সীতাকুণ্ডে জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযান
সীতাকুণ্ডে জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযান
গাজী ফিরোজ ও কৃষ্ণ চন্দ্র দাস, সীতাকুণ্ড থেকে
১৬ মার্চ ২০১৭, ০৯:২৭
প্রিন্ট সংস্করণ
৫
সীতাকুণ্ডের প্রেমতলা চৌধুরীপাড়া এলাকা গতকাল বিকেল থেকে ঘিরে রাখে সোয়াট। িবকেল পাঁচটায় তোলা ছবি l সৌরভ দাশসীতাকুণ্ডের প্রেমতলা চৌধুরীপাড়া এলাকা গতকাল বিকেল থেকে ঘিরে রাখে সোয়াট। িবকেল পাঁচটায় তোলা ছবি l সৌরভ দাশ
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড পৌরসভার প্রেমতলা চৌধুরীপাড়া এলাকার ‘ছায়ানীড়’ নামের দোতলা একটি বাড়ি গতকাল বুধবার বেলা সাড়ে তিনটা থেকে ঘিরে রেখেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। রাত ১১টা পর্যন্ত বাড়ির ভেতর থেকে তিন দফায় পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ও বোমা ছুড়ে মারে জঙ্গিরা। এতে পুলিশের এক কর্মকর্তা আহত হন।
জঙ্গি আস্তানা লক্ষ্য করে পুলিশও কয়েক দফা গুলি ছোড়ে। এর আগে বিকেল পাঁচটা ও সন্ধ্যা ছয়টায় দুই দফা ওই বাড়িতে থাকা জঙ্গিদের বের হওয়ার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হয়। তবে ভেতর থেকে জঙ্গিরা সাড়া দেয়নি। চার ফ্ল্যাটের বাড়িটির নিচতলার একটি ফ্ল্যাটে জঙ্গিরা অবস্থান করছে বলে ধারণা পুলিশের। সেখানে কতজন জঙ্গি অবস্থান করছে, সে সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু জানাতে পারেনি পুলিশ।
ওই বাড়ির বাকি তিনটি ফ্ল্যাটে তিনটি পরিবারের ১৪ থেকে ১৫ জন সদস্য আটকা পড়েছে। এ ছাড়া এলাকাটি ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় রাত দেড়টা পর্যন্ত বাড়িটির ভেতরে অভিযান শুরু করেনি পুলিশ।
গত রাত সাড়ে নয়টায় ঘটনাস্থলে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার নুরে আলম সাংবাদিকদের বলেন, জঙ্গিরা ভেতরে কাউকে জিম্মি করেনি। তাঁর ধারণা, জঙ্গিরা নব্য জেএমবির সদস্য।
বাড়ির একটি ফ্ল্যাটে পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকেন সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. সেলিম। তিনি বলেন, তাঁর স্ত্রী ও সন্তানেরা বাড়িতে আটকা পড়েছে। তিনি তাদের দরজা-জানালা বন্ধ করে ভেতরে বসে থাকতে বলেছেন।
গত রাত পৌনে একটায় দু্টি মাইক্রোবাস ও একটি পিকআপ ভ্যানে করে ঢাকা থেকে সোয়াট দলের সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছান। এর আগে ঢাকা থেকে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একটি দল আসে। আর আগেই চট্টগ্রাম থেকে র্যাব, সোয়াট (স্পেশাল উইপনস অ্যান্ড ট্যাকটিকস) ও পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের সদস্যরা সেখানে যান।
কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পরিদর্শক জহির উদ্দিন বলেন, ভেতরে থাকা জঙ্গিদের কাছে শক্তিশালী বোমা থাকতে পারে।
পুলিশের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, শেষ রাতে বা ভোরে আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে অভিযান শুরু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
অভিযানে থাকা সোয়াট টিমের সদস্য এসআই লিয়াকত আলী মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, অভিযান চালানোর জন্য তাঁরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ওই বাসায় থাকা সাধারণ বাসিন্দাদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে তাঁরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
সীতাকুণ্ড পৌরসভা এলাকার একজন বাড়ির মালিকের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এই জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পায় পুলিশ। গতকাল বেলা তিনটায় ওই বাড়ির মালিকই প্রথমে পৌরসভার আমিরাবাদ এলাকায় তাঁর দোতলা বাড়িতে পুলিশকে ডেকে আনেন। বাড়ির ভাড়াটে জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত এমন সন্দেহের কথা পুলিশকে জানান তিনি। পরে পুলিশ বাড়ির নিচতলার একটি ফ্ল্যাট থেকে তিনটি গ্রেনেড, একটি সুইসাইড ভেস্ট (আত্মঘাতী হামলার জন্য বোমার তৈরি বেল্ট), পিস্তল, বুলেট, বোমা তৈরির বিপুল সরঞ্জামসহ গ্রেপ্তার করা হয় এক দম্পতিকে। তাঁদের সঙ্গে দুই মাসের একটি শিশুও রয়েছে।
গ্রেপ্তার দুজনের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই প্রেমতলা চৌধুরীপাড়া এলাকার ছায়ানীড় বাড়িতে অভিযানে যায় পুলিশ। সেখানে পৌঁছার পরপরই বাড়ির ভেতর থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে প্রথমে গ্রেনেড ছুড়ে মারা হয়। এতে স্প্লিন্টারের আঘাতে আহত হন সীতাকুণ্ড থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোজাম্মেল হক। এর পরপরই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বাড়িটি ঘিরে রাখেন।
আমিরাবাদ এলাকার বাড়িটি থেকে প্রেমতলা চৌধুরীপাড়ার ছায়ানীড় বাড়িটি (বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত ঘিরে রাখা) প্রায় এক কিলোমিটার দূরে।
পুলিশ জানায়, গত রাত সোয়া নয়টায় ছায়ানীড় বাড়ির ভেতর থেকে কয়েকটি গুলি ছোড়া হয়। ৩০ মিনিট পর রাত পৌনে ১০টায় পরপর দুটি গ্রেনেড ছুড়ে মারে জঙ্গিরা। এরপর বাড়িটি লক্ষ্য করে কয়েকটি গুলি ছোড়ে পুলিশ। রাত সাড়ে ১১টার পর বাড়িটি লক্ষ্য করে প্রায় ১০ মিনিট পরপর ফাঁকা গুলি ছোড়ে পুলিশ। এ সময় কয়েকবার বাড়ির ভেতরেও গুলির শব্দ শোনা যায়।
এর আগে ৮ মার্চ রাতে সীতাকুণ্ডের পাশের উপজেলা চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের একটি বাড়ি থেকে ২৯টি বোমা ও ৯টি চাপাতি উদ্ধার করে পুলিশ। সেদিন বিকেলে কুমিল্লার চান্দিনায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বাসে তল্লাশি চালানোর সময় পুলিশকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছুড়ে মারে দুই জঙ্গি। মিরসরাইয়ের ওই বাড়িতে তারা ভাড়া থাকত।
গতকাল বিকেল সাড়ে পাঁচটায় প্রেমতলা চৌধুরীপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, ছায়ানীড় বাড়িটির চারপাশ ঘিরে রেখেছে পুলিশ। রয়েছেন র্যাব সদস্যরা। আশপাশের প্রায় ৫০০ গজের মধ্যে পুলিশি পাহারা রয়েছে। পুলিশের বেষ্টনীর বাইরে উৎসুক কয়েক শ লোক ভিড় করেছে। গণমাধ্যমকর্মীদেরও বাড়িটির পাশে যেতে দেওয়া হয়নি। অভিযানের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পুলিশের পক্ষ থেকেও তখন কিছু জানানো হয়নি।
স্থানীয় কাউন্সিলর শফিউল আলম ঘটনাস্থলে গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, দোতলা ওই বাড়িতে দুটি করে চারটি ইউনিট রয়েছে। নিচতলার একটি ইউনিটে জঙ্গিরা রয়েছে বলে তাঁদের ধারণা।
বাড়িটির পাশের বাড়ি স্থানীয় শিক্ষক হরিপদ দেবনাথের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক বছর আগে বাড়ির মালিক মারা গেছেন। তাঁর স্ত্রী ও এক ছেলে রয়েছে। বছরখানেক আগে ওই বাড়িতে নুরানি মাদ্রাসা ছিল। পরে সেটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। তিনি শুনেছেন, যে ভাড়াটেকে পুলিশ জঙ্গি বলছে, তারা ১৫ দিন আগে বাসাটি ভাড়া নিয়েছে।
পৌরসভার এক কিলোমিটার এলাকার মধ্যে দুটি
জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পাওয়ায় লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। গতকাল রাত আটটার দিকে প্রেমতলা এলাকার দোকানপাট বন্ধ করে দেওয়া হয়। চা দোকানের কর্মচারী জসিম উদ্দিন বলেন, অন্য দিন রাত ১০টার দিকে দোকান বন্ধ করা হলেও আতঙ্কে তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করে দিয়েছেন তাঁরা।
এর আগে গতকাল বেলা তিনটায় আমিরাবাদ এলাকার ‘সাধন কুটির’ নামের বাড়ির নিচতলার ফ্ল্যাট থেকে গ্রেপ্তার করা হয় জসিম উদ্দিন ও আর্জিনা বেগমকে।
বাড়ির মালিক সুভাষ দাসের ভাষ্য, গত ২৮ ফেব্রুয়ারি স্ত্রী ও দুই শ্যালককে নিয়ে বাড়ি ভাড়া করতে আসেন জসিম। ৪ মার্চ তাঁরা একটি ফ্ল্যাটে ওঠেন। তবে ভাড়া নেওয়ার পর থেকে বাড়ির দরজা-জানালা সব সময় বন্ধ রাখতেন জসিম। ভাড়া দেওয়ার সময় জসিমের কাছ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি নেন তিনি। গত মঙ্গলবার রাতে জসিমের বাসায় ঢোকেন তিনি। দেখতে পান সেখানে প্রচুর তার, সার্কিট। এসব দিয়ে কী করা হয় জানতে চাইলে জসিম উত্তর দেন, তাঁরা সার্কিট ও লাইট বানানোর কাজ করেন। সেখান থেকে একটি সার্কিট নিয়ে আসেন তিনি। তাঁর পরিচিত এক বিদ্যুৎমিস্ত্রিকে সার্কিটটি দেখান। মিস্ত্রি তাঁকে বলেন, এটা টাইমার। এতে তাঁর সন্দেহ আরও বাড়ে।
সুভাষের ভাষ্য, গতকাল সকালে জসিমের জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই করে জানতে পারেন, এটি ভুয়া। এরপর তাঁদের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় ধ্বস্তাধস্তি হয়। পরে তিনি পুলিশকে খবর দেন।
অভিযানের বিষয়ে পুলিশের দাবি, বাসায় প্রবেশের চেষ্টা করার সময় তাদের বাধা দেন জসিম ও আর্জিনা। একপর্যায়ে পুলিশ জোর করে বাসায় প্রবেশ করলে আর্জিনা তাঁর কোমরে হাত দিতে যান। সেটা দেখে বাড়িওয়ালা ও তাঁর স্ত্রী ওই নারীর দুই হাত ধরে ফেলেন। পরে পুলিশ জসিম ও আর্জিনার কোমর থেকে সুইসাইড ভেস্ট উদ্ধার করে।
সীতাকুণ্ড সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রেজাউর রহমান বাড়ির সামনে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, দেশে জঙ্গিবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে বাড়িওয়ালাদের সচেতন করা হচ্ছিল। বাসা ভাড়া দেওয়ার আগে ভাড়াটেদের সম্পর্কে তথ্য জানার আহ্বান জানানো হচ্ছিল। গতকাল বেলা আড়াইটার দিকে এই বাড়ির মালিক ভাড়াটেকে জঙ্গি সন্দেহে পুলিশকে খবর দেন। খবর পাওয়া মাত্র পুলিশ এসে বাড়িটি ঘেরাও করে ফেলে।
তথ্যসূত্র: প্রথম আলো,
No comments
Post a Comment