পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধধর্ম ও একবিংশ শতকের চ্যালেঞ্জ

ড.অমর কান্তি চাকমা
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে একমাত্র বৃহৎ পাহাড়ি অঞ্চল। এর দক্ষিণ পূর্ব সীমান্তে মায়ানমার, উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, পূর্বে মিজোরাম এবং পশ্চিমে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলা অবস্থিত। পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের মোট আয়তনের প্রায় এক দশমাংশ। ১৮৬০ খ্রীস্টাব্দে পার্বত্য এলাকাকে চট্টগ্রাম জেলা থেকে আলাদা করে একটা স্বতন্ত্র জেলার মর্যাদা দেয়া হয়। ১৯০০ খ্রীস্টাব্দে  পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য পৃথক শাসন ব্যবস্থা প্রচলন করা হয়। তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামকে তিনটি সার্কেলে ভাগ করে, এর মধ্যে বান্দরবান জেলা ও রাঙ্গামাটির কিছু অংশ নিয়ে বোমাং সার্কেল, খাগড়াছড়ি জেলাকে নিয়ে মং সার্কেল এবং রাঙ্গামাটির বেশির ভাগ এলাকা নিয়ে চাকমা সার্কেল গঠিত হয়। সার্কেল চিফরা রাজা হিসেবে পরিচিত। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রধান নদী সাতটি- চেঙ্গী, মায়ানী, কাসালং, কর্ণফুলি, রাইনখিয়াং, সাঙ্গু ও মাতামুহুরি। ১৯৬০ খ্রীস্টব্দে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কাপ্তাইয়ে কর্ণফুলির নদীতে বাঁধ দিয়ে একটি কৃত্রিম হৃদ তৈরী করা হয়। এ হৃদের জলে ডুবে যায় পুরনো রাঙ্গামাটি, উদ্বাস্তু হয় লক্ষাধিক আদিবাসী জনগোষ্ঠী। তখন উদ্বাস্তু হয়ে চাকমাদের একটা অংশ যাঁরা ভারতের অরুণাচল প্রদেশে আশ্রয় নিয়েছেন তাঁরা এখনো পর্যন্ত নাগরিকত্ব পাননি।
পার্বত্য চট্টগ্রামকে তিনটি জেলায় বিভক্ত করা হয়েছে- খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা, রাঙ্গামটি পার্বত্য জেলা ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা। এই তিনটি জেলার অধীনে মোট ২৫টি থানা রয়েছে। এখানে দশ ভাষাভাষী তেরোটি আদিবাসী জনগোষ্ঠী স্মরণাতীতকাল থেকে বসবাস করে আসছে। আদিবাসী এ জনগোষ্ঠী খুব সহজ-সরল, জীবন-যাপনে অভ্যস্ত । তাঁরা তাঁদের প্রচলিত নিজস্ব প্রথানুসারে সমাজ ব্যবস্থা পরিচালনা করেন। জুম চাষ হল তাঁদের আদি পেশা। আজকাল প্রচলিত কৃষিজ পদ্ধতিতেও চাষাবাদ করা হয়। পাহাড় পুড়িয়ে তাগল বা দা দিয়ে গর্ত খুঁড়ে একই গর্তে বোনা হয় ধান, কার্পাস, ভুট্টা,শসা, প্রভৃতির বীজ।  সমতল ভূমিতে উৎপাদন করা হয় ধান, সরষে, তামাক, মরিচ, বেগুন প্রভৃতি। কৃষিকাজ ছিল এখানকার মানুষের প্রধান জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম। দিন বদলের সাথে সাথেই আধুনিকতার ছোঁয়ায় মানুষের পেশা, জীবন-জীবিকা, চাল-চলন, হাব-ভাব এখন অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়েছে। তারপরও  অন্যান্য সম্প্রদায় থেকে এই অঞ্চলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বৈচিত্রময় জীবনধারা, বর্ণাঢ্য সংস্কৃতি, পৃথক সমাজ ব্যবস্থা, প্রকৃতিজ কিছু রীতি-নীতির কারণে বাংলাদেশের সংস্কৃতি- ঐতিহ্যকে এক উচ্চমান ও বহুমাত্রায় সম্বৃদ্ধ করেছে। প্রাকৃতিক নৈসর্গিক সৌন্দর্য, সম্ভাবনাময় প্রচুর বনজসম্পদ, খনিজসম্পদ ও ভৌগলিক সীমা রেখার কারণে আবহমানকাল থেকেই এ অঞ্চলের প্রতি সকল জনগোষ্ঠীর নিকট এক লোভতুর দৃষ্টি ছিল। একারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে বহু আগ থেকেই আগ্রাসন ও  অভিবাসন শুরু হয়। ফলে এখানে বসবাসরত আদিবাসীদের উপর কালে কালে বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠীর ধারাবাহিক হত্যা, নির্যাতন, শোষণ, উৎখাত,ধর্ষণ, বঞ্চনাজনিত মানবাধিকার লংঘনে জর্জড়িত হয়ে বহুমাত্রিক সমস্যার জন্ম দিয়েছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ ছাড়াও এই সমস্যার রয়েছে ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক দিক এগুলো একটার সাথে আরেকটা অঙ্গাঙ্গীভাবে নিবিড়ভাবে জড়িত। ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে শাসকগোষ্ঠীরা এই সমস্যা সৃষ্টি করেছে। ফলে এ অঞ্চলে যারা মূল অধিবাসী  তারা  ক্রমে সংখ্যালঘুতে পরিণত হচ্ছে, চরম অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। আত্ম কলহ-বিবাদে জড়িয়ে এই সংকট আরো ঘণীভূত হয় । এত প্রতিকুল পরিবেশের মধ্যেও এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা থেমে নেই, বাঁচার তাগিদে বুকভরা আশা-আকাক্সক্ষা ও স্বপ্ন নিয়ে বহু বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে, সর্বত্রই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পাল্লা দিয়ে আগের তুলনায় শিক্ষা-দীক্ষায় এখন তাঁরা অনেক  অগ্রসর। আদিবাসীরা দেশ মাতৃকার টানে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে প্রতিটি স্বাধীকার আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ এবং স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় সর্বক্ষেত্রে অবদান রাখার মাধ্যমে তাঁরা এদেশের প্রতি গভীর মমত্ববোধের পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত তেরোটি আদিবাসী জনগোষ্ঠী বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী হলেও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা হলেন সংখ্যার দিক দিয়ে বেশি।  বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্ম কিভাবে বিকাশ ঘটে এবং তারই ধারাবাহিক পরম্পরায় পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধধর্ম এখন কোন অবস্থায় আছে তা নিয়ে সংক্ষিপ্তাকারে আলোচনা করাই হল আমার এই নিবন্ধের অবতারণা ।   
বাংলাদেশের বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস অতি প্রাচীন। বুদ্ধের জীবদ্দশাতেই বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মত অবিভক্ত চট্টগ্রামে (চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম) বৌদ্ধধর্মের আলোক রশ্মি বিচ্ছুরিত হয়েছিল বলে ঐতিহাসিকরা মনে করে থাকেন । বৌদ্ধধর্মের ঢেউ এসে যখন বাংলাদেশকে প্লাবিত করে তখন থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসের গোড়াপত্তন হয়। ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসকে প্রধানত তিনটি অধ্যায়ে বিভক্ত করা যায়। প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিকযুগ। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের বৌদ্ধধর্ম নানা বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে বিস্তার লাভ করলেও কোনো কোনো সময় ধারাবাহিকভাবে এর অগ্রগতি অব্যাহত ছিল। বৌদ্ধ সাহিত্য পাঠে জানা যায় বুদ্ধ পুন্ড্রবর্ধন, সেতকনগর ও কজঙ্গল পরিভ্রমণ করেছিলেন। উল্লেখ্য বুদ্ধের সময়ের বাংলার সীমারেখা আর বর্তমান সময়ের বাংলার সীমানা এক ছিল না। কারণ সে সময় বঙ্গ ছিল  বৃহŤবঙ্গের অধীনে। বুদ্ধের সময়ে ষোলটি মহাজনপদের অন্যতম জনপদ ছিল অঙ্গ। বঙ্গ ছিল অঙ্গ-এর অন্তর্ভুক্ত। দিব্যাবদান গ্রন্থমতে-‘সুমাগাধার আমন্ত্রণে ভগবান বুদ্ধ পাঁচশত শিষ্যসহ পুন্ড্রবর্ধনে এসেছিলেন। বুদ্ধের সময় বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচারিত হলেও স¤্রাট অশোকের সময় তা ব্যাপক আকারে বিস্তার লাভ করে।  প্রখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ ও ফাহিয়েনের ভ্রমণ কাহিনীতেও বাংলাদেশে প্রাচীন বৌদ্ধধর্মের পরিচয় পাওয়া যায়।
প্রাচীনযুগে হর্যঙ্কবংশ-শিশুনাগবংশ-মৌর্যবংশ-শুঙ্গবংশ-কুষাণবংশ ও গুপ্তবংশ রাজাদের শাসনাধীনে বৌদ্ধধর্ম স্বাভাবিক গতিতে বিকশিত হয়েছিল। হর্যঙ্কবংশের রাজা  অজাতশত্রুর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হল তাঁর রাজত্বকালে রাজগৃহের বেভার পর্বতের সপ্তপর্ণীগুহায় প্রথম বৌদ্ধ সঙ্গীতির আয়োজন। শিশুনাগবংশের রাজা কালাশোকের রাজত্বকালে বৈশালীতে দ্বিতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এটা তাঁর জীবনে বৌদ্ধধর্মের জন্য শ্রেষ্ঠ কীর্তি।
মৌর্যবংশের শ্রেষ্ঠ সম্রাট অশোক ছিলেন বৌদ্ধধর্মে একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক। তাঁর ঐকান্তিক পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন দেশে বৌদ্ধধর্ম প্রভূত বিস্তার লাভ করে। তিনি সারা ভারতে চুরাশি হাজার চৈত্য নির্মাণ করেছিলেন। তন্মধ্যে একটি ছিল বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অদূরে ধামরাইতে। স¤্রাট অশোকের রাজত্বকালে পাটলীপুত্রে তৃতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তৃতীয় সঙ্গীতির অব্যবহিত পরেই স¤্রাট অশোক বিভিন্ন জায়গায় বৌদ্ধধর্ম প্রচারক বাহিনী প্রেরণ করেছিলেন। তাঁর এই প্রচারক বাহিনীই মূলত বৌদ্ধধর্মকে বিশ^ধর্ম হিসেবে পরিণত করে।
মৌর্যবংশের শেষ সম্রাট বৃহদ্রথকে হত্যা করে পুষ্যমিত্র  মগধের সিংহাসন আরোহণ করে শুঙ্গবংশের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। পুষ্যমিত্র ছিলেন ব্রাহ্মণ্যধর্মের পৃষ্ঠপোষক। তিনি ছিলেন বৌদ্ধধর্মের ঘোর বিরোধী। তাঁর শাসনকালে বৌদ্ধধর্মের উপর এক বিরাট বিপর্যয় নেমে আসে। শুঙ্গবংশের রাজত্বের শেষ দিকে ভারতের উত্তর পশ্চিম গিরিপথ দিয়ে একের পর এক বিদেশী গ্রীক,শক, পহল্লব ও কুষাণগণ ভারতে প্রবেশ করে। তাঁরা গান্ধার, সাকল ও অন্যান্য স্থানে শক্তিশালী রাজ্য স্থাপন করে।
শুঙ্গবংশের সময় বৌদ্ধধর্মের চলমান অগ্রগতি কিছুটা হোঁচট খেলেও কুষাণ বংশের শ্রেষ্ঠ সম্রাট কনিষ্কের শাসনামলে তা আবারো স্বাভাবিক গতি ফিরে পায়। স¤্রাট অশোকের পর সম্রাট কনিষ্ক ছিলেন আরো এক নিষ্ঠাবান বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক। তাঁর শাসনামলে বৌদ্ধধর্ম স্বগৌরবে বিকশিত হয়েছিল। জালন্দরে চতুর্থ বৌদ্ধ সঙ্গীতি আয়োজন তাঁর জীবনে অমর কীর্তি। সম্রাট কনিষ্কের সময়ে হীনযান ও মহাযান নামে বৌদ্ধধর্ম প্রধান দুটি ধারায় বিভক্ত হয়। মহাযান বৌদ্ধধর্ম বিস্তারের ক্ষেত্রে স¤্রাট কনিষ্কের অবদান ছিল অতুলনীয়। তাঁর শাসনামলেই মহাযান বৌদ্ধধর্মের ব্যাপক প্রভাব বাংলাদেশেও এসে পড়ে এবং অবিভক্ত চট্টগ্রামে তা প্লাবিত হয়। স¤্রাট কনিষ্কের পর গুপ্ত রাজারা এদেশ শাসন করেন। গুপ্ত রাজারা বৌদ্ধধর্মের অনুসারী না হলেও তাঁদের সময় শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার ক্ষেত্রে বৌদ্ধধর্মের অগ্রগতি অব্যাহত ছিল। গুপ্ত রাজারা ব্রাহ্মণ্যধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তখন বৌদ্ধধর্ম রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হারায়। তবুও সংখ্যাগরিষ্ট বৌদ্ধরা তাঁদের অগ্রগতির ধারা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল।
গুপ্তযুগের পর হর্ষবর্ধন বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। তাঁর সাথে রাজা শশাংকের চরম রাজনৈতিক বিরোধের কারণে শশাংক বৌদ্ধধর্ম বিরোধী হয়ে উঠেন বলে পন্ডিতেরা মনে করে থাকেন। হর্ষবর্ধন (৬০৬-৬৪৭) অশোকের মত পরধর্ম সহিঞ্চু ছিলেন। এ সময়ে প্রখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ, তাওলিন, সেঙচি, ইৎচিং বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং তাঁদের ভ্রমণ বৃত্তান্তে বৌদ্ধধর্মের প্রামাণিক বিবরণ রেখে গেছেন। এ যুগেই পন্ডিত শীলভদ্র ও চন্দ্রগোমিন জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। হিউয়েন সাঙ রাজা শশাংকের বৌদ্ধধর্ম বিরোধী কার্যকলাপের বর্ণনা দিয়েছিলেন। রাজা শশাংকের সহায়তায় হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদী গোষ্ঠী বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ, বিহার, চৈত্য, স্তূপগুলি ধ্বংস করতে থাকেন এবং বৌদ্ধ ভিক্ষু ও বৌদ্ধদেরকে নানা নির্যাতনের দ্বারা হিন্দুধর্মে দীক্ষিত করতে শুরু করেন।
শশাংকের মৃত্যুর পর একশত বছর পর্যন্ত  বাংলাদেশে অনৈক্য ও বিশৃংখলা বিরাজ করেছিল। ইতিহাসে এ সময়কে বলা হয় মাৎসান্যায়। এই অরাজক অবস্থা দূর করার জন্য  বাংলার জনগণ ‘গোপাল’কে ৭৫০ খ্রীস্টাব্দে  রাজপদে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। সেদিন বাংলার জনগণ অত্যন্ত রাজনৈতিক বিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন। গোপাল যে পালবংশের রাজত্ব শুরু করেন তা চারশত বছর ব্যাপী শাসন করে গোবিন্দপালের (১১৬৫ খ্রী:) রাজত্বের অবসানের মধ্য দিয়ে শেষ হয়।
সম্রাট অশোকের পর পালরাজাদের শাসনকালে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস ছিল এক গৌরবজনক অধ্যায়। পাল রাজত্বের সময় বিদ্যায়, শিক্ষায়, সাহিত্যে বাংলাদেশের বৌদ্ধ সমাজে এক নতুন জাগরণ সৃষ্টি হয়। মূলত পালরাজাদের চারশত বছরের রাজত্বকালকে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে মধ্যযুগ যুগ বলা হয়। পালরাজারা বৌদ্ধ ছিলেন, তাঁদের রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশে মহাযান বৌদ্ধধর্ম বিরাট সাফল্য অর্জন করে। সম্রাট কনিষ্কের পর পালবংশের সময় মহাযান বৌদ্ধধর্ম ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে। এ সময়ে বৌদ্ধধর্ম তিব্বত, মালয়, সুমাত্রা প্রভৃতি দেশে প্রভাব বিস্তার করেছিল। নালান্দা, বিক্রমশীলা, সোমপুর, ওদন্তপুরী, জগদ্দল, শালবন, প-িত বিহার, বিক্রমপুরী বিহার প্রভৃতি জগতখ্যাত মহাবিহার (বিশ^বিদ্যালয়) গুলোকে কেন্দ্র করে বাংলার গৌরব, মহিমা সমগ্র বিশে^ বিস্তৃতি লাভ করে। এগুলোর ধ্বংসাবশেষ এখনও ইতিহাসের স্বাক্ষীরূপে বিদ্যমান।
পালযুগের শ্রেষ্ঠ প-িতদের মধ্যে অতীশ দীপংকর, দিবাকরচন্দ্র, প্রমুখ ছিলেন উল্লেখযোগ্য। বঙ্গে কিভাবে মহাযান বৌদ্ধধর্মের বিস্তার ঘটেছিল তা চুরাশি সিদ্ধাচার্য ও তাঁদের রচিত দোঁহা বা চর্যাপদ গ্রন্থ অধ্যয়নের মাধ্যমে অবগত হওয়া যায়। সিদ্ধাচার্য বা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দ্বারা রচিত চর্যাপদ হল বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন। নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প-িত শীলভদ্র এবং বিক্রমশীলা মহাবিহারের প্রধান আচার্য দীপংকর শ্রীজ্ঞান ছিলেন বাংলাদেশের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান। তাঁরা উভয়ে ছিলেন যথাক্রমে মন্ত্রযান  এবং বজ্রযানের প্রবক্তা। 
পালবংশ ছাড়াও খ্রীস্টীয় সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত খড়গবংশ, দেববংশ ও চন্দ্রবংশ প্রভৃতি বৌদ্ধ রাজবংশ বাংলায় রাজত্ব করেন। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় হীনযান, মহাযান ও তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম বাংলায় ব্যাপক প্রচার-প্রসার লাভ করে।
পালযুগকে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে স্বর্ণযুগ বলা হয়। পালযুগ অবসানের পর বৌদ্ধধর্ম ধীরে ধীরে এদেশে ম্লান হতে থাকে। ত্রয়োদশ শতকে বাংলায় ব্রাহ্মণ্যধর্মের উত্থান হয় সেন রাজবংশের পৃষ্ঠপোষকতায়। বৌদ্ধ রাজারা সকল ধর্ম-সম্প্রদায়-গোত্রের প্রতি যে উদার মানসিকতা নিয়ে দেশ শাসন করেছিলেন কিন্তু সেন আমলে সেই উদারতা ছিল না। ধর্মের দিক থেকে সেন, বর্মণ রাজারা ছিলেন অত্যন্ত গোঁড়া। প-িত নীহার রঞ্জন রায়ের মতে-‘‘সেন ও বর্মণ রাজবংশ বৌদ্ধধর্ম ও সংঘের উপর খুব শ্রদ্ধিত ছিলেন না। প্রত্যক্ষ অত্যাচারে না হউক পরোক্ষ নিন্দায় বৌদ্ধদের উŤপীড়িত করার চেষ্টায় ত্রুটি হয় নাই।’’
তুর্কীদের আগমণের ফলে ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মের উপর চরম আঘাত আসে। তাঁদের আক্রমণের ফলে বৌদ্ধ বিহারগুলি ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। তখন ধর্ম-শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্রগুলো লুণ্ঠন করা হয়। এ আক্রমণের ফলে  নালান্দা, বিক্রমশীলা, ওদন্তপুরী মত প্রভৃতি জগতখ্যাত বিদ্যাপীঠগুলো পুরোপুরি ধ্বংস হয়। এ ধ্বংসের যজ্ঞ বাংলাদেশেও এসে পড়ে। মগধের এরূপ অত্যাচারের খবর পেয়ে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের ভিক্ষুরা যে যেদিকে পারে পলায়ন করল। কেউ কেউ নেপাল, তিব্বত, উড়িষ্যা প্রভৃতি জায়গায় গিয়ে আত্মগোপন করেন। বৌদ্ধবিহারে ভিক্ষুশূণ্য হওয়ার কারণে এগুলো সহজেই ধ্বংস হয় এবং তখন থেকেই বৌদ্ধধর্ম বিলুপ্তি পথে পা বাড়ায়।
মুসলমানদের বিদ্বেষ ও ব্রাহ্মণদের চরম নিগ্রহ সত্ত্বেও বৌদ্ধধর্ম গৌড়বংগ হতে একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। অনেকে প্রচ্ছন্ন ভাব ধারায় বৌদ্ধধর্মকে রক্ষা করে। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে বাংলাদেশে দু’চার জন বৌদ্ধ পন্ডিত ছাড়াও বৌদ্ধ জমিদার ও বৌদ্ধ নরনারী ছিল বলে জানা যায়। বাংলাদেশে যে বৌদ্ধধর্মের এত প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল তা কিভাবে ম্লান হয়ে আসলো সে সম্পর্কে চারুচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের প্রণিত ‘শূণ্যপুরাণ’ গ্রন্থের ভূমিকায় ড. শহীদুল্লাহ লিখেছেন-‘‘বাংলার বিশাল হিন্দু ও মুসলমানগুলি বৌদ্ধগণকে গ্রাস করে নিয়েছে।’’ ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, সেনযুগ হতে বৌদ্ধধর্মের প্রতি বিদ্বেষ শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ব্রাহ্মণ্যধর্মের উত্থান, তুর্কীদের আক্রমণ ও সামাজিকভাবে ঘৃণা ইত্যাদির কারণে বৌদ্ধধর্মের প্রভাবকে ক্রমশ সংকোচিত করে এবং গভীর সংকটের মধ্যে পড়ে। এ চরম মুহূর্তে বৌদ্ধধর্ম প্রায় বিলুপ্ত হলেও বৌদ্ধধর্মের মূল ভাবধারা-আদর্শ নাথ ও বাউল ধর্মের সাথে সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে সঞ্জীবিত ছিল। উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মতে-‘‘ বাউল ধর্ম একটি সমন্বয়মূলক ধর্ম। এর মূল গঠন পদ্ধতি তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত।’’  নারীর  সংসর্গ  ত্যাগ, কঠিন সংযম  নাথধর্মে বলা হয়েছে,  এই সাধনা পদ্ধতি বৌদ্ধধর্মেও বিদ্যমান। এছাড়াও  বৌদ্ধধর্মের আদর্শ-ভাবধারা অন্যান্য ধর্মের সাথে একাত্ম হয়ে মিশে গিয়ে একাকার হয়ে গেছে। ভারত ও বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে বৌদ্ধধর্ম বিলুপ্ত হয়ে গেলেও এই ধর্মের কিছু মোহনীয় আদর্শগুলো এদেশের মানুষের হৃদয় মন্দিরে স্থান করে নিয়েছিল। সকল প্রাণির প্রতি মৈত্রীভাব পোষণ, অহিংসানীতি, মাদকদ্রব্য সেবন থেকে বিরতি, যুদ্ধ বিরোধী মনোভাব, জনকল্যাণমূলক কর্মকা-, ভাতৃত্ববোধ ও নারী জাতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন এদেশের সমাজ জীবনে এখনও পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করে আছে।
গোটা ভারতবর্ষ  থেকে বৌদ্ধধর্ম বিলুপ্ত হয়ে গেলেও বেশ কিছু অঞ্চলে চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায় নি। ইতিহাসবিদ ও পন্ডিতেরা মনে করেন‘‘ সেন-বর্মণ যুগে বৌদ্ধধর্ম যে অবক্ষয় হয়েছিল তা মুসলমান আগমণের পর একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। বিশাল বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর মধ্যে অনেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। কিছু সংখ্যক বৌদ্ধ নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে অবিভক্ত চট্টগ্রামের (পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম) প্রত্যন্ত অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করে। বাংলাদেশের অবিভক্ত চট্টগ্রামে বসবাসরত চাকমা,মারমা, বড়ুয়া ইত্যাদি সম্প্রদায়রাই হলেন এদেশের আদি বৌদ্ধদের বংশধর।
এ চরম ক্রান্তিকালে রাউলীরা (লুরি- অনুপসম্পন্ন বৌদ্ধ সন্যাসী) বৌদ্ধধর্মের ক্ষীণ শিখাটি জ্বালিয়ে রাখার মহান ব্রত নিয়েছিলেন । সে সময় নেপাল, তিব্বত, চীন, কোরিয়া প্রভৃতি দেশের মহাযানী ভিক্ষুদের মত তাঁরা সংসার ধর্মও পালন করতেন আর ধর্মীয় কার্যাদিও সম্পাদন করতেন। আবার রাউলীদের মধ্যে কেউ কেউ সম্পূর্ণ সংসার ত্যাগীও ছিলেন। তাঁরা রাউলী হিসেবে ছদ্মবেশ ধারণ করেন এক কঠিন পরিস্থিতি ও প্রতিকুল পরিবেশের কারণে। তখন বৌদ্ধ ভিক্ষুদের গেরুয়া বসন পরিধান করে চলা-ফেরা করা খুবই দুরূহ হয়ে উঠে। এরকম কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য বাধ্য হয়ে তাঁরা শুধুমাত্র ধর্মীয় কার্যক্রম সম্পাদন করার সময় গেরুয়া বসনটি গায়ে জড়িয়ে নিতেন আর অন্য সময় বাড়ীতে তা সংরক্ষণ করে রাখতেন।  চাকমা ও বড়ুয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে রাউলীর প্রভাবটা ছিল বেশী। চট্টগ্রামের বড়–য়া সম্প্রদায়ের মধ্যে রাউলী প্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেলেও চাকমা সম্প্রদায়ে এখনও পর্যন্ত রাউলী পুরোহিত পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কিছু কিছু জায়গায় বিদ্যমান রয়েছে। অধিকন্তু চট্টগ্রাম অঞ্চলে এখনও অনেক মুসলমানেরা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দেখলে র’অলী(রাউলী) বলে। রাউলীরা অনেকেই জনসেবামূলক কাজ করে গেছেন তার প্রমাণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গার নাম রাউলীর রাস্তা, রাউলীর পুল, রাউলীর দীঘি ইত্যাদি।  চাকমারা এক সময় চট্টগ্রাম অঞ্চলে রাজত্ব করেন। তদানীন্তন চট্টগ্রাম জেলার ভারপ্রাপ্ত ইংরেজ কর্মচারী হেনরী ডেরলিস্ট বলেন,‘‘ চাকমা রাজা ফতে খাঁর রাজ্য সীমা উত্তরে ফেনী নদী, দক্ষিণে শঙখ নদী, পূর্বে কুকী রাজ্য ও পশ্চিমে নিজামপুর পরগণা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।’’ চাকমা রাজা ফতে খাঁ ১৩৩৭ খ্রীস্টাব্দে রাজা নিযুক্ত হন।
এছাড়াও সপ্তদশ শতকের শেষভাগে মতান্তরে অষ্টাদশ শতকের প্রারম্ভে চাকমা বৌদ্ধ সমাজে শিবচরণ ছিলেন একজন মহান সাধক ও কবি। জনশ্রুতি আছে তিনি ধ্যান-সাধনার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও বহু অলৌকিক ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। তাঁর রচিত বিখ্যাত ‘গোজেন লামা’তে (ভক্তিমূলক গাঁথা) বৌদ্ধধর্মের বৈরাগ্যভাব, দুŦখের বাণী ঝংকৃত হয়েছে এবং গভীর দেশাত্মবোধ, স্বজাতির প্রেম ফুটে উঠেছে। বৌদ্ধদের এরকম কঠিন পরিস্থিতি এবং অস্থিরতার মধ্যেও শিবচরণের মত সাধক ও কবির আবির্ভাব কম শ্লাঘার বিষয় নয়। এতে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, রাউলীদের পাশ পাশি অনেকেই সাধন-ভজনের মাধ্যমে বৌদ্ধধর্ম চর্চা করেছেন।  
 চাকমা সম্প্রদায়ের রাউলীদের ধর্মীয় গ্রন্থকে ‘তারা’ বলা হয়। এক সময় বৌদ্ধরা ফরা, তারা, সংঘ নাম স্মরণ করেই নিজের এবং অপরের মঙ্গল কামনা করতেন। ফরা-অর্থ হল বুদ্ধ, তারা-অর্থ হল ধর্ম এবং সংঘ-অর্থ হল ভিক্ষু সংঘ। এখানে ‘তারা’ শব্দটি সূত্র (বুদ্ধের উপদেশ) অর্থে বুঝানো হয়েছে। রাউলীদের ধর্মীয় গ্রন্থের মধ্যে ২৮টি ‘তারা’ নাম পাওয়া গেছে সেগুলো হল - ১.আগর তারা, ২.মালেম তারা, ৩.সাধেংগিরি তারা, ৪. অনিজা তারা, ৫.শীল মোঙ্গল তারা, ৬. দশো পারমী তারা, ৭. তিকুড্ড তারা, ৮. বড় কুরুক ও ছোট কুরুক তারা, ৯. তাল্লিক শাস্ত্র তারা, ১০. আরিন্তামা তারা, ১১. রাকেন তারা, ১২. সাহস ফুল তারা, ১৩. আরিন্নামা তারা,  ১৪. ঝিয়ন ধারণ তারা, ১৫. অজিনা তারা, ১৬. পুদুম ফুরু তারা, ১৭. ফুদুম  ফুল তারা, ১৮. সবা দিবা তারা, ১৯.  চেরাক ফুল তারা, ২০. সানে ফুল তারা, ২১. বুদ্ধ ফুল তারা, ২২. সাক সত্তুন তারা, ২৩. রাজা হোড়া তারা, ২৪.  সরক দান তারা, ২৫. সুবা দিজা তারা, ২৬. শাক্য তারা, ২৭. ফকিরি তারা, ২৮.  আঙারা সুত্র তারা।
এই  তারাগুলো হল মূলত ত্রিপিটকের বিভিন্ন সূত্রেরই অপভ্রংশ। বিভিন্ন ধর্মীয় কার্যাদি সম্পাদন করার জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু ‘সূত্র’  ত্রিপিটক থেকে সংকলন করে রাউলীরা বুদ্ধের পরম নিধি হিসেবে সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন। কিন্তু নানা প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে এই সূত্রগুলো অনুলিখন হতে হতে এক সময় বিকৃতি রূপ ধারণ করে।

এভাবেই কালের করাল গ্রাসে অন্যান্য অঞ্চলের মত পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধরাও নিজেদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে। কেউ কেউ পারিপার্শ্বিক ধর্ম সম্প্রদায়ের সংস্কৃতির সাথে একীভূত হয়ে যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলার মূল অধিবাসী হল ১৩টি আদিবাসী জনগোষ্ঠী। এরা হলো- চাক্মা, মগ বা মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, বম বা বনযোগী, চাক, মুরং, লুসাই, খুমি, কুকি, রিয়াং, পাংখো ও খিয়াং। ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে জানা যায় যে, পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসী জনগোষ্ঠী এক সময় ছিলেন অধিকাংশই বৌদ্ধধর্মের অনুসারী। ব্রিটিশ উপনিবেশের সময় খ্রীস্টান মিশনারীদের কবলে পড়ে একটা অংশ খ্রীস্টান ধর্ম গ্রহণ করে। আর চাক্মা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, মুরং, চাক, খুমি সম্প্রদায় কোন রকমভাবে নিজেদের ধর্ম রক্ষা করে। কিন্তু ত্রিপুরা সম্প্রদায় সনাতন (হিন্দু) ধর্মের সাথে একাত্মা হয়ে যায়।
বর্তমানে বাংলাদেশে সমতল ও পার্বত্য অঞ্চলে কয়েকটি বৌদ্ধ সম্প্রদায় বসবাস করে। সমতল অঞ্চলের চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-কুমিল্লা-নোয়াখালীতে বসবাসরত বড়–য়া ও সিংহ উপাধিধারী বৌদ্ধরা বাঙ্গালী বৌদ্ধ হিসেবে পরিচিত। কক্সবাজার ও বড়গুনা জেলায় কিছু সংখ্যক রাখাইন আর উত্তরবঙ্গের রংপুর-ঠাকুরগাঁও এবং পঞ্চগড় মিলে কিছু সংখ্যক ওঁড়াও,খালকো, মিঞ্জী, কেরকাটা, এক্কা, টপ্য, কুজুর, তিগ্যা ইত্যাদি উপাধিধারী বৌদ্ধরা সমতলের আদিবাসী বৌদ্ধ হিসেবে পরিচিত। এবং পার্বত্য অঞ্চলের বৌদ্ধরা পাহাড়ী আদিবাসী বৌদ্ধ হিসেবে পরিচিত। পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসী বৌদ্ধদের মধ্যে জনসংখ্যার দিক দিয়ে চাক্মা হল প্রথম, আর মগ বা মারমা হল দ্বিতীয়। অধিকাংশ চাক্মা রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় বসবাস করে। খুব অল্প সংখ্যক চাক্মা বান্দরবান জেলায় বাস করে।  অধিকাংশ মারমা বান্দরবান জেলায় বসবাস করে আর কিছু সংখ্যক রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে বাস করে।
মধ্যযুগ ও আধুনিকযুগের মধ্যবর্তী সময় অর্থাৎ ত্রয়োদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস ছিল সম্পূর্ণ অন্ধকারাচ্ছন্ন। এ সময় হলো বৌদ্ধদের অন্ধকার যুগ। তখন সমগ্র ভারতবর্ষের বৌদ্ধরা পরিস্থিতির শিকার হয়ে নানা অন্ধকুসংস্কারে নিমজ্জিত হয়। এ অন্ধকুসংস্কারের ঢেউ অবিভক্ত চট্টগ্রামেও (চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম) ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় নানা দেব-দেবীর পূজা, গাং পূজা, থানমানা পূজা, মা-লক্ষ্মী মা পূজা, দুর্গা পূজা, মনসা পূজা, মুসলমানদের সত্যপীরের সিন্নি দেয়া ইত্যাদি। এগুলো হচ্ছে সম্পূর্ণ বৌদ্ধধর্মের পরিপন্থী। অথচ এ সমস্ত পূজা-অর্চনা কিভাবে বৌদ্ধধর্মে প্রবেশ করল ভাবিয়ে তুলে। ধারণা করা হয় হিন্দু ধর্ম-কর্মের প্রভাবে এগুলো বৌদ্ধধর্মে প্রবেশ করে।
বৌদ্ধদের এমন দুর্দিনে ও তমসাচ্ছন্ন সন্ধিক্ষণে দেবদূতের মতো সংঘরাজ সারমেধ মহাথের’র আবির্ভাবের মধ্য দিয়েই বাংলার মাটিতে আধুনিক বৌদ্ধধর্মের যুগ সূচনা হয়। সংঘরাজ সারমেধ মহাথের চকরিয়ার হারবাং গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত রাখাইন পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি শৈশবে আরাকানে গমন করেন। সেখানে তিনি থেরবাদ বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নিয়ে ত্রিপিটক শাস্ত্রের অগাধ পা-িত্য অর্জন করার পর স্বদেশে ফিরে আসেন।  বাংলার বৌদ্ধদের করুণ অবস্থা অবলোকন করে তিনি খুবই মর্মাহত হন। তখনই তিনি বাংলায় অন্ধকুসংস্কার মুক্ত বৌদ্ধ সমাজ বিনির্মাণ করার এক স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি তাঁর এই মহŤ উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে সমগ্র বৌদ্ধ সমাজে বিচরণ করে তান্ত্রিক মতের অসারতা এবং দেব-দেবীর পূজা,পশুবলীর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা চালান। তাঁর অদম্য সদ্ধর্ম প্রচারাভিযানের ফলে বাংলার বৌদ্ধ সমাজ অন্ধকার থেকে আলোর মুখ দেখতে পাই। তাঁর বহুমুখী প্রতিভা,অসাধারণ পা-িত্য, জ্ঞানগর্ভ সদ্ধর্ম দেশনা ও অক্লান্ত ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে বাংলার মাটিতে ‘থেরবাদ বৌদ্ধধর্মে’র পুনরুত্থান ঘটে।

 সংঘরাজ সারমেধ মহাথের’র সদ্ধর্ম দেশনায় আকৃষ্ট হয়ে পুণ্যশীলা চাকমা রাণী কালিন্দী ‘থেরবাদ বৌদ্ধ ধর্মে’ দীক্ষিত হন। তখন থেকে সারমেধ মহাথের মহোদয় বাংলার বৌদ্ধদের কাছে সংঘরাজ হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। সংঘরাজ সারমেধ মহাথের’র ধর্মাচরণে ও বিনীত ব্যবহারে রাণী কালিন্দী এতই শ্রদ্ধাসম্পন্ন হন যে, তিনি ১৮৫৭ খ্রীস্টাব্দে ‘রাজ পুণ্যাহ’ উপলক্ষে মহা সমারোহে আরাকানী ভাষায় উপাধি যুক্ত সীলমোহর প্রদানের  মাধ্যমে গুরুর প্রতি অকৃত্রিম সম্মাননা জ্ঞাপন করেন। অতŦপর  রাউলী পুরোহিতদেরকে সংস্কার করার জন্য ১৮৬৪ খ্রীস্টাব্দে সংঘরাজ সারমেধ মহাথের চট্টগ্রামে মহামুনির পূর্ব পার্শ্বে হাঞ্চারঘোনা নামক এক পার্বত্যছড়ায়  প্রথম বুদ্ধের বিনয় সম্মত উপসম্পাদার আয়োজন করেন। এতে সাতজন রাউলী পুরোহিত থেরবাদ সম্মতভাবে  উপসম্পাদা গ্রহণ করেন। এঁদের উপসম্পাদা গ্রহণের মধ্য দিয়ে বাংলায় থেরবাদ বৌদ্ধ ভিক্ষু সংঘ পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হয়। সংঘরাজ সারমেধ মহাথের’র প্রতিষ্ঠিত ভিক্ষু সংঘকে কেন্দ্র করে এদেশের মাটিতে যুগে যুগে জন্ম গ্রহণ করেন অনেক ক্ষণ জন্মা মহাপুরুষ। তাঁদেরই পুন্যহস্ত স্পর্শে বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হয় বহু জনহিতকর প্রতিষ্ঠান। অতীতের বৌদ্ধ সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সেই সময়ের রাজণ্যবর্গ ও শ্রেষ্ঠীদের দান মহিমায় গড়ে উঠেছে বহু প্রাসাদোপম বৌদ্ধ বিহার বা সংঘারাম। সেই চির অম্লান দৃষ্টান্ত থেকে শিক্ষা নিয়ে সংঘরাজ সারমেধ মহাথের সদ্ধর্ম হিতৈষীনী চাকমা রাণী কালিন্দীর সহায়তায় ১৮৭০ খ্রীস্টাব্দে রাঙ্গুনীয়া রাজানগর রাজ বিহারের পার্শ্বে বৌদ্ধ বিনয় সম্মত পবিত্র “ভিক্ষু সীমা” (ঘ্যাং ঘর) প্রতিষ্ঠা করেন। এই ভিক্ষুসীমা-ই হল বাংলাদেশী বৌদ্ধদের সর্ব প্রথম ঐতিহাসিক পাষাণ নির্মিত “ভিক্ষু সীমা”। বাংলার প্রায়ই স্বনাম ধন্য কৃতি ভিক্ষু এই “ভিক্ষু সীমায়” উপসম্পাদা গ্রহণ করে শাসন সদ্ধর্ম কল্যানার্থে কাজ করে গেছেন। বাংলায় আধুনিকযুগে থেরবাদ বৌদ্ধধর্ম পুনŦজাগরণে চাকমা রাণী কালিন্দীর অপরিসীম অবদান ইতিহাসের পাতায় চির অম্লান হয়ে থাকবে।
 মহীয়ষী রাণী কালিন্দীর পৃষ্ঠপোষকতায় অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে এদেশের মাটিতে বৌদ্ধধর্মের আলো প্রজ্জলিত হলেও ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝা-মাঝি সময় পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে এই আলোর শিখা খুবই ক্ষীণ অবস্থায় জ্বলতে থাকে। কারণ সে সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে দক্ষ-অভিজ্ঞ ও উপযুক্ত ধর্মীয় গুরুর অভাব ছিল। প্রাজ্ঞ ও যোগ্যতাসম্পন্ন বৌদ্ধ ভিক্ষুর অভাবে সমাজ থেকে পুরোপুরিভাবে কুসংস্কার দূর করা সম্ভব হয়নি। এসময়ে চাকমা-তঞ্চঙ্গ্যা-চাক-মুরং সম্প্রদায়ের মধ্যে তেমন কোন বৌদ্ধ ভিক্ষু নেই বললেই চলে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে উনবিংশ শতাব্দীর মাঝা-মাঝি সময়ে চাক্মা সম্প্রদায়ের যে কয়েকজন বৌদ্ধ ভিক্ষুর নাম পাওয়া যায় এঁদের মধ্যে ভদন্ত বরমিত্র ভিক্ষু , ভদন্ত বিজ্ঞানন্দ ভিক্ষু, ভদন্ত আনন্দ ভিক্ষু ছিলেন অন্যতম। অনেকের মতে ভদন্ত বরমিত্র ভিক্ষু ছিলেন আধুনিক বৌদ্ধযুগে চাক্মা সম্প্রদায়ের বৌদ্ধ ভিক্ষুদের পথিকৃŤ। কথিত আছে উপরোক্ত কীর্তিমান সংঘ মনীষীরা সকলেই রাজগুরুর পদ লাভ করেন।  চাকমা সমাজে যখন ভিক্ষু অপ্রতুল ছিল তখন এই অভাবটা কিছুটা হলেও পূরণ করেন মগ (মারমা), রাখাইন সম্প্রদায়ের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা। পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ চাকমা বৌদ্ধ বিহারগুলোতে মারমা সম্প্রদায়ের ভিক্ষুরা অবস্থান করে বিভিন্ন ধর্মীয় কার্যাদি সম্পাদনের মধ্য দিয়ে  বৌদ্ধধর্মকে রক্ষার্থে তাঁরা মহানব্রত প্রতিপালন করেন। কিন্তু সে সময়কার মারমা ও রাখাইন সম্প্রদায়ের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বুদ্ধের ধর্ম-বিনয়ে যথেষ্ট অভিজ্ঞ এবং পারদর্শি হলেও চাকমা-বাংলা ভাষার তেমন দখল না থাকার কারণে তাঁরা সদ্ধর্ম প্রচার-প্রসারে চাকমা বৌদ্ধ সমাজে খুব একটা সাড়া জাগাতে পারেননি। তারপরও চাকমা বৌদ্ধ সমাজে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। কারণ বিভিন্ন বৌদ্ধ তিথি উপলক্ষে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানগুলো মগ (মারমা) সম্প্রদায়ের ভিক্ষুরা অন্তত আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে হলেও সমাজকে ধর্মান্তরিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছেন।  চাক্মা বৌদ্ধ সমাজের দুর্দিনে যদি মগ সম্প্রদায়ের ভিক্ষুরা পাশে এসে না দাঁড়াতেন তা’হলে নিŦসন্দেহে আরো করুণ অবস্থা দেখা দিত। একারণে চাক্মা ভাষার মধ্যে এখনও অনেক আরাকানী শব্দের প্রচলন দেখা যায়। যেমন- সিয়ং (পালিতে যার অর্থ হল পি- আর বাংলাতে হল ভাত), কিয়ং ( বৌদ্ধ বিহার), মনস্যাং (শ্রামণ) ইত্যাদি।
পার্বত্য চট্টগ্রামে যখন আবারো বৌদ্ধ সমাজকে কুসংস্কারের কালোমেঘ এসে ক্রমান্বয়ে গ্রাস করতে যাচ্ছে ঠিক সেই যুগ সন্ধিক্ষণেই পার্বত্য চট্টগ্রামের ভাগ্যাকাশে উদয় হয় আরো এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, তিনি হলেন রাজগুরু অগ্রবংশ মহাথের। তিনি সুদীর্ঘকাল বার্মায় (বর্তমান মায়ানমার) ত্রিপিটক শাস্ত্র অধ্যয়ন করে বৌদ্ধ দর্শনের উপর অগাধ পান্ডিত্য অর্জন করেন। বার্মার তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী উŦ নু-এর পৃষ্ঠপোষকতায় যে ১৯৫৪-৫৬ খ্রীস্টাব্দে বার্মাতে ৬ষ্ঠ বৌদ্ধ সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়, সেই সঙ্গীতিতে তিনি (অগ্রবংশ মহাথের) একজন অন্যতম  সঙ্গীতি কারক হিসেবে অংশ গ্রহণ করার বিরল সুযোগ লাভ করেন। তাঁর পা-িত্যের স্বীকৃতি স্বরূপ বার্মার ‘‘বুদ্ধশাসন কাউন্সিল’’ তাঁকে ‘‘অগ্রমহাপন্ডিত’’ উপাধীতে ভূষিত করেন।
 সদ্য বার্মা থেকে প্রত্যাগত অগ্রমহাপন্ডিত, রাজগুরু অগ্রবংশ মহাথের’র বহুমুখী প্রতিভা দেখে এবং তাঁর জ্ঞানগর্ভ সদ্ধর্ম দেশনা শুনে মুগ্ধ হয়ে ১৯৫৭ খ্রীস্টাব্দে চাকমা রাজা মেজর ত্রিদিব রায় তাঁকে (অগ্রবংশ মহাথেরকে) রাজগুরু পদে বরণ করেন। রাজগুরু পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই পরমপূজ্য অগ্রবংশ মহাথের পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্ধকুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজকে বৌদ্ধিক আদর্শে উজ্জীবিত করার মহান প্রত্যয় নিয়ে এক সমাজ সংস্কার আন্দোলন গড়ে তোলেন। তিনি সমগ্র বৌদ্ধ সমাজে পরিভ্রমণ করে অন্ধ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা চালান। তাঁর ধর্মাভিযানের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধধর্মের এক নব জোয়ার সৃষ্টি হয়, দিশেহারা বৌদ্ধ সমাজ খোঁজে পাই মিথ্যাদৃষ্টির বেড়াজাল থেকে বের হওয়ার উপায় এবং কৌশল। তখন তাঁরা নবচৈতন্যের আলোকে উদ্ভাসিত হয়। পার্বত্যবাসীদের এই বোধোদয়ের মধ্য দিয়েই শুরু হয় সদ্ধর্মের নবজাগরণ।
এছাড়াও রাজগুরু অগ্রবংশ মহাথের তাঁর ধর্মাভিযানের মিশনকে বেগবান করার জন্য ১৯৫৮ খ্রীস্টাব্দে গঠন করেন “পার্বত্য চট্টগ্রাম ভিক্ষু সমিতি” (বর্তমান পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ, বাংলাদেশ) । তাঁর এই মিশনের মূল লক্ষ্য ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিটি  ঘরে বুদ্ধের জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে গোটা বৌদ্ধ সমাজকে বৌদ্ধিক আদর্শে জীবন গঠনে অনুপ্রাণিত করা।
রাজগুরু অগ্রবংশ মহাথের’র সমসাময়িক  আরো একজন পুণ্যপুরুষ ভদন্ত জ্ঞানশ্রী মহাথের (বর্তমান ‘বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভা’র মহামান্য উপ-সংঘরাজ, ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহারের প্রধান অধ্যক্ষ) পার্বত্য চট্টগ্রামে শুভাগমনে “পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ”র ভিত আরো অধিকতর সুদৃঢ় হয়ে উঠে। তিনি এই মিশনের একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে মানব কল্যাণের মহানব্রত নিয়ে অনগ্রসর, অনাথ, অসহায়, ছিন্নমূল, হতদরিদ্র ছেলেমেয়েদের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন অনাথ আশ্রম। তাঁর প্রতিষ্ঠিত অনাথালয় পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্মীয় শিক্ষার পাশা পাশি আধুনিক শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে এখনো পর্যন্ত অসাধারণ অবদান রেখে যাচ্ছে। উপ-সংঘরাজ জ্ঞানশ্রী মহাথের ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামে আধুনিক শিক্ষা জাগরণের অগ্রদূত, শাসন সদ্ধর্মের অন্যতম পথিকৃৎ। অগ্রমহাপ-িত, রাজগুরু অগ্রবংশ মহাথের এবং উপ-সংঘরাজ জ্ঞানশ্রী মহাথের ১৯৬১ খ্রীস্টাব্দে দীঘি নালা উপজেলাস্থ  মায়ানী উপত্যকা বোয়ালখালীতে মহান সাধক সাধনানন্দ মহাথের’র (বনভান্তের) শুভ উপসম্পাদা অনুষ্ঠানে অন্যতম কর্মবাচা আচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বস্তুতঃ তাঁদেরই দূরদর্শী সুবিবেচনা প্রসূত বদান্যতায় সাধনানন্দ শ্রামণের শুভ উপসম্পাদা কার্য ২৬ (ছাব্বিশ) জন প্রতিথযশা বিদগ্ধ সংঘ মনীষীর উপস্থিতিতে মহা সাড়ম্বরে সাধিত হয়। অতএব, সাধক প্রবর সাধনানন্দ মহাথের (বনভান্তে) ছিলেন উক্ত প্রাতঃস্মরণীয় সংঘ মনীষীদ্বয়ের অন্যতম শিষ্য এবং পার্বত্য ভিক্ষু সংঘের সুযোগ্য উত্তরসূরী।
মহামানব গৌতম বুদ্ধ তাঁর প্রতিষ্ঠিত ভিক্ষুসংঘকে উপলক্ষ করে নির্দেশ দিয়েছিলেন- ‘হে ভিক্ষুগণ! তোমরা দিকে দিকে বিচরণ কর, বহুজনের হিতের জন্য, মঙ্গলের জন্য, দেব-মানবের হিত সুখের জন্য, দুই জন এক পথে যেও না, হে ভিক্ষুগণ! তোমরা ধর্ম দেশনা কর- আদিতে কল্যাণ, মধ্যে কল্যাণ, অন্তে কল্যাণ, যা অর্থ সংযুক্ত, ব্যঞ্জনযুক্ত,পরিপূর্ণ-পরিশুদ্ধ ব্রহ্মচর্য প্রকাশিত কর।’’ বুদ্ধের এই নিদের্শ অনুসরণ করে ‘পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ’র নিবেদিত প্রাণ প্রত্যেক সদস্য পঞ্চাশ দশক থেকে আজ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম, প্রত্যন্ত এলাকায় পদব্রজে পরিভ্রমণ করে মানব জাতির কল্যাণের জন্য দান কথা, শীল কথা, স্বর্গ কথা, ভাবনার কথা, নৈষ্ক্রম্যের কথা, আত্ম-পরহিতের কথা, দুঃখ নিবৃত্তির কথা প্রচার করে যাচ্ছেন।
“পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ”র নিরবচ্ছিন্ন ধর্মাভিযানে পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ সমাজ থেকে অন্ধকুসংস্কারের কালো মেঘ ধীরে ধীরে অপসারিত হতে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী  প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া সদ্ধর্ম নিধিকে ফিরে পেয়ে তাঁরা নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়ায়। মানুষ উপলব্দি করতে পারে কিভাবে বৌদ্ধিক আদর্শে জীবন পরিচালনা করতে হয়। পূত-পবিত্র মহান ভিক্ষু সংঘের অনুপ্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিটি বৌদ্ধ বিহারে বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন তিথি ও পার্বনাদি যথাযোগ্য ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশে উদ্যাপন করা আরম্ভ হয়। তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের গ্রামে-গঞ্জে বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘের জয় ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠত। আবাল বৃদ্ধ বণিতা সকলেই এই পুণ্যানুষ্ঠানে স্বতঃস্ফুর্তভাবে অংশ গ্রহণের মধ্য দিয়ে প্রতিটি বৌদ্ধ বিহার এক মহামিলন মেলায় মহোৎসবে পরিণত হতো। এই ধর্মীয় মহামিলনের মধ্য দিয়েই একে অপরের সাথে ভ্রাতৃত্ববোধ ও মৈত্রীর সেতু বন্ধনকে সুদৃঢ় করে।
এসমস্ত পুণ্যানুষ্ঠানে আগত পন্ডিত-প্রাজ্ঞ ভিক্ষুসংঘ ধর্মীয় শিক্ষা, সাধারণ শিক্ষা, আধুনিক প্রযুক্তি বিদ্যার প্রয়োজনীয়তা, সমাজ উন্নয়ন, ক্ষুদা দারিদ্র মুক্ত সুশীল সমাজ বিনির্মাণের  গুরুত্ব আরোপ করে ধর্ম দেশনা করতেন যার প্রভাবে বৌদ্ধ সমাজে এক আমুল পরিবর্তন দেখা দেয়। ভিক্ষু সংঘের যুগোপযুগী ধর্মদেশনায় পার্বত্য বৌদ্ধ সমাজে ধর্মীয় মূল্যবোধ, প্রগতিশীল সমাজ ব্যবস্থা ও কুসংস্কার মুক্ত সমাজ গড়ার শুভ চেতনার উন্মেষ ঘটে। পার্বত্য গণমানুষের এই প্রজ্ঞাদীপ্ত চেতনা শক্তির প্রভাবে সমাজ ক্রমান্বয়ে কুসংস্কারমুক্ত হতে থাকে। সমাজে বৃদ্ধি পায় বৌদ্ধিক রীতি-নীতি সম্মত মননশীল আচার-অনুষ্ঠান। এই আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজে শুধু বাহ্যিক উন্নতি হয়নি, মানসিক উৎকর্ষতা সাধিত হয় এবং শিক্ষা-দীক্ষায় অভিবৃদ্ধি লাভ করে।
“পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ” প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত শাসন-সদ্ধর্ম কল্যাণে  যে সমস্ত সংঘ সদস্য আত্মোৎসর্গ করে নিরন্তর সেবা দিয়ে গেছেন এবং দিয়ে যাচ্ছেন, তাঁরা হলেন ভিক্ষুকুল গৌরব রবি, অগ্রমহাপ-িত, রাজগুরু অগ্রবংশ মহাথের,শাসনশোভন জ্ঞানভাণক, উপ-সংঘরাজ জ্ঞানশ্রী মহাথের, ভদন্ত বিমলবংশ মহাথের, সংঘরাজ সুগত প্রিয় মহাথের, সংঘরাজ অভয় তিষ্য মহাথের, সাদা মনের মানুষ উপাধীতে ভূষিত, উপ-সংঘরাজ তিলোকানন্দ মহাথের, ভদন্ত চিত্তা নন্দ মহাথের, কর্মযোগী ভদন্ত বিমল তিষ্য মহাথের, কর্মযোগী ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথের, ভদন্ত শ্রদ্ধালংকার মহাথের, ভদন্ত শোভা নন্দ মহাথের, ভদন্ত সত্যানন্দ মহাথের, ভদন্ত সুমনালংকার মহাথের, ভদন্ত ধর্ম কীর্তি মহাথের, ড. গিরিমা নন্দ মহাথের (বর্তমান মায়ানমারে ভাবনারত) প্রমুখ।  কীর্তিমান এই পুণ্যপুরুষেরা কেউ কেউ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিম-লে মানবতার সেবায় নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁদের পুণ্যহস্তে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন সমাজ উন্নয়নমূলক বিশাল কর্মকা-ের মধ্যে রয়েছে বৌদ্ধ বিহার কেন্দ্রিক স্কুল, কলেজ এবং অনাথ আশ্রম। ‘পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ’ সদস্যদের কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত জনহিতকর প্রতিষ্ঠানগুলো হল- পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রম, মোনঘর শিশু সদন, বনফুল চিলড্রেন হোম, বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজ, বোধিচারিয়া শিশু করুণা সংঘ (কলিকাতা, ভারত), কাচালং শিশু সদন, পার্বত্য বৌদ্ধ মিশন, গিরিফুল শিশু সদন, বুদ্ধ শিশুঘর, পুরঞ্জয় শিশু সদন, প্রণয় শিশু সদন, বোধিগিরি শিশু সদন, বান্দরবান সাতকমল পাড়া পঞ্চবুদ্ধ অনাথালয়, রোয়াংছড়ি অগ্রবংশ শিশু সদন,নাক্ষ্যংছড়ি চেতনা শিশু সদন, গাগড়া চন্দ্রবংশ শিশু সদন, ফারুয়া বৌদ্ধ মিশন, বিলাই ছড়ি রাজগুরু অগ্রবংশ শিশু সদন, বাঙ্গাল হালিয়া শিশু সদন, শিজক অভয়তিষ্য শিশু সদন, লক্ষ¥ীছড়ি পূর্ণজ্যোতি শিশু সদন ইত্যাদি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পশ্চাŤপদ জনগোষ্ঠীকে শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞানে-গুণে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে ‘পার্বত্য ভিক্ষু সংঘে’র প্রথিতযশা ভিক্ষুরা জনহিতকর প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিষ্ঠা করে এক  যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্মীয় শিক্ষা ও আধুনিক শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে এই জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবদান অতুলনীয়। প্রাতঃস্মরণীয় সংঘ মনীষীরা এই জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ার পেছনে মূল লক্ষ্য ছিল মানবীয় বৌদ্ধধর্মকে বিকশিত করা। মানবীয় বৌদ্ধধর্ম হল মৈত্রী-করুণা-মুদিতা ও উপেক্ষা এ চারটি মহৎগুণকে বুকে ধারণ করে সমগ্র মানবজাতির কল্যাণে আত্মোৎসর্গ করা। মানব কল্যাণে নির্মিত এই প্রতিষ্ঠান সমূহে আশ্রয় গ্রহণ করে হাজার হাজার অনাথ,অসহায়, ছিন্নমূল, হতদরিদ্র ছেলেমেয়ে শিক্ষা-দীক্ষায় সমুন্নত হয়ে আলোকিত মানুষ হিসেবে দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। উল্লেখ্য দুইজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সংঘমনীষা কর্মবীর ভদন্ত বিমল তিষ্য মহাথের ও কর্মবীর ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথের’র ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় পার্বত্য চট্টগ্রামের ৭২জন ছেলে ফ্রান্সের মত উন্নত দেশের এখন গর্বিত নাগরিক। এই অসহায় ছেলেমেয়েরা যদি মানবতাবাদী বৌদ্ধভিক্ষুদের পুণ্যহস্তে প্রতিষ্ঠিত জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোতে আশ্রয় না পেত তাহলে তাঁরা সমাজ ও দেশের বোঝা হয়ে দাঁড়াত। তাঁরা এখন আর সমাজের বোঝা নয়, এক একজন আলোকিত মানুষ ও দেশের মানব সম্পদে পরিণত হয়েছে।
‘পার্বত্য ভিক্ষু সংঘে’র আরো একজন দিকপাল সদস্য মহান সাধক ভদন্ত সাধনানন্দ মহাথের (বনভান্তে) পরমার্থিক বৌদ্ধধর্মকে বিকশিত করার জন্য আত্মনিয়োগ করেন।  পরমার্থিক বৌদ্ধধর্মের চর্চা হলো- শীল, সমাধি, প্রজ্ঞা অনুশীলনের মধ্য দিয়েই নিজের মুক্তি সাধনের পর পরের কল্যাণে আত্মোŤসর্গ করা। পুণ্যপুরুষ, সর্বজন শ্রদ্ধেয় সাধনানন্দ মহাথের (বনভন্তে) বৌদ্ধধর্মের লোকোত্তর জ্ঞানের কোন স্তর পর্যন্ত অধিগত করেছেন তা আমার মত অজ্ঞব্যক্তির চিন্তার বাইরে। কারণ শাস্ত্র মতে ‘‘ একমাত্র অর্হত্বফল লাভীরাই  আরেকজন অর্হৎকে চিনতে পারেন।’’  কাজেই আমি একজন নগন্য বৌদ্ধধর্মের অনুসারী হয়ে মহানত্যাগী সাধনানন্দ মহাথের’র (বনভন্তে) জীবনাদর্শ নিয়ে আলোকপাত করা খঞ্জব্যক্তির পাহাড় অতিক্রম তুল্য। তারপরও আমার ক্ষুদ্রজ্ঞানে যা বুঝেছি ও অনুধাবন করেছি পরমপূজ্য সাধনানন্দ মহাথের (বনভন্তে) ছিলেন সমগ্র বৌদ্ধ সমাজ গগণে এক আলোকবর্তিকা ও ধ্রুবতারার সদৃশ। তাঁর আবির্ভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ সমাজে এক অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি হয়। তাঁর অনুপম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, অমিত তেজোদীপ্ত ব্যক্তিত্ব ও কম্বুকণ্ঠের ধর্ম দেশনার প্রভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও ঘুণেধরা বৌদ্ধ সমাজে আরো একবার নব জাগরণের ঢেউ উঠে। এই ঢেউ-এর তালে সমগ্র বৌদ্ধ সমাজে এক আমুল পরিবর্তন সাধিত হয়। শুরু হয় জাঁকজমকপূর্ণ ও মহাসমারোহে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি উদ্যাপন। পরমপূজ্য সাধনানন্দ মহাথের’র আজীবন সাধনপীঠ রাঙ্গামাটি রাজবন বিহারে এযাবŤ অনুষ্ঠিত বিভিন্ন ধর্মীয় উŤসবে অগণিত লোকের সমাগমই হল তার জ্বলন্ত উদাহরণ।
এভাবেই পুণ্যপুরুষ সাধনানন্দ মহাথের’র যশ-খ্যাতি-সুনাম দেশে-বিদেশে সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ে। সর্বস্তরের মানুষ তাঁর প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধায় নমিত হয়। তাঁর মহান ত্যাগময় আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বৌদ্ধ সমাজের বহু কুলপুত্র গার্হস্থ্য জীবন ত্যাগ করে ভিক্ষুত্ব জীবন গ্রহণ করেন। পূজ্যস্পদ সাধনানন্দ মহাথের’র নিকট দীক্ষা নিয়ে বহু জ্ঞানী-গুণী ও পন্ডিত ভিক্ষু সদ্ধর্ম প্রচার-প্রসারে নিয়োজিত আছেন। তাঁরা তাঁদের পরমগুরুর নাম দিয়ে এবং মানুষের অগাধ শ্রদ্ধার উপর ভিত্তি করে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রান্তে বিশাল বিশাল আকৃতির দৃষ্টিনন্দন বহু বৌদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠা করেন। যেগুলো ‘বনবিহার’’ নামে সমধিক পরিচিত। এই বিহারগুলোর প্রধান কার্যালয় হল ‘‘রাঙ্গামাটি রাজবন বিহার’’। চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় হলেন এই পুণ্যতীর্থের গর্বিত ভূমিদাতা। এ সমস্ত বৌদ্ধ বিহার  গড়ে ওঠার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধ ধমীর্য় বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানগুলো বাহ্যিকভাবে প্রভূত অগ্রগতি লাভ করেছে বটে, কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে পরমার্থিক বৌদ্ধধর্ম চর্চা কতটুকু বিকশিত হয়েছে অর্থাŤ মানুষের মনোজগত কতটুকু পরিশুদ্ধ হয়েছে তা একমাত্র বৌদ্ধধর্ম বিষয়ে অভিজ্ঞ লোকেরাই মূল্যায়ন করতে পারবেন।
বুদ্ধবাণী ত্রিপিটক প্রথম বাংলায় অনুবাদে হাত দেন বড়ুয়া সম্প্রদায়ের বৌদ্ধ ভিক্ষু ও গৃহী প-িতেরা। এর পাশাপাশি অনেক হিন্দু পন্ডিতও ত্রিপিটকের কিছু  খন্ড বঙ্গানুবাদ করে প্রকাশ করেন। ১৮৮৭ খ্রীস্টাব্দে পন্ডিত ধর্মরাজ বড়ুয়ার সুত্তনিপাত গ্রন্থটি পালি থেকে বাংলা অনুবাদের মাধ্যমে এ কাজ শুরু হয়। পূর্ণাঙ্গ ত্রিপিটক বাংলায় অনুবাদ করার প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন অগ্রমহাপ-িত প্রজ্ঞালোক মহাথের। তিনি পূর্ণাঙ্গ ত্রিপিটক বাংলা অনুবাদ করার জন্য ১৯২৮ খ্রীস্টাব্দের ১২ আগষ্ট রেঙ্গুনে ১৫ সদস্যের ‘‘বৌদ্ধ মিশন প্রেস’’ গঠন করেন। এই প্রেস থেকে তখনকার সময়ে বেশ কিছু বই প্রকাশিত হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ১৯৪২ খ্রীস্টাব্দের ২২ ডিসেম্বর বোমার আঘাতে এই প্রেসের ব্যাপক ক্ষতিসাধিত হলে প্রজ্ঞালোক মহাথের স্বপ্ন ভেস্তে যায়। এর পরবর্তীতে সময়ে আরো বেশ কিছু সংস্থা ত্রিপিটক প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিল এগুলোর মধ্যে ‘যোগেন্দ্র-রূপসীবালা ট্রাস্ট’’, ‘ত্রিপিটক প্রকাশনী প্রেস’, ‘ত্রিপিটক প্রচার বোর্ড’, ‘পালি বুক সোসাইটি’, ‘ধর্মধার বৌদ্ধ গ্রন্থ প্রকাশনী’, ‘মহাবোধি বুক এজেন্সী’ অন্যতম। তখন খন্ড খন্ড ভাবে অনেকেই ত্রিপিটক অনুবাদ করেন। তারপরেও বেশ কিছু খন্ড অননূদিত থেকে যায়। পরবর্তীতে পরমপূজ্য সাধনানন্দ মহাথের (বনভন্তে) পূর্ণাঙ্গ ত্রিপিটক বাংলা ভাষায় প্রকাশ করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। ভদন্ত প্রজ্ঞাবংশ মহাথের (চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহারের প্রাক্তন উপাধ্যক্ষ) শ্রদ্ধেয় সাধনানন্দ মহাথের’র (বনভন্তে) সান্নিধ্যে থাকা অবস্থায় বনভন্তের বেশ কয়েকজন শিষ্যকে পালি ভাষা শিক্ষা দিয়েছিলেন বনভন্তের লালিত স্বপ্নকে পূরণ করার জন্য। প্রজ্ঞাবংশ মহাথের’র কাছ থেকে পালিভাষা প্রশিক্ষিত বনবিহারের একঝাঁক ভিক্ষু-শ্রামণের অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে ত্রিপিটকের অননূদিত বইগুলো অনুবাদ করে ‘বাংলায় সমগ্র ত্রিপিটক প্রকাশনা কমিটির’ ঐকান্তিক সহযোগিতায় রাজবন বিহারের নিজস্ব প্রেস থেকে ত্রিপিটকের ৫৯টি গ্রন্থকে ২৫ খন্ডে প্রকাশ হয় ২৫ আগস্ট ২০১৭ খ্রীস্টাব্দে। এই প্রকাশনার মধ্য দিয়ে পরমপূজ্য সাধনানন্দ মহাথের’র দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্নকে তাঁর শিষ্যম-লীরা বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন। এছাড়াও চট্টগ্রামের বড়ুযা বৌদ্ধদের ‘বোধিদর্পণ প্রকাশনী’ থেকে সম্প্রতি ৫৯ খন্ডে সমগ্র ত্রিপিটকের বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। এভাবে সকলের সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে সমগ্র ত্রিপিটক বাংলা ভাষায় প্রকাশ হওয়ায় গৌতম বুদ্ধের অমূল্যবাণী সমূহ বাংলা ভাষাভাষীদের জানার মহান সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, এর সাথে বাংলা সাহিত্যকেও সমৃদ্ধ করেছে।

সাধক সাধনানন্দ মহাথের (বনভান্তে) ছিলেন এক মহান ত্যাগের মূর্তপ্রতীক। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের নিকট তিনি ছিলেন একজন অশেষ শ্রদ্ধার পাত্র । তিনি তাঁর কর্মগুণে সর্বস্তরের মানুষের হৃদয় মন্দিরে অদ্বিতীয় আসনে অধিষ্ঠিত হন। শ্রদ্ধেয় সাধনানন্দ মহাথের’র (বনভন্তে) মত গুণী-জ্ঞানী ও ত্যাগী মহাপুরুষ শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামে কেন বাংলাদেশে আর দ্বিতীয়জন জন্ম নিবেন কিনা সন্দেহ। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে, কিছু কিছু ভক্ত তাঁকে  যে দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে  শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন, তাতে বৌদ্ধধর্মের নিখাদ শ্রদ্ধার প্রতিফলন হয়নি। এতে ছিল এক অন্ধভক্তি ও বিশ^াস । সেই ভক্তি ও বিশ^াসের মধ্যে নিহিত ছিল শ্রদ্ধেয় সাধনানন্দ মহাথের’র (বনভন্তে) অলৌকিক শক্তির উপর ভর করে বৈতরণী পার হওয়া এবং নিজের সমস্ত মনস্কামনা পূরণ করা। মূলত  এরকম ধারণা থেকেই কেউ কেউ তাঁকে (বনভন্তে) ভগবান বুদ্ধের চেয়েও বড় মনে করে পূজা-অর্চনা করার আরম্ভ করেন। তখন এই ভক্তকুলের মাঝে শ্রদ্ধেয় সাধনানন্দ মহাথের (বনভন্তে) একজন বুদ্ধপুত্র (বৌদ্ধ ভিক্ষু) হিসেবে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। তিনি হয়ে গেলেন এক মহান অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন ত্রাণকর্তা হিসেবে। তখন বুদ্ধের কর্মবাদের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে সে ভক্তবৃন্দ আপদে-বিপদে,সুখে-দুখে,জয়-পরাজয়ে মোদ্দাকথায় সর্বক্ষেত্রেই সাধনানন্দ মহাথের’র (বনভন্তের) আশীর্বাদ ও তাঁর অলৌকিক শক্তির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। তিনি হলেন তাঁদের নিকট সমস্ত কিছুরই ত্রাণকর্তা। এখানে বুদ্ধের একটা উপদেশ বিশেষভাবে স্মর্তব্য যে, বুদ্ধ তাঁর শিষ্যম-লীকে বার বার বলেছিলেন-‘ হে ভিক্ষুগণ! নিজেই নিজের ত্রাণকর্তা, আমি শুধু তোমাদের পথ প্রদর্শক মাত্র। সমস্ত কাজ নিজেকেই সম্পাদন করতে হবে।’’ তাঁরপরও কেউ যদি বিনা পরিশ্রমে নিজের সমস্ত মনস্কামনা পূরণ করার জন্য শ্রদ্ধেয় বনভন্তেকে একজন মহান ত্রাণকর্তা মনে করে  পূজা করে থাকেন সেটা  তাঁর (বনভন্তের) করার কি আছে। দোষটা হল ভক্তদের। এই ভক্তরা এক প্রকার আবেগ প্রবন হয়ে অন্ধভক্তির সাগরে অবগাহন করে বুদ্ধের কর্মবাদকেই সরাসরি অস্বীকার করেন।  কিন্তু কর্মবাদই তো হচ্ছে বৌদ্ধধর্মের মূলভিত্তি।
শ্রদ্ধেয় সাধনানন্দ মহাথেরকে (বনভন্তেকে) কেন্দ্র করে এযাবŤ ঘটে যাওয়া অনেকগুলো ঘটনা প্রবাহ থেকে দু’য়েকটা বিষয় এখানে তুলে ধরার প্রয়াস পাচ্ছি,-পার্বত্য চট্টগ্রামের বহু প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারের সাথে ‘‘বন’’ শব্দটা যুক্ত করে এখন একটা পরিশুদ্ধি অভিযান শুরু হয়ে গেছে। যেমন বন্দুকভাঙ্গা ইউনিয়নের ‘‘খারিক্ষ্যং শাক্যমুনি বৌদ্ধ বিহারটি’’ পরিশুদ্ধি অভিযানের কবলে পড়ে এখন হয়ে গেছে ‘‘খারিক্ষ্যং শাক্যবন বিহার’’। গৌতম বুদ্ধ শাক্যবংশে জন্ম গ্রহণ করেছেন বলেই তাঁকে শাক্যমুনি বলা হত। বুদ্ধের প্রতি অবিচল শ্রদ্ধা রেখেই কিন্তু প্রথম অবস্থায় ‘‘খারিক্ষ্যং শাক্যমুনি বৌদ্ধ বিহার’’ নামকরণ করা হয়েছিল। শ্রদ্ধেয় বনভন্তের প্রতি ভক্তির অতিশয্য দেখাতে গিয়ে কখন যে বুদ্ধকে খাটো করা হল আমাদের কারোরই সম্বিৎ ছিল না। এভাবে শুদ্ধি অভিযানের ফলে যেসমস্ত বিহারের নামের সাথে “বন” শব্দটি সংযুক্ত হয়েছে সেগুলোর চেহারা আমুল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।  যেগুলো এখনো পর্যন্ত পূর্বের নাম ধারণ করে রয়েছে সেই বিহারগুলো মরা স্রোতের মত কোনো রকম টিকে আছে, আর কিছু কিছু একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে পরিশুদ্ধ থেকে আরো অধিকতর পরিশুদ্ধ করার জন্য কোন কোন বিহারের সংরক্ষিত পুরাতন বুদ্ধের মূর্তিগুলোকে (পার্বত্য ভিক্ষুসংঘের দ্বারা নির্মাণ করা হয়েছে বলে এই বুদ্ধমূর্তিগুলো নাকি অপবিত্র ছিল) ছুড়ে ফেলারও অভিযোগ পাওয়া গেছে। অথচ এই প্রাচীন বিহারগুলোই ছিল একসময় পার্বত্য চট্টগ্রামে বুদ্ধের শাসন-সদ্ধর্ম বিস্তারের সূতিকাগার এবং আমাদের ইতিহাস,সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক-বাহক। অধিকন্তু ভগবান বুদ্ধ বজ্জীদের শ্রীবৃদ্ধির লক্ষ্যে সপ্ত অপরিহানীয় ধর্ম উপদেশ দিতে গিয়ে তিনি একজায়গায় প্রাচীন বিহার-চৈত্যগুলোর সংস্কার ও সংরক্ষণের কথা বলেছিলেন। বুদ্ধ যেখানে প্রাচীন বিহার-চৈত্যগুলোকে সংস্কার ও সংরক্ষণের উপদেশ দিয়েছেন আর আমরা সে জায়গায় পুরাতন স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলার কাজে ব্যতিব্যস্ত। এটা ধর্ম পরিহানীকর পর্যায়ে পড়ে কিনা বিজ্ঞমহল ভেবে দেখুন।
৩০ জানুয়ারী ২০১২ খ্রীস্টাব্দে  পরমপূজ্য সাধনানন্দ মহাথের (বনভন্তে) দেহত্যাগের পর তাঁকে কেন্দ্র করে ঘটে গেল এক এক সময় এক এক ধরণের তাজ্জব ও আজগুবি ঘটনা। যেমন প্রচার করা হল থাইল্যান্ড এর জনৈক অর্হৎ ভিক্ষু নাকি কাকে ফোন করে বলেছিলেন- ‘‘তোমাদের সাধনানন্দ মহাথের (বনভন্তে) মহোদয় এখনো মারা যাননি । তিনি মূর্ছান্বিত হয়ে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়ে আছেন। তাঁর উদ্দেশ্যে যদি তোমরা সকলে মিলে মোমের প্রদীপ প্রজ¦লন করে প্রার্থনা কর তা’হলে সে আবার আগের মত প্রাণশক্তি ফিরে পাবেন।’’ এ খবর তীব্র ঝড়ের গতির ন্যায় চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল। খবর শুনামাত্রই ভক্তবৃন্দের দৌঁড়ঝাপ শুরু হল দোকানে। মোমবাতি জ¦ালিয়ে গ্রামে-গঞ্জে-শহরে-বন্দরে সব বয়সের মানুষ একাগ্রচিত্তে বনভন্তের জন্য গভীর প্রার্থনায় মগ্ন হলেন। প্রার্থনাকালে সকলেরই মনে মনে একটা মনস্কামনা ছিল শ্রদ্ধেয় সাধনানন্দ মহাথের (বনভন্তে) আপনি আবার জেগে উঠুন। বাস্তবিকপক্ষে সে কী আদৌ প্রাণশক্তি ফিরে পেয়েছেন? এটার প্রতিফলন দেখা গেল শুধু  লাভবান হলেন মোমবাতি বিক্রেতারা। এর কিছুদিন আবার প্রচার করা হল শ্রদ্ধেয় বনভন্তের প্রতিচ্ছবি নাকি চাঁদে দেখা যাচ্ছে।  যারা একাগ্রচিত্তে বনভন্তেকে স্মরণ করবেন একমাত্র তারাই দেখতে পাবেন। তখন ভক্তবৃন্দ দলে দলে তাদের পরমারাধ্য বনভন্তেকে এক পলক দেখার প্রত্যাশায় গভীর রাত পর্যন্ত জেগে চন্দ্রের দিকে তাকিয়ে থাকতে শুনা গেছে। আসলে সত্যিকার অর্থে কেউ দেখেছেন কিনা তারও কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি।
জন্ম হলে যে মৃত্যু অবধারিত। এই চিরন্তন সত্যকেও বনভন্তের বেলায় কেউ কেউ মানতে নারাজ। বেশ কয়েকজন ভক্তের মুখ থেকে স্বয়ং এরকম উক্তি করতে শুনেছি-‘‘বনভন্তে নাকি কখনোই মৃত্যুবরণ করতে পারেন না। তিনি তো হসপিটালে যেতে চাননি। তারপরও কেন তাঁকে জোর করে হসপিটালে নেয়া হলো? নিশ্চয় এখানে কোন একটা রহস্যাবৃত্ত।’’ তখন আমি একজন ভক্তকে বলেছিলাম- ‘‘আচ্ছা আপনি কেন এরকম প্রলাপ বকেন ? যেখানে বুদ্ধের আয়ুষ্কাল ছিল মাত্র আশি বছর আর সেখানে বনভন্তে তিরানব্বই বছর বয়সে দেহত্যাগ করেছেন। বুদ্ধের চেয়ে সে তো আরো তের বছর বেশি বেঁচেছিলেন। ’’ তখন সে ভক্ত আর কোন উত্তর দিলেন না।
২০১৭ খ্রীস্টাব্দে শ্রদ্ধেয় বনভন্তেকে নিয়ে আরো এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে গেল। এটি বর্তমান সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের দ্বারা নিমিষের মধ্যেই সয়লাব হওয়াতে সবাই বিস্ময়ে হতবাক! ঘটনাটি হল এই-‘‘শ্রদ্ধেয় সাধনানন্দ মহাথের’র (বনভন্তে) আত্মা নাকি চট্টগ্রাম শহরে বসবাসরত একজন চাকমা ভদ্রমহিলার শরীরে আশ্রয় নিয়ে আছে।’’ ফেসবুকে আপলোডকৃত ভিডিওটি যারা একবার দেখেছেন তাঁদের নিশ্চয় বুঝতে বাকী নেই, অঙ্গভঙ্গি ও বচনভঙ্গি দিয়েই ওই ভদ্রমহিলাটি প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, বনভন্তের আত্মা তাঁর দেহকে ভর করে রয়েছে এবং তাঁকে পূজা করলে নাকি বনভন্তেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পূজা করা হবে। অনেকে সাধক প্রবর সাধনানন্দ মহাথের’র (বনভন্তে) আত্মাকে দর্শনের জন্য ওই ভদ্রমহিলার নিকট এসে ভিড় জমান। শ্রদ্ধেয় সাধনানন্দ মহাথের’র (বনভন্তে) একজন স্বনামধন্য শিষ্য শ্রদ্ধেয় ধর্মতিষ্য ভিক্ষু (স্বর্গপুরীভন্তে) ওই ভদ্রমহিলার সাথে সাক্ষাৎ করতে এসে নিজেকে অর্হৎ হিসেবে দাবী করেন। বৌদ্ধধর্মে যেখানে আত্মার কোন অস্তিত্বই স্বীকার করে না সেখানে বনভন্তের আত্মা কিভাবে ওই মহিলার শরীরে আশ্রয় নিলো? বুঝা বড় দায়। জীবন রক্ষাকারী ঔষধ যেমন মাত্রাতিরিক্ত সেবন করলে তার উল্টো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় তেমনি সম্যক দৃষ্টিহীনভাবে মাত্রাতিরিক্ত ভক্তির বন্যায় ডুব দিলে আদৌ কী যুক্তি ও মুক্তির পথ মিলবে ? বিজ্ঞমহল আপনারাই বিবেচনা করুন পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধধর্ম এখন কোন পথে ? আমরা আসলে হুজুকে.....
বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক অনুবুদ্ধ, শ্রাবক বুদ্ধ এবং ষড়াভিজ্ঞ অর্হŤ উপাধীধারী ভিক্ষুর নাম শুনা যায়। বাস্তবে বাংলাদেশে অর্হৎ আছে, কি নেই, এ বিষয়ে মন্তব্য করার জ্ঞান ও দুঃসাহস আমার নেই। তবে বৌদ্ধ সাহিত্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, বুদ্ধের জীবদ্দশায় অর্হৎ প্রাপ্ত ভিক্ষু-ভিক্ষুণীকে থের এবং থেরী বলা হত। ত্রিপিটকের খুদ্দক নিকায়ের অন্তর্গত ‘থের গাথা’ এবং ‘থেরী গাথা’ বই দু’টি পাঠ করার জন্য বিজ্ঞমহলের প্রতি বিনীত অনুরোধ রইল, বই দু’টি পড়ে আপনারাই বিবেচনা করুন তখনকার সময়ের অর্হৎ আর বর্তমান সময়ের অরহতের মধ্যে সাদৃশ্য এবং বৈসাদৃশ্য কী।

 পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ করে চাকমা সম্প্রদায়ের ভিক্ষুসংঘ প্রধানত দু’ভাগে বিভক্ত হয়- ১. পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ, ২. বন ভিক্ষু সংঘ। ভিক্ষুসংঘের এই বিভাজন  প্রবীণ ও প্রথিতযশা সংঘ মনীষীরা কখনোই কামনা করেননি। কারণ যে “পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ’’ শ্রদ্ধেয় বনভন্তেকে শুভ উপসম্পাদা প্রদান করে এক মহান কর্তব্য সম্পাদন করেছিল সেই পবিত্র ‘ভিক্ষুসংঘ’কে যখন তিনি (বনভন্তে) দুŦশীল বলে আখ্যায়িত করলেন তখন থেকেই মূলত এই বিভাজনের সূত্রপাত হয়। ‘পার্বত্য ভিক্ষু সংঘে’র মর্মবেদনা ছিল যেই ভিক্ষু সংঘ তাঁকে ভিক্ষুত্ব জীবনের পূর্ণতা দিয়েছিল সেই ভিক্ষু সংঘ যদি দুŦশীল হয়ে থাকে তাহলে তো নিজের উপম্পাদা কর্মও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। 
শ্রদ্ধেয় সাধনানন্দ মহাথের (বনভন্তে) তাঁর জীবদ্দশায় বিশাল বিশাল জন সমুদ্রের মাঝে পরমপূজ্য রাজগুরু অগ্রবংশ মহাথের থেকে শুরু করে গোটা ‘পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ’কে ইচ্ছে মত তুলাধোনা দিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্যভাবে বিষোধগার করতেন, আর ‘পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ’ কর্তৃক গৃহীত মহৎ উদ্যোগ শিক্ষা বিস্তারের কার্যক্রমকে তিনি সরাসরি বিরোধীতা করে বলতেন-‘‘ ভিক্ষু হলে যাত্রীবাহী যানবাহনে চড়া যাবে না, ভিক্ষু আর গৃহী সমান সমান আসনে বসা যাবে না, রং বস্ত্র নিয়ে পড়ালেখা করা যাবে না, অনাথ আশ্রম স্কুল করা যাবে না, চাকরী করা যাবে না, টিভি দেখা যাবে না, বিদেশ ভ্রমণ করা যাবে না, টেলিফোন মোবাইল ব্যবহার করা যাবে না ইত্যাদি।’’ তাঁর এরূপ বিরোধীতার কারণে ‘পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ’ এযাবৎ জনসেবামূলক কর্মকা-ে যত ধরণের অবদান রেখেছিল তার সমুদয় অর্জন চাপা পড়ে গেছে আর তাঁদের (পার্বত্য ভিক্ষু সংঘে’র)  দ্বারা ছোটখাটো যে সমস্ত ভুলত্রুটি হয়েছে সেগুলো মহীরুহ ধারণ করে, ফলে সমগ্র বৌদ্ধ সমাজে পার্বত্য ভিক্ষু সংঘের প্রতি একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। পার্বত্য ভিক্ষুসংঘের প্রতি এরূপ নেতিবাচক মনোভাব সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমনভাবে প্রবেশ করে তার প্রতিফলন দেখা যায় বিরাজমান দ্বিধাদ্বন্দ্ব,পার্বত্য ভিক্ষুসংঘের প্রতি গৃহী সমাজের শ্রদ্ধার তারতম্য।
 পার্বত্য চট্টগ্রামের সিংহভাগ বৌদ্ধদের কিছু কিছু দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ দেখলে মনে হয় যেন ‘পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ’ বৌদ্ধ সমাজের নিকট একেবারেই গুরুত্বহীন, সেকারণে সর্বত্রই এ সংঘ অবহেলিত ও অপাংক্তেয়। এযাবŤ বৌদ্ধ সমাজ থেকে আরম্ভ করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে  যত প্রকার দান, অনুদান দেয়া হয়েছে তার অধিকাংশ ব্যয় করা হয়েছে বন বিহারগুলোর পেছনে। ধর্ম নিয়ে এধরণের বিমাতা সুলভ আচরণ ও বৈষম্য সত্যি ভাবিয়ে তুলে। এটা কোন ধরণের ধর্মীয় শিক্ষা ? বুঝা বড়ই কঠিন। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, পার্বত্য ভিক্ষুদের নিকট অধিকাংশ মানুষ যান শুধুমাত্র পাওয়ার আশায় কিন্তু দেয়ার বেলায় তাঁদের কথা অনেকেই স্মরণে রাখে না।
গৃহী সমাজের এধরণের মনোবৃত্তি মরণব্যাধি ক্যান্সারের মতো প্রবল থেকে প্রবলতর আকার ধারণ করতে করতে একসময় বাংলাদেশের গ-িপেরিয়ে সুদূর ভারতে বসবাসরত চাকমা সমাজেও তা ছড়িয়ে পড়ে। সেখানেও এই বিভাজনের মাত্রা এতই প্রকট আকার ধারণ করেছে যে, ভারতবাসী চাকমাদের মুখ থেকে শুনলে তা সহজেই অনুধাবন করা যায়। পরিতাপের বিষয় হলেও সত্য ‘বনভিক্ষু সংঘ’কে নিয়ে শ্রদ্ধেয় সাধনানন্দ মহাস্থবির (বনভন্তে) যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তাতেও এখন বিভেদের সুর বেজে উঠেছে। উদ্ভূত বিভেদ যদি মিটমাট না হয় তা’হলে তা কতটুকু গড়ায় সময়ই বলে দিবে।
উল্লেখ্য পরমপূজ্য সাধনানন্দ মহাথের (বনভন্তে) প্রথম অবস্থায় আধুনিক শিক্ষাকে তেমন গুরুত্ব না দিলেও জীবন সায়াহ্নে এসে তিনি উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত লোকদের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। তখন তিনি বি.এ, এম.এ ও পি-এইচডি ডিগ্রীধারীদের প্রব্রজ্যা নিয়ে বুদ্ধের শাসন সদ্ধর্ম কল্যাণে কাজ  করার জন্য আহ্বান করেন। কিন্তু ততক্ষণেই জল অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। এই বিষয়টি তিনি যদি প্রথম থেকেই অনুধাবন করতেন তা’হলে আমার মনে হয় ‘পার্বত্য ভিক্ষু সংঘে’র সাথে তাঁর যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল তা কখনই হতো না। শ্রদ্ধেয় সাধনানন্দ মহাথের (বনভন্তে) জীবনের পড়ন্ত বিকালে এসে শিক্ষাকে যে গুরুত্বারোপ করেছেন এখন তাঁর শিষ্যম-লী এটি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন সেটা তাঁদের উপরই নির্ভর করবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধধর্ম বিকাশে মারমা-রাখাইন সম্প্রদায়ের অবদান এক উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে।  মারমা-রাখাইন  বৌদ্ধ ভিক্ষুরা নিজ সম্প্রদায়কে যেমন রক্ষা করেছেন তেমনি চাকমা বৌদ্ধ সমাজকে রক্ষা করার গুরু দায়িত্বও তাঁরা কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন যখন চাকমা সম্প্রদায়ের মধ্যে বৌদ্ধ ভিক্ষু সংখ্যায় কম ছিল তা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। এক সময় বাংলাদেশের বেশ কিছু অংশ আরাকানের শাসনাধীনে ছিল এখনো অনেক জায়গায় তার স্মৃতি বহণ করে। বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রামে তিনটি সার্কেলের মধ্যে মং সার্কেল ও বোমাং সার্কেল হল মগ সম্প্রদায়ের অধীনে। এই দুই সার্কেল প্রধান বা রাজারাও বৌদ্ধধর্ম বিকাশে অনন্য সাধারণ অবদান রেখেছিলেন। মগ ও রাখাইন সম্প্রদায় কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত অনেক কারুকার্যম-িত প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার রয়েছে সেগুলো বৌদ্ধধর্ম বিস্তারে যেমন অতুলনীয় অবদান রেখেছে তেমনি এদেশের বৌদ্ধ সভ্যতা শিল্প-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছে। মগ ও রাখাইন সম্প্রদায় থেকেও অনেক জ্ঞানী-গুণী-পন্ডিত ও প্রথিতযশা বৌদ্ধ ভিক্ষু জন্ম গ্রহণ করেছেন, যাঁরা শাসন সদ্ধর্ম রক্ষার্থে আজীবন নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন এবং করে যাচ্ছেন। বর্তমান সময়ে ভিক্ষু নাগসেন (লন্ডন প্রবাসী) ও উ. পঞ্ঞা জোত মহাথের (উচালা ভন্তে) দুইজন সংঘ মনীষা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে শাসন সদ্ধর্ম কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন। শ্রদ্ধেয় উ. পঞ্ঞা জোত মহাথের’র পুণ্যহস্তে বান্দরবানে বেশ কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন বৌদ্ধ জাদি নির্মিত হয়েছে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত জাদিগুলোর মাধ্যমে বৌদ্ধ শিল্পকলার যেমন বিকাশ ঘটেছে তেমনি বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পকেও সমৃদ্ধ করেছে। চাকমা বৌদ্ধ সমাজের মত মারমা বৌদ্ধ সমাজেও বিভেদ রয়েছে। তবে তাঁদের বিভেদ এত প্রকট নয়। কিন্তু কম হোক আর বেশী হোক কোন বিভেদই সমাজে কাম্য নয়।
ভগবান বুদ্ধ, নয়গুণ সম্পন্ন পবিত্র ‘ভিক্ষু সংঘ’কে মহাসমুদ্রের সাথে তুলনা করেছেন। সমুদ্রের বক্ষে  যেমন কোন প্রকার দুষিত পদার্থ ধারণ করতে পারে না তেমনই সমুদ্রের মত ‘ভিক্ষু সংঘ’ সব সময় স্বচ্ছ এবং পবিত্র। ব্যক্তি বিশেষে কোন একজন সংঘ সদস্য দুঃশীল, দুরাচার হতে পারে, কিন্তু ‘ভিক্ষু সংঘ’ কখনোই অপরিশুদ্ধ বা দুŦশীল হতে পারে না। বুদ্ধ বলেছেন সংঘের একতা শক্তি সর্বদায় সুখদায়ক। যখনই সংঘের মধ্যে ভেদ বীজ বপিত হয় তখনই একতা শক্তি ক্ষীণ হয়ে আসে। যেই সমাজে ঐক্যের ফাটল ধরে সেই সমাজ ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে, দুর্বল সমাজ ব্যবস্থায় জাতির অস্তিত্বের সংকট দেখা দেয়, অস্তিত্ব সংকটাপন্ন জাতির ধর্ম-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি অচিরেই ধ্বংস অনিবার্য।
 গৌতম বুদ্ধের কর্মক্ষেত্র বুদ্ধত্ব লাভ, ধর্ম প্রচার, ভিক্ষু-ভিক্ষুনী সংঘ গঠন, বৌদ্ধ গৃহী সংঘ গঠন সবই  ভারতবর্ষে। যে বৌদ্ধধর্ম ভারতবর্ষে উৎপত্তি এবং এখান থেকেই সারা বিশে^ বিস্তার লাভ করে, সে ধর্ম আজ নিজ মাতৃভূমি থেকে বিতারিত। ভারতবর্ষ থেকে বৌদ্ধধর্ম পতনের কারণ হিসেবে ঐতিহাসিকরা ব্রাহ্মণ্যধর্মের উত্থান, তুর্কী আক্রমণ ও বৌদ্ধধর্মের মধ্যে স্তরে স্তরে চরম দুর্নীতিকে দায়ী করেছেন। বৌদ্ধধর্ম ছিল বিহার কেন্দ্রিভূত। বৌদ্ধ বিহারগুলো ধ্বংস হওয়াতে ধর্মের পতন আরো ত্বরান্বিত হয়। সামাজিক বন্ধন ছিল দুর্বল। বৌদ্ধধর্ম প্রকৃত সত্তা, মৌল বৈশিষ্ট্য ও আদর্শ হারিয়ে অলৌকিকতা, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের প্রাচীর তুলে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ধরে রাখতে পারে নি। নিজ বাসভূমি থেকে বৌদ্ধধর্ম বিলুপ্তির কারণ গড়ে উঠেছিল বহুকাল আগেই। বৈশালীর দ্বিতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতির অব্যবহিত পরেই বৌদ্ধধর্মে ক্রমে বহু মতবাদের সৃষ্টি হওয়ায় বৌদ্ধ বহু দলে উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে বৌদ্ধ সঙ্গীতির মাধ্যমে এই বিবাদের নিরসনের চেষ্টা করা হলেও তা আরও প্রবল আকার ধারণ করে। এভাবে সংঘশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসাতে বৌদ্ধধর্ম যখন গুরুবাদে পরিণত হয় তখন থেকেই ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মের পতন শুরু হয়। দুŦখের বিষয় ইতিহাস থেকে বৌদ্ধরা এখনও পর্যন্ত শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ সমাজ নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে যতদূর অগ্রগতি লাভ করেছে তার চেয়ে বেশি এখন আত্মকলহ-বিবাদ ও দলাদলির কারণে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে বিপন্নের পথে ধাবিত হচ্ছে। আমরা এতই আত্মবিস্মৃত জাতি যে আবারো সেই পূর্বের অবস্থানে পা বাড়াচ্ছি। এই সমস্যা শুধু ধর্মীয়-সামাজিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়, রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও সমভাবে বিরাজমান। এই বিরাজমান সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হল ঐক্য এবং সংহতি। ঐক্য এবং সংহতি ধরে রাখতে হলে পূত-পবিত্র ভিক্ষু সংঘকে কোন প্রকার ভেদাভেদ করা যাবে না। ‘পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ’, ‘বন ভিক্ষু সংঘ’, ‘মারমা-রাখাইন সংঘ কাউন্সিল’ ‘‘দি ওয়ার্লড বুদ্ধ শাসন সেবক সংঘ’ ইত্যাদি অর্থাŤ পার্বত্য চট্টগ্রামে পূজনীয় ভিক্ষুসংঘের দ্বারা পরিচালিত যতগুলো সংগঠন আছে সবই করুণাঘন বুদ্ধ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত গুণোত্তম ভিক্ষু সংঘ, এ পবিত্র মনোভাব পোষণ করে সকলে একই মৈত্রীর পতাকা তলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সকলকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। এখানে কারোর অবদানকে খাটো করা যাবে না, অবমূল্যায়ন করাও সমীচীন নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যেক সংঘ সংগঠন যার যার অবস্থান থেকে দক্ষতা-যোগ্যতা ও সামর্থ্য অনুসারে সমাজ, জাতি ও দেশের কল্যাণে জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। কাজেই এখানে কাউকে খাটো করে দেখা মানে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারার সামিল। এই বিষয়টি পরম পূজনীয় ভিক্ষু সংঘকে যেমন উপলব্দি করতে হবে তেমনি গৃহী বৌদ্ধ সমাজকেও বুঝতে হবে যে, এই মুহূর্তে  ঐক্য ও মহামিলন ব্যতীত আমাদের কোন গত্যন্তর নেই। কারণ পরম পূজনীয় ভিক্ষু সংঘ আর গৃহী বৌদ্ধ সংঘ একে অপরের পরিপূরক। দুই চক্র গাড়ীর যেমন একটি চক্র নষ্ট হলে পর সমস্ত গাড়ী অচল হয়ে পড়ে, তেমনি ভিক্ষু সংঘ অথবা গৃহী বৌদ্ধ সংঘ দুটি থেকে যে কোনো একটি যদি কোন কারণে নড়েবড়ে হয় তা’হলে গোটা জাতি, সমাজ ব্যবস্থার উপর তার প্রভাব পড়ে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পন্ডিত-জ্ঞানী-যোগ্য ও দক্ষ ভিক্ষুসংঘের প্রচেষ্টায় এবং রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার মধ্য দিয়ে যুগে যুগে বৌদ্ধধর্মের ধারাবাহিক অগ্রগতি অব্যাহত ছিল। বৌদ্ধধর্মের এই অগ্রযাত্রাকে আরো বেগবান  করেছিল অন্ধভক্তি বর্জিত প্রজ্ঞাসম্পন্ন বৌদ্ধ সমাজের অকুণ্ঠ সমর্থনে।
কাজেই গৃহী বৌদ্ধ সমাজকে অবশ্যই প্রজ্ঞা সম্প্রযুক্ত শ্রদ্ধাবান হতে হবে। প্রজ্ঞা সম্প্রযুক্ত শ্রদ্ধাবান গৃহী বৌদ্ধ সমাজ না হলে আত্ম ত্যাগী সংঘ সদস্যগণের মূল্যায়ন হবে না। যে সমাজে জ্ঞানী-গুণীর সমাদর নেই, মূল্যায়ন নেই, সেই জাতি-সমাজে কখনোই জ্ঞানী-গুণী ভিক্ষু সংঘের আবির্ভাব হয় না। আমাদের বুঝতে যে, সাধক ভিক্ষু, প্রচারক ভিক্ষু ও সমাজ সংস্কারক ভিক্ষু এই ত্রি শ্রেণি ভিক্ষুর প্রয়োজনীয়তা এখন সময়ের দাবী। কারণ এই তিন শ্রেণি ভিক্ষুর অবদানেই আমাদের সমাজ আজ এতটুকু অগ্রসর হয়েছে। প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ রাউলী (লুরি) পুরোহিতদের অবদানও এখানে কোন অংশে কম নয়।
কালে কালে এদেশের বৌদ্ধ সমাজ অনেক ভুল করেছে। তাঁরা সংঘবদ্ধ ও শক্তিশালী গৃহী সমাজ বিনির্মাণ করতে না পারার কারণে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা রক্ষা করতে হিমশিম খেয়েছে, তখন এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অন্য সম্প্রদায় বৌদ্ধদেরকে গ্রাস করে ফেলে। বৌদ্ধদের এখন অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সম্মুখে এগুনোর সময় এসেছে । পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী বর্তমানে শিক্ষা-দীক্ষায়,অর্থ-বিত্তে,ব্যবসা-বানিজ্যে,চাকরীতে ও রাজনৈতিকভাবে অনেক অগ্রসর হয়েছে। তাঁরা সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে আরম্ভ করে জনপ্রতিনিধি, সংসদ সদস্য, প্রতিমন্ত্রী,পূর্ণমন্ত্রী ও সরকারের উপদেষ্টা হওয়ার পর্যন্ত সুযোগ পেয়েছে। এছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামের বহু ছেলেমেয়ে এখন সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অভিবাসী হিসেবে বসবাস করছে। তাঁরা সবাই যার যার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। সমাজের এরকম অগ্রগতি আজ থেকে বিশ ত্রিশ বছর আগেও ছিল কল্পনাতীত। বর্তমানে বৌদ্ধ সমাজ যে অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে তার উপর ভিত্তি করে সংঘবদ্ধ ও শক্তিশালী গৃহী সমাজ গড়ার দিকে  মনোনিবেশ করতে হবে। সংঘবদ্ধ ও শক্তিশালী সমাজ ব্যবস্থার মূল ভিত রচনা করতে হবে বুদ্ধের নৈতিক শিক্ষা ও মানবিক মূল্যবোধের উপর। এই নৈতিক শিক্ষা প্রথমে পরিবার থেকে শুরু করতে হবে, পরিবার থেকে সমাজে, সমাজ থেকে বিহার ভিত্তিক প্রচলন করতে হবে। কারণ আগেকার বিহারগুলো ধর্ম শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু ছিল, সেখানে চরিত্র গঠন থেকে শুরু করে জ্ঞানচর্চা করা হত। বর্তমানে বিহারগুলি অনেকটা আনুষ্ঠানিক যজমান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। সেকারণে যুবসমাজ এক সর্বনাশা মাদকের ছোবলে প্রতিনিয়ত বিপথগামী হচ্ছে। শুধু তরুণ-তরুণীরা বিপথগামী হচ্ছে তা নয়, সমাজের বিরাট একটা অংশ এই মাদকের ছোবলে আক্রান্ত হয়ে এখন ছন্দহারা। সমাজকে অচিরেই এই ঘূর্ণাবর্ত থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তা না হলে সম্মুখে প্রতি পদক্ষেপে এক মহাবিপদ অপেক্ষমান।
দালাই লামা হচ্ছেন তিব্বতের আধ্যাত্মিক প্রধান ধর্মীয় গুরু ও শাসনতন্ত্রের শীর্ষ পদাধিকারী। তিনি তিব্বতে শান্তিরক্ষার ক্ষেত্রে অবদানের জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেছেন। ১৯৫৮ খ্রীস্টাব্দে চীন কর্তৃক তিব্বত অধিগৃহীত হওয়ার পর কিছু অনুগামীসহ তিনি গোপনে দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেন। তিনি এখনো পর্যন্ত ভারতের ধর্মশালায় শরণার্থী হিসেবে বাস করছেন। তিনি তাঁর অনুগামীদের নিয়ে শরণার্থী হিসেবে যেদিন ভারতের মাটিতে পা রেখেছিলেন সেদিন থেকে তাঁর একটাই লক্ষ্য ছিল বুদ্ধের নৈতিক শিক্ষার উপর ভিত্তি করে তাঁর অনুসারীদেরকে সুসংগঠিত করার মাধ্যমে সামনের পথ এগিয়ে চলা। বিদেশ, বিভূঁই-এ অবস্থান করেও তিনি তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য কঠোর ত্যাগ-তিতিক্ষা, দূরদর্শিতা, তীক্ষè বুদ্ধিমত্তা ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের গুণে জাতিকে সুসংগঠিত করে তিনি এক শক্তিশালী সমাজ গড়ে তুলেন। দালাই লামার সঠিক দিক নির্দেশনায় তাঁর অনুসারীরা ভারতের নাগরিকদের চেয়েও এখন শিক্ষা-দীক্ষা,ব্যবসা-বানিজ্যসহ সর্বক্ষেত্রে উন্নতির শিখরে আরোহণ করেছে। দূরদর্শি সম্পন্ন যোগ্য নেতা ও একতা শক্তি এই দু’য়ের সমন্বয় ঘটলে একটা পরাধীন জাতিও যে মাথা উচু করে দাঁড়াতে পারে তা আজ তিব্বতীরা বিশ^বাসীকে দেখিয়ে দিয়েছেন। এটা পার্বত্য অঞ্চলের বৌদ্ধদের জন্য এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।
বর্তমান বিশ্বায়নের যুগের সাথে তাল মিলিয়ে টিকে থাকতে হলে সেই পুরানো মান্ধাতা আমলের চিন্তা-চেতনা,ধ্যান-ধারণা ও ধর্মীয় গোড়ামী নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। এগুলো পরিত্যাগ করে যুগোপযোগী পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। বৌদ্ধধর্মের মধ্যে কোন প্রকার ধর্মীয় গোড়ামী, অলৌকিকতা ও অন্ধবিশ^াসের স্থান নেই। বৌদ্ধধর্ম হচ্ছে বাস্তবসম্মত, জীবনমুখী ও বিজ্ঞান ভিত্তিক ধর্ম। কারণ বুদ্ধ স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা করে যুগের সাথে সামঞ্জস্য রেখে নিয়ম-নীতি,বিধি-বিধান পরিবর্তনের জন্য আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগেই ভিক্ষু-গৃহী উভয়সংঘকে তাগিদ দিয়ে গেছেন। সমাজে পরম্পরা প্রচলিত, অথচ জাতি গঠনে, সমাজ উন্নয়নের পথে প্রতি পদে পদে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, এসমস্ত বিধি-বিধান, রীতি-নীতিগুলো সম্মিলিতভাবে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে প্রয়োজনে সংযোজন-বিয়োজন করতে হবে। আধুনিক বৌদ্ধবিশ^ কিভাবে অগ্রসর হচ্ছে, কিভাবে সর্বক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে আছে, কিভাবে বহির্বিশে^ নিজেদের অবস্থান তুলে ধরছে, সেদিকে লক্ষ্য রেখে তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেই আমাদেরকে অগ্রসর হতে হবে। বুদ্ধের নৈতিক শিক্ষার পাশা পাশি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, মানসম্মত ও সৃজনশীল শিক্ষা, ব্যবসা-বানিজ্য, চাকরী, সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা ও আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এক কথায় সর্বক্ষেত্রে সমান যোগ্যতা ও দক্ষতা অর্জনের মধ্য দিয়ে আমাদেরকে একবিংশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। আত্ম অহমিকা, সংকীর্ণতা পরিত্যাগ করে সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত সমগ্র আদিবাসী জনগোষ্ঠী একই কাতারে মিলিত হয়ে নিজের ধর্ম-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য  ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
অধিকন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী ও সমতলের বাঙালী বৌদ্ধদের মধ্যে মত-পথ-সংস্কৃতি ভিন্ন থাকতেই পারে, কিন্তু  আমাদের পরিচয় এবং লক্ষ্য হতে হবে এক এবং অভিন্ন। সেটা হচ্ছে আমরা সকলেই বুদ্ধের অনুসারী। পাহাড়ের আদিবাসী বৌদ্ধদের সাথে সমতলের বাঙালী বৌদ্ধদের মধ্যে এযাবৎ যে মৈত্রীর সেতু বন্ধন রচিত হয়েছে তা আরো অধিকতর সুদৃঢ় করতে হবে। পাহাড়ের আদিবাসী বৌদ্ধ ও সমতলের বাঙালী বৌদ্ধদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত যে সমস্ত সংগঠন রয়েছে সকল সংগঠনের কার্যক্রম ব্যক্তি স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে সামগ্রিক স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। এছাড়াও একে অপরের সুখে-দুŦখে,আপদে-বিপদে যার যার অবস্থান থেকে শক্তি ও সামর্থ্য অনুসারে নিজের গুরু দায়িত্ব মনে করে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করতে হবে। এর পাশাপাশি বৌদ্ধ প্রধান দেশগুলোর সাথে  বৌদ্ধ সংস্কৃতি আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে একটা মৈত্রীর সেতুবন্ধন ও সুনিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। নচেৎ একবিংশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
লেখক পরিচিতি : ড. অমর কান্তি চাকমা, প্রভাষক, বনফুল আদিবাসী গ্রীন্ড হার্ট স্কুল এন্ড কলেজ, মীরপুর, ঢাকা।

No comments

Theme images by 5ugarless. Powered by Blogger.