করলে তাদেরকে শুধু গুরুতর অর্থদন্ড করা হয় তেমন নহে, যতদিন যাবৎ প্রবজ্যা ধর্ম গ্রহণ করে বাড়িতে মঙ্গলসূত্র শ্রবণ করতে হয় ইত্যাদি যথাবিধি দ্বারা প্রায়চিত্ত করে পরিশুদ্ধ না হবে ততদিন সে সমাজচ্যুত হয়ে থাকতে বাধ্য হবে। চাকমাদের সমাজে আচার ও ব্যবহারিক জীবনে এই প্রথা প্রচলিত রয়েছে যে কেহ ভ্রাতৃবধু, পুত্রবধু কিংবা ভাগিনার স্ত্রীকে স্পর্শও করতে পারবেনা।
৭। অবৈধ মিলন কিংবা ঐ প্রকারের ঘটনা দুই কিংবা ততোধিক মৌজাবাসীর মধ্যে সংঘটিত হলে সংশ্লিষ্ট মৌজার হেডম্যানরা মিলিতভাবে এর বিচার করবেন কিংবা এতে কোন অসুবিধার কারণ দেখা দিলে সার্কেল চীপ ঐ মোকর্দ্দমার বিচার করেন।
৮। কোন ব্যক্তি পর স্ত্রীর সঙ্গে অবৈধ প্রণয়বদ্ধ হলে, উভয়কে গুরুতর অর্থ দন্ডে দন্ডিত করা হয়। কিন্তু ঐরুপ ঘটনাজনিত স্ত্রীলোকটির স্বামী যদি তার স্ত্রীকে তালাক বা ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় তবে পুরুষ অপরাধীকে আদালতের বিবেচনা ও নির্দেশ মতে তাদের মধ্যে কৃত বিবাহ ব্যয়ের আংশিক ক্ষতিপূরণ বহনে বাধ্য করা হয় এবং এরুপ ঘটনার স্ত্রী স্বামী ত্যাগে বাধ্য হলেও (নিজ স্বামীর অবৈধ প্রণয়ের ফলে) সেই স্ত্রীলোক বিচ্ছেদ প্রাপ্ত স্বামী হতে কিছু ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকারী হয়।
৯। অবৈধভাবে পলাতক স্ত্রী পুরুষ আসামীদ্বয় ধৃত বা স্বেচ্ছায় আত্মপ্রকাশ করার পর তাদেরকে আংশিক বা সম্পুর্ন দায়ী প্রমাণ করতে স্ত্রীলোকটির সত্য যাচায়ের উপর অনেকটা নির্ভরশীল। এই জন্য উভয়পক্ষ স্ত্রী লোকটিকে নিজ হেফাজতে নিয়া রাখতে ইচ্ছা প্রকাশ করে। এজন্য মোকর্দ্দমা নিষ্পত্তিকাল যাবৎ কিংবা প্রয়োজনীয় কাল যাবৎ স্ত্রীলোকটি হেডম্যানের হেফাজতে তার গৃহে অবস্থান করার প্রথা রয়েছে।
১০। কোন কোন ক্ষেত্রে অবৈধ প্রণয়বদ্ধ যুবক যুবতী পলায়নে পর আত্ম প্রকাশ করলে ঐ অপরাধে নিয়মিত অর্থদন্ড স্বীকার করে উভয় পক্ষের সম্মতিতে যুবক যুবতী মধ্যে বিবাহ সম্বন্ধ সাব্যস্থ হওয়ার পর পণের টাকা আদায় হওয়ার পূর্বে বিবাহ কার্য সম্পন্ন হয়ে গেলেও নির্দিষ্ট দিনে যুবকের পক্ষে পণের টাকা আদায়ের অসমর্থ হওয়ার দরুন বিবাহ অসিদ্ধ সাব্যস্থ হলে তজ্জন্য যুবককে দায়ী করে মেয়ের অভিভাবক অবস্থানুযায়ী ক্ষতিপূরণাদিও পেয়ে থাকে।
১১। কোন মোকর্দ্দমা বিচারের জন্য যদি মৌজার বিভিন্ন স্থানের বিশিষ্ট লোকগণের সমাবেশে সালিশী ধরনের বিচার করতে হয়, তবে অপরাধীকে অপরাধের দন্ডের অতিরিক্ত ৭ টাকা ব্যয় করতে হয়। ঐ মোকদ্দর্মায় উপস্থিত লোকজনের পান ও তামাকের জন্য ঐ টাকা ব্যয় করা হয়। এটিকে “খোয়া ভাঙনী” খরচ বলা হয়।
১২। যে কোন বিবাহ জাতীয় প্রথানুযায়ী “চুঙলাংপূজা” নামক বিবাহ পূজা অনুষ্ঠানক্রমে সম্পন্ন না হলে ঐ বিবাহ অসিদ্ধ বলে গণ্য হয়ে থাকে। এরুপ লোকের মৃত্যু হলে হাঁটুর নীচে করে শব বহন করার রীতি রয়েছে। তবে ঐ সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অপরাধের জন্য ভোজ্যানুষ্ঠানের মাধ্যমে সামাজিক লোককে তুষ্ট করতে পারলে তার ঐ অপরাধজনিত ক্রুটির জন্য আর কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
১৩। কোন কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ হলে এর “সুর কাগজ বা ডির্ভোস লেটার” নামক চুক্তিপত্র সম্পাদন করতে হয়। অন্যথা ঐ বিচ্ছেদ বলবৎ বা সিদ্ধ বলে গন্য করা হয় না। ঐ “সুর কাগজ” স্বামী-স্ত্রী উভয়েই সম্পাদন করে পরস্পরকে দিতে হয়। (চাকমা জাতি (জাতীয় চিত্র ও ইতিবুত্ত)- সতীশ চন্দ্র ঘোষ, ১৩১৬ বাংলা, ১-৬ পৃষ্ঠা, )।
ষষ্ঠ অপরিহানীয় ধর্ম: বর্জ্জিগণ বর্জ্জিদেশের অভ্যন্তরে ও বর্হিভাগে বর্জ্জিদের প্রতিষ্ঠিত যত চৈত্য আছে, সে গুলো পূজার্চ্চানাদি দ্বারা সম্মান প্রর্দশন করে এবং তাঁদের প্রাপ্য রাজস্বাদি আত্মসাৎ না করে।
বর্জ্জিগণ তাঁদের স্বীয় নগরে ও বর্হিনগরে বর্জ্জীদের যে সমন্ত চৈত্য আছে তৎসমুদয় সৎকার গৌরব, সম্মান, পূজা যথাবিহিত ভাবে পূজা করে থাকেন এবং পূর্বে যে সমস্ত রাজস্ব দেশ সেবার্থে প্রদত্ত তা ফেরত নেয় না ও পূর্বকৃত ধর্ম্মত পূজার পরিহানি করে না।
বুদ্ধের সময়ে ভারতে অনেক রাজা-মহারাজা, ধনাঢ্য ও উদার ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিবর্গের বদান্যতায় বহু বিহার ও চৈত্য নির্মাণ করে বুদ্ধ প্রমূখ ভিক্ষুসংঘকে দান দিয়ে এগুলো যথারীতি রক্ষাণাবেক্ষণসহ পূজা সৎকার করে ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের সুব্যবস্থা করেছিলেন। শাক্যমুনি গৌতম বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পর তাঁর দেহাবশেষ গুলো রাজা অজাতশক্র, লিচ্ছবি, শাক্য, কোলিয়, মল্ল, বেদদ্বীপের ব্রাহ্মণগণ ও দ্রোণ ব্রাহ্মণ ভাগ করে নিয়ে স্বীয় স্বীয় রাজ্যে নিয়ে গিয়ে এর উপর চৈত্য নির্মাণকরে সংরক্ষণ, সৎকার ও পূজার ব্যবস্থা করেছিলেন (মহাপরিনিব্বান সুত্তং, রাজগুরু র্ধমরতœ মহাস্থবির, ১৯৪১ খৃষ্টাব্দ, পৃষ্ঠা- ১৭০, ১৭১)। এমনকি বুদ্ধ শিষ্য আনন্দ, মৌদ্গল্যায়ন, সারিপুত্র প্রমূখ শ্রাবক-মহাশ্রাবকদের দেহাবশেষের উপর স্তুপ নির্মাণ করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় স¤্রাট অশোক, কনিস্ক, পাল, দেব, খড়গ, চন্দ্রবংশীয় ইত্যাদি রাজা-মহারাজারা বুদ্ধ ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধান্বিত হয়ে বহু বিহার, চৈত্য, স্তুপ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে বুদ্ধধর্ম প্রচারে অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু এ সমস্ত স্থাপনা গুলো কালের গর্ভে বিলিন হয়ে গেলেও ঐতিহাসিক পুরাতত্ত্ব স্থান হিসেবে সংরক্ষণ করে দেশী-বিদেশীদের অমূল্য স্থাপনা গুলো পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। শুধু তাই নয় বৌদ্ধদের নিকট এই সব স্থাপনা গুলোর মধ্যে চারি মহাতীর্থস্থান গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সে সব স্থাপনা গুলো বুদ্ধগয়া (যে স্থানে ছয় বছর কঠোর সাধনা করে বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন), সারানাথ (যে স্থানে বুদ্ধত্ব লাভ করার পর পঞ্চবর্গীয় শিষ্যের নিকট ধম্মচক্র প্রর্বতন সুত্র দেশনা করেছিলেন), কুশীনগর (যে স্থানে দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর ধর্ম দেশনা করার পর মহাপরির্নিবাণ লাভ করেছিলেন), লুম্বিনী (যে স্থানে তথাগত বুদ্ধ ভূমিষ্ট হয়েছিলেন) এবং ভগবান বুদ্ধ স্মৃতিবিজরিত স্থাপনা গুলো বৌদ্ধরা তর্থীস্থান হিসেবে মনে করে প্রতি বছর বিভিন্ন বৌদ্ধ দেশ থেকে হাজার হাজার টাকা খরচ করে তীর্থদর্শনের জন্য ভারতে গমন করে থাকেন।
কিন্তু আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে এক শ্রেণী অন্ধ ভক্ত রয়েছে তারা বুদ্ধে নীতি ধর্মের কোন তোয়াক্তা না করে পূর্বে প্রতিষ্টিত বৌদ্ধ বিহারকে ঐতিহাসিকত্ব ও পরিত্রতার গুরুত্ব না দিয়ে নাম পরিবর্তন করে অন্য নামে নামকরণ করে সেই ঐতিহাসিকত্ব বিলুপ্ত করা হচ্ছে। একটা কথা আছে “অতীতের ইতিহাস ভবিষ্যৎ চলার পথ সুগম করে থাকে”। সেই ঐতিহাসিকত্ব গুরুত্ব না দিয়ে জাতি, সমাজের ইতিহাস ঐতিহ্যকে বিলুপ্ত করা হচ্ছে। এমনও অভিযোগ পাওয়া গেছে যে, অনেক পবিত্র বুদ্ধমূর্তি গুলো পার্বত্য বুদ্ধমুর্তি ও অপবিত্র আখ্যা দিয়ে পরিত্যক্ত জায়গায় ফেলে রাখা হয়েছে যা অত্যন্ত অযতœ, অবহেলায় এবং এ সমস্ত স্থান গোচরণ ভূমি বানানো হয়েছে। এভাবে বিভিন্ন মতাবাদ, মতাদর্শ প্রর্বতন করে জুম্ম বৌদ্ধ সমাজকে নানা ভাবে বিভাজন করে রাখা হয়েছে। যা একজন বৌদ্ধ হিসেবে মেনে নিতে খুবই কষ্ঠ হয়। যার ফলে আমাদের জুম্ম বৌদ্ধরা সমাজ নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে নির্দয়, নিষ্টুর জঘন্য ভাতৃত্ব সংঘাতে লিপ্ত হয়ে নানা দুঃখ, দুর্দশা, উপদ্রব সৃষ্টি করা হয়েছে। ভ্রাতৃঘাতী নির্দয় নিষ্টুর সংঘাতে অকাতরে তর-তাজা প্রাণ ঝড়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন? তাই আমাদের উচিত সপ্ত অপরিহানীয় ধর্মে প্রতিষ্ঠিত থেকে এরুপ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যে সমস্ত পার্বত্য বৌদ্ধ বিহার বনবিহার নামে পরিবর্তন করা হয়েছে তার একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা দেয়া হল:
রাঙ্গামাটি সদর উপজেলা: ১) গোলাছড়ি জনকল্যাণ বৌদ্ধ বিহার, বর্তমান জুম্ম স্মৃতি বন বিহার, ২) কাইন্দা নালন্দা বৌদ্ধ বিহার, বর্তমান কাইন্দা বন বিহার, ৩) ধুতাঙ্গ বৌদ্ধ বিহার, বর্তমান ধুতাঙ্গ বন বিহার। বরকল উপজেলা: ১) ভূষণছড়া জনকল্যাণ বৌদ্ধ বিহার পরিবর্তে ভূষণছড়া ত্যাগেই সুখ বন বিহার, ২) মিটিঙ্গাছড়ি বৌদ্ধ বিহার পরিবর্তে সুবলং শ্রাবস্তী বন বিহার করা হয়েছে। নানিয়াচর উপজেলা: ১) পতিখালি ফলবন বৌদ্ধ বিহার, বর্তমান পতিখালি বন বিহার, ২) গরখেদ চিত্তারাম বৌদ্ধ বিহার, বর্তমান গরখেদ বন বিহার। বাঘাইছড়ি উপজেলা: ১) নলবনিয়া সংঘ শক্তি বৌদ্ধ বিহারের পরিবর্তে নলবনিয়া নালন্দা বন বিহার করা হয়েছে। পানছড়ি উপজেলা: ১) দেবগিরি বৌদ্ধবিহার, বর্তমানে দেবগিরি বনবিহার, ২) বিনয়পুর অরণ্য কুটির বৌদ্ধ বিহারের বর্তমানে প্রজ্ঞা সাধনা বনবিহার, ৩) উদয় গিরি বৌদ্ধ বিহার বর্তমানে-হারুবিল বন বিহার।
সপ্তম অপরিহানীয় ধর্ম: বর্জ্জিগণ যেন বর্জ্জি রাজ্যে অর্হৎদের রক্ষণাবেক্ষণ ও ভরণ পোষণের সুব্যবস্থা করে যাতে তদ্দেশাস্থিত অর্হৎতেরা নিবিঘেœ ও শাস্তিতে বসবাস করতে পারে এবং ভিন্ন দেশের অর্হৎতেরা ও তাঁদের রাজ্য আগমণ করে শাস্তিতে বাস করতে পারে।
সিগালবাদ সূত্রে বুদ্ধ বলেছিলেন যে, ভক্তিপূর্ণ চিত্তে শ্রামণ ভিক্ষুদের সেবা শুশ্রƒষা করা, তাঁদের পূজা করা, ধর্মশ্রবণ করা, ইহলোকে আর্য শিষ্যগণ ভিক্ষুসংঘকে চীবর দিয়ে সেবা করা, আহার্য ও ঔষধ পথ্যাদি দিয়ে সেবা করা এই চারটি বিষয়কে আমি গৃহীদের স্বর্গ ও যশলাভের পন্থা বলছি। (সদ্ধর্ম নীতি মঞ্জুরী, ড. জিন বোধি ভিক্ষু, প্রাগুক্ত)। বৌদ্ধ ধর্মে শীলবান, সংসারত্যাগী, কল্যাণমিত্র ধর্মচার্যদের উদ্দেশ্য সংঘদান, অষ্টপরিস্কার দান ও কঠিন চীবর দান দেওয়ার রীতি রয়েছে। মহাউপসিকা বিশাখা বুদ্ধের কাছে ভিক্ষুদের জন্য ৮টি বর প্রার্থনা করেছিলেন। তথাগত বুদ্ধ ভিক্ষুসংঘের শ্রীবৃদ্ধি এবং বুদ্ধ শাসনের সমৃদ্ধির কথা চিন্তা করে তা অনুমোদন করেছিলেন। সে গুলো হল: ১) ভিক্ষু সংঘকে আজীবন ¯œানবস্ত্র প্রদান বা বর্ষাচীবর দান, ২) আগস্তুক ভিক্ষুকে আহার্যদান, ৩) গমনকারী ভিক্ষুকে সাহায্য দান, ৪) রুগ্ন ভিক্ষুকে আহার্য দান, ৫) রোগীর পরিচায়ককে আহার্য দান, ৬) রোগী ভিক্ষুকে ভৈষজ্য দান, ৭) নিত্য জবাগু প্রদান এবং ৮) ভিক্ষুনী সংঘকে আহার্য দান (ত্রিপিটক, সুর্দশন বড়–য়া, ১৯৯৯ইং, পৃষ্ঠা- ১২১)। মহাউপাসিকা বিশাখার এ মহান আদর্শ সর্বস্তরের মানুষ মনে প্রাণে গ্রহণ করে বাস্তবে রুপদান করলে সমাজ ও সদ্ধর্মের মহাউপকার হবে এতে কোন সন্দেহ নেই। এছাড়া তৎকালীন রাজা, শ্রেষ্ঠী ও শ্রদ্ধাবান উপাসক-উপাসিকাগণ বুদ্ধ প্রমূখ ভিক্ষু সংঘের জন্য বিহার নির্মাণ ও তাঁদের যাবতীয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করতেন।
ভিক্ষুত্ব ধর্ম পালনের সহায়স্বরুপ শয়নাসন, চীবর, আহার ও ঔষধ-পথ্যাদি বৌদ্ধ শাসনের চিরস্থিতি কামনা করে প্রিয়শীল, শিক্ষাকামী ও শীলবান ভিক্ষু-শ্রমণদের শ্রদ্ধার সাথে দান করবেন। নিজের সামর্থ্য না থাকলেও অপরে দ্বারা দান করাতে হবে। ন্যুনতম দিনে একবার হলেও ভিক্ষুর নিকট উপস্থিত হয়ে তাঁদের সুখ-দুঃখ ও সুবিধা-অসুবিধার জিজ্ঞাসা করতে হবে। কোন বস্তুর অভাব হলে সে গুলো নিজে বা অন্যে নিকট হতে সংগ্রহ করে দিতে হবে। প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে ভিক্ষুদের “ভন্তে” ব্যতীত “ঠাকুর বলবেন না। ভিক্ষুদের প্রতি “ঠাকুর” শব্দটা ব্যবহার করাটা সদ্ধর্মে অশিক্ষিত ও অশ্রদ্ধাবানের পরিচায়ক। আত্মত্যাগী বৌদ্ধ ভিক্ষু-সংঘকে যথোচিত শ্রদ্ধা, পূজা ও সম্মাণ করা উচিত। আমরা কিছু সংখ্যক পাহাড়ি বৌদ্ধরা এসবের তোয়াক্কা না প্রতিনিয়ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্মীয় গুরুদের সমালোচনা, দুর্নাম করেই যাচ্ছি অর্থকভাবে। শুধু এখানেই থেমে নেই ধর্মের আশ্রয় নেয়া গৈরিক বসনধারীদের রং কাপড় খুলে টেনে হিজড়ে নিয়ে হত্যার মতো জগন্য ঘটনা পর্যন্ত সংগঠিত হওয়া পরিলক্ষিত হয়েছে। এরুপ ঘটনা যা বৌদ্ধ ধর্মকে কলঙ্কিত করা হয়েছে। এমনিতেই অভিযোগ রয়েছে যে, “অতীতে অর্হৎ ভিক্ষু হত্যার কারণে জুম্মজাতির এমন দুর্দশা”। তাই আমাদের সজাগ থাকতে হবে যাতে আমাদের দ্বারাই এমন কোন হীনকর্ম সংগঠিত না হয় যে কর্মের দ¦ারাই জাতি, ধর্ম ও সমাজে ক্ষতি হয়। ধর্মের যেন পরিহানি না হয়, অশ্রদ্ধা উৎপন্ন না হয়, অগৌবর প্রর্দশন করা না হয়।
বিমুক্ত মহাপুরুষ অর্হৎ এবং অবিদ্যা-তৃষ্ণার নিরবশেষ নিবৃত্তিতে নিবিষ্ট শীলবানদের সান্নিধ্য লাভ খুবই প্রীতিদায়ক ও সদ্ধর্মানন্দময় অনুভূতি সঞ্চারক। এরুপ পূন্যপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধাচিত্তে দান দেওয়া তাঁদের জন্য প্রয়োজনীয় সুব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং এতোদৃশ গুণীদের এলাকায় শুভাগমনের লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেওয়া ও তাঁদের নিরাপদ অবস্থান নিশ্চিতকরণে ব্যক্তি ও সমাজের অশেষ পূন্য কর্ম সম্পাদিত হয়। এহেন কৃত সুকর্মের ফল্গুধারায় ব্যক্তি ও সমাজ ঐশ্বমন্ডিত ও নিরুবিঘœ থাকে। কাঁদায় শাপলার জন্ম হয়ে পানির উপর বিশুদ্ধ থেকে অবস্থান করতঃ পুকুরের শোভা বর্ধন করে। আত্মত্যাগী এবং গৈরিক বসনধারী ভিক্ষুগণকে তদ্রুপ সমাজে অবস্থান করে বিশুদ্ধ অবস্থায় সমাজের বা জাতির কল্যাণ কর্ম করতে হবে। তাই এই আদর্শে যাঁরা বৌদ্ধ ভিক্ষু আছেন, তাঁরা সামর্থ্য অনুসারে জাতির জন্য আত্মনিবেদিত প্রাণ হয়ে কল্যাণ কর্ম করে যাচ্ছেন। তবে সমাজের জন্য যা করা হচ্ছে তা প্রয়োজনীয় তুলনায় অপ্রতুল। আরো একটু এগ্রেসিভ হয়ে সমাজ, ধর্ম ও জাতির মঙ্গলার্থে কাজ করতে হবে। কিস্তু দুঃখের বিষয় আমাদের সমাজে কিছু সংখ্যক ভিক্ষু রয়েছেন নরকের ভয় দেখিয়ে, স¦র্গে সুখে প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ আদায় করে নিজের আরাম-আয়াসে, সুঃখ-স্বাচ্ছন্দ্যে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত রয়েছেন। ধর্মকে অধর্ম অধর্মকে ধর্ম বলে প্রচার করে ধর্মকে তথা সমাজকে বিপথে পরিচালিত করে বর্তমান জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগের জ্ঞানের আলো হতে দুরে ছড়িয়ে দিয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন জগতে ঠেলে দিচ্ছে যা কখনও কামন্য নয়। এভাবে সমাজকে অন্ধত্ব করে রাখা হচ্ছে দিনের পর দিন। এর ফলে আমাদের জুম্ম বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও নানা মতবাদ, নানা মতভেদে বন-পার্বত্য-উচলা-নন্দপাল-প্রজ্ঞালংকার ইত্যাদি নিকায়ে বা মতবাদে বিভক্ত হয়ে আজ ক্ষতবিক্ষত। পাশাপাশি দায়কেরাও বন-পার্বত্য-উচলা ইত্যাদি ভক্তে বিভক্ত। আমাদের এ বিষয় গুলো হতে বেরিয়ে আসতে হবে। কারণ বৌদ্ধ ধর্ম মিথ্যা দৃষ্টি ধর্ম নয়, এটি সম্যক দৃষ্টি ধর্ম। সম্যক ভাবে উপলদ্ধি করে, হৃদয়ঙ্গম করে বাস্তব কর্মক্ষেত্রে কায়-মন-বাক্যে প্রয়োগ করতে হবে। তবেই সমাজে, ধর্মে ও জাতিতে শাস্তি আনয়ন করতে পাবরো। নচেৎ নয়।
পরিশেষে বলবো অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজের হিংসা, বিদ্বেষ, হানা-হানি, মারা-মারি ভুলে গিয়ে ও হীন স্বার্থ পরিত্যাগ করে, অর্থ লোভে নিজেকে বিক্রি না করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জুম্ম জাতি মুক্তির জন্য সংগ্রাম করতে হবে, আন্দোলন করতে হবে। তবে একটি কথা বলা প্রয়োজন আমাদের সমাজে বা জাতিতে কুচক্রী বর্ষাকর নামক ব্রাহ্মণ অগাধে বিচরণ রয়েছে। আমাদের সেই সমস্ত বর্ষাকর ব্রাহ্মণকে চিহ্নিত করে তাদেরকে বর্জন করে চলতে হবে। তাদের কাছ থেকে দুরে গিয়ে সর্তকভাবে অবস্থান করতে হবে। তারা যাতে সমাজে বা জাতিতে বা ধর্মে কোন ক্ষতি কনতে না পারে সেদিকে তীক্ষè নজর রাখতে হবে। আমার এ লেখাগুলো কোন পক্ষপাতিত্ব অবলম্বন বা সমর্থন করে লেখার চেষ্টা করেনি। বর্তমান পরিস্থিতিকে উপলদ্ধি করে বাস্তব সত্যটুকু উৎঘাতন করার চেষ্টা করেছি মাত্র। এ লেখা অপ্রিয় সত্য হলেও সুন্দর মন মানসিকতা নিয়ে মনোনিবেশ পূর্বক চিন্তা করে দেখবেন। এতে যদি জুম্ম জাতির সামান্যতম উপকার সাধন করতে পারি, তাহলে আমার এ শ্রম স্বার্থক হবে। বুদ্ধও নিজের জ্ঞাতি শাক্যবংশের বাঁচানোর জন্য ছায়া বিহীন বৃক্ষতলার উপবেশন করে অবস্থান করেছিলেন। তদ্রুপ আমারও এরুপ প্রচেষ্ঠা মাত্র। এতে যদি আমার ভুলত্রুুতি হয়ে থাকে বা আমার অজানায় কারও মনে দুঃখ-কষ্ট দিয়ে থাকি তাহলে আমাকে ক্ষমা সুন্দর মন মানসিকতা নিয়ে দেখবেন।
লেখক পরিচিতি: সাধনাজ্যোতি ভিক্ষু, বি, এ (অনার্স) এম, এ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, এম, এড দারুল আহসান বিশ্ববিদ্যালয়, অধ্যক্ষ হিল চাদিগাং বৌদ্ধ বিহার, প্রধান এডমিন, হিল চাদিগাং ডটকম পেইজ।
No comments
Post a Comment