পাহাড়ের ঘটনাগুলো আমাকে দ্বিখণ্ডিত করে দেয়
লুতফুন নাহার লতা:
পাহাড়ের ঘটনাগুলো আমাকে দ্বিখণ্ডিত করছে। পাহাড়ের মানুষগুলো যে আমাদের মতোই মানুষ, সেই কথাটি কি আমরা ভুলে যাচ্ছি! দীর্ঘকাল ধরে পাহাড়ে প্রতিকারহীন অন্যায় সংঘটিত হচ্ছে। ধরপাকড়, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, হত্যা, গুম এসব চলছে।
অতি সম্প্রতি রাঙ্গামাটির অনতিদূরে বিলাইছড়িতে যে দুটি মারমা মেয়ে বাংলাদেশ আর্মির সদস্যদের হাতে নির্যাতিত হয়েছে, তাদের একজনকে নির্মমভাবে ধর্ষণ ও অন্যজনকে যৌন নির্যাতন করা হয়েছে। আমি অতিসত্বর এই ভয়াবহ অপরাধের জন্যে বাংলাদেশ আর্মির সেই সব সদস্যদের চাকরিচ্যুতি, সুষ্ঠু বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই। এরাই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। জনগণ নয়।
মেয়ে দুটি নিরপরাধ। মেয়ে দুটি অসহায়। তল্লাশির নামে ওদের বাবা মায়ের সামনে অস্ত্রের মুখে ওদের উপর এই পাশবিক নির্যাতন করা হয়েছে। এখন হাসপাতালে ওদেরকে একরকম আটক রাখা হয়েছে নিরাপত্তার নামে। আমি বাংলাদেশের সকল মানিবাধিকার সংগঠন গুলির কাছে প্রার্থনা করছি ওদের পাশে দাঁড়ানোর জন্যে।
আমরা যারা ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্মম নির্লজ্জ অমানবিক অপরাধ প্রত্যক্ষ করেছি, তারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের কাছে এই নিষ্ঠুর নির্লজ্জতা কল্পনাও করতে পারি না। এই ঘটনা বারে বারে আমাদেরকে ভয়ানকভাবে অপ্রস্তুত করে। লজ্জিত করে। মানুষ হিসেবে মাথা হেঁট করে দেয়।
প্রিয় প্রধানমন্ত্রীকে দেখেছি এধরনের ঘটনায় অন্য মেয়েদেরকে দু’হাত বাড়িয়ে বুকে টেনে নিতে, ওদের পাশে দাঁড়াতে, ওদেরকে মা বলে সম্বোধন করতে। এই মারমা মেয়ে দুটি তো কোনো অপরাধ করেনি! ওরা কোন দলেরও না। ওরা নিরীহ দুটি বোন, নিজের দেশ, রাজনীতি, রাষ্ট্র ব্যবস্থা, সমাজ, পরিবেশ, পরিস্থিতির শিকার ওরা। আমি অবাক হচ্ছি, প্রধানমন্ত্রী কি জানেন না এই মর্মান্তিক ঘটনার কথা!
সারাদেশের সকল সুশীল, লেখক, কবি, সাংবাদিক, মানবতাবাদী লোকজন কেউ টুঁ শব্দ করেছেন বলে মনে হয় না। সবাই চুপ! যে দেশ, যে দেশের মানুষ, যে সমাজ, যে রাষ্ট্রযন্ত্র, আইন আদালত ভিকটিমের পাশে দাঁড়াতে পারে না, অপমানিতের পক্ষে থাকে না, নিরাপত্তা নিয়ে পাশে এগিয়ে আসতে পারে না, তাকে আমরা কী বলবো! ধিক্কার দিয়ে বা ঘৃণা জানিয়ে কি শেষ করা যাবে! তাতে সমস্যার সমাধান হবে না। পাহাড়ে এই অন্যায় বন্ধ হতে হবে। সেনা বাহিনীর সদস্যদের হাতে এই লাঞ্ছনা, হত্যা, গুম, খুন মেনে নেয়া যায় না।
পাহাড়ে বাঙালী সেটেলার ও সেনাবাহিনী কখনো যৌথ কখনো আলাদাভাবে আদিবাসীদের উচ্ছেদ, তাঁদের সম্পত্তি জবরদখল করার জন্যে কিছুদিন পর পরই এ ধরনের নির্যাতন চালাচ্ছে আর সরকার, সমতলের বাঙালিরা, দেশের সুশীল, কুশীল সবাই আমরা চুপ! কিন্তু চুপ করে থাকলেই এই সমস্যার সমাধান তো হবে না। দিনে দিনে দেনা বাড়বে আরো, তখন ঋণ শোধের সময় আসবেই। একটি দেশের সকল নাগরিকের সমান অধিকার থাকাটা খুবই জরুরি। অন্যথায় এই সকল অন্যায়ের ভার একদিন অনেক বড় বিপর্যয়ের সৃষ্টি করবে।
পাহাড়ে এমন ঘটনা নতুন নয়, যুগ যুগ ধরে চলছে এই নির্যাতন। নিকট অতীতের কল্পনা চাকমা থেকে আজ পর্যন্ত অগণিত নারী পুরুষ অত্যাচারিত হয়েছে, হচ্ছে প্রতিনিয়ত। গুম, খুন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ হয়েছে। বিচার! না বিচার হয়নি। যুগ যুগ ধরে বিচারহীনতার মধ্যে হারিয়ে গেছে এমনি কত শত ধর্ষণের ইতিহাস৷ এই নির্মমতা, এই অমানবিক অপরাধের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ হওয়া দরকার। না হলে মানুষ হিসেবে আমরা এর দায় থেকে মুক্তি পাবো না।
আশাপ্রদ ঘটনা যে চাকমা সার্কেলের রাজা দেবাশীষ রায় ও রাণীমাতা ইয়েন ইয়েন মেয়েগুলোর পাশে পাশে থাকছেন৷ আর পাহাড় ও সমতলের সকল বাঙালী এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন সেই আশাও জাগিয়ে রাখি মনে।
এমন দিন আসুক যেদিন বাংলাদেশের সকল নারী হবে মুক্ত, স্বাধীন। তাকে টোকা দেবার ক্ষমতা হবে না কারো। নারীর প্রতি সহিংসতা আনচ্যালেঞ্জেড, আনপানিশড যাবে না। নারীর সকল অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে সে বিজয়ী হবে। বিচারের বাণী আর নীরব থাকবে না, সে বাজুক মঙ্গল শঙ্খে।
No comments
Post a Comment