আদিবাসী বীরাঙ্গনা চাইন্দাউ মারমা


প্রতি রাতেই আসতো তারা, একজন নয় কয়েকজন, একবার নয় একাধিকবার। কখনও একজন একজন করে আবার কখনও বা কয়েকজন জন একসাথে। বিছানাটা রক্তে ভরে যেতো প্রায়ই। রাত থেকে শুরু হতো নির্যাতন। ভোররাত পর্যন্ত চলতো এমন। মাঝে মাঝে বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকতাম।

একটা ঘরে অনেকগুলো মেয়েকে একসাথে আটকে রাখতো। রাত হলেই পশুগুলো আসতো। বড় বড় অফিসারেরা বেছে নিতেন আমাদের মধ্যে থেকে পছন্দমতো একজন একজন করে। বাকি যারা থাকতো তাদেরকেও ছাড় দেওয়া হতো না। রাতভর চলতো ভয়ঙ্কর নির্যাতন। যখন আমাদেরকে বাতিল, অপ্রয়োজনীয় মনে হতো অথবা কেউ অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়তো তখন কাউকে গুলি করে মেরে ফেলা হতো। আবার কাউকে তাদের অন্যান্য কাজের জন্য যেমন কাপড় পরিষ্কার, রান্নাবান্না এসবের জন্য রেখে দিতো। অনেক মেয়ে পালাতে গিয়ে মারা পড়তো। কেউ মরে গিয়ে বেঁচে যেতে চাইলেও আত্মহত্যা করার মতো সুযোগও ছিলো না কোনো।

অনেক সময় পরার জন্য কোন কাপড় দিতো না, অনেকসময় একটা পাঞ্জাবি অথবা একটা লুঙ্গির মতো কিছু একটা গায়ে জড়িয়ে নিজেদের ঢেকে রাখার চেষ্টা করতাম। একটা ঘরে আটকে রাখা হতো সবাইকে। দুই-একদিন পরপর খাবার দেওয়া হতো।

এতো নির্যাতনের পরও ক্ষুধার কষ্টে গোগ্রাসে খাবারগুলো খেতাম। বাড়ির কথা, পরিবারের কথা মনে পড়তো অনেক। ছাড়া পেলে কোনো একসময় ঠিকই বাড়ি যাবো বলে ভাবতাম। ভুল ভাবতাম, মরে যাওয়ার কথা ভাবলেই পারতাম আসলে।

অনেক মেয়েরা পাগলের মতো আচরণ করতো। ধনী-গরীব, উঁচু জাত, নিচু জাত, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, কিশোরী, যুবতী, বাঙালি-আদিবাসী বলে কোনো ভেদাভেদ ছিলো না। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের হাতে নির্যাতিত বীরাঙ্গনাদের কাছ থেকে পাওয়া নির্যাতনের বর্ণনাগুলো প্রায় এমনই। নির্যাতিত হয়েছিলেন বাঙালি মেয়েরা, নির্যাতিত হয়েছিলেন আদিবাসী মেয়েরাও।

বাঙালি বীরাঙ্গনাদের কথা হয়তো আমরা জানি কিন্তু আদিবাসী মেয়েদের সাথেও যে এমন নির্মম অনেক ঘটনা ঘটেছিলো, সেইসব আদিবাসী বীরাঙ্গনাদের কথা আমরা অনেকেই হয়তো জানি না।

মায়ারানী মুরারিঃ

এক রাতে দেখি পাকিস্তানি সৈন্যরা দৌড়াদৌড়ি করছে। কারো কাছ থেকে কিছু জানতে পারছিলাম না কি হচ্ছিলো। পরে জানতে পারলাম তাদের বড় কোন অফিসার আসছে। সন্ধ্যার সময় আমাকে সাবান দিয়ে ভালো করে গোসল করতে বললো। একটু পরে কয়েকজন এসে নিয়ে গেলো বড় অফিসারের রুমে। আমাকে ভালো করে দেখলো। আসলে আমাকে নয়, আমার শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে। সেই রাতে ৫০ বারের মতো আমি নির্যাতিত হয়েছি। সবাই মিলে একজন অন্যকে বাহবা দিচ্ছিলো। আমি মরার মতোন পড়ে ছিলাম। রাত থেকে সকাল পর্যন্ত এমন নির্যাতন চলেছিলো।


বীরাঙ্গনা চাইন্দাউ মারমা
সুভদ্রা বুনারাজিঃ

সেদিন মধ্যরাত ছিলো। আমরা সবাই ঘুমাচ্ছিলাম। হঠাৎ মিলিটারি হামলা করলো আমাদের বাড়িতে। আমরা দু’বোন একইসঙ্গে ঘুমাতাম। প্রথমে আমার ছোট বোনের উপর তারপর আমাকে নির্যাতন করলো। ব্যথা-যন্ত্রণায় আমরা দু’বোন ছটফট করছি। এরই মধ্যে হঠাৎ আমাদের এই অবস্থায় টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে তুললো। ক্যাম্পে যখন নিয়ে যাচ্ছিলো আমাদের গায়ে কোন কাপড় ছিলো না। আমাকে আর আমার বোনকে আলাদা করে ফেলা হলো ক্যাম্পে এসে। একটি ঘরে আমাকে ঢুকানো হলো। সেখানে আরও ১০-১৫ জন মেয়ে ছিলো। আমার এই অবস্থা দেখে একজন আমাকে একটা কাপড় এগিয়ে দিলো। আমার শরীরের রক্তে সেই কাপড়টিও ভিজে গেলো। সেই রক্তক্ষরণ থেমে ছিলো যুদ্ধেরও অনেক পরে। কিভাবে বেঁচে গেলাম জানি না। টানা নির্যাতনের সময় মাঝে মাঝে অনুনয় করতাম একটু দয়া করতে। একটু ছাড় দিতে অন্তত ২/১ ঘন্টার জন্য। মাঝে মাঝে বমি করে ভাসিয়ে দিতাম। একসময় আমার জরায়ুর মুখটার চারপাশে পচন ধরা শুরু হয়। একদিন এক মিলিটারি নির্যাতন করতে শুরু করলেই গলগল করে রক্ত বেড়িয়ে পড়ে। তাতে করে তার মেজাজ বিগড়ে যায়। আর তার শাস্তিস্বরুপ আমার একটি স্তন কেটে নেওয়া হয়েছিলো।

থোঁঞ তনচংগ্যাঃ

আমার নাম শোভা তনচংগ্যা। আমার ছোট বোন থোঁঞ তনচংগ্যা। যুদ্ধের সময় তার বয়স ১৫/১৬ ছিলো। তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো সেই সময় পাকিস্তানী ক্যাম্পে। ৫/৬ মাস আটক ছিলো সেখানে। দেশ যখন স্বাধীন হলো আমরা তাকে খুঁজে পাই। সে তখন মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েছিলো। কারও সাথে কথা বলতো না, স্নান করতো না। পুরুষ মানুষ দেখলে লুকানোর চেষ্টা করতো। সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত। শরীরের কিছু কিছু জায়গায় পচন ধরেছিলো। তাকে আমরা সবাই মিলে মামা বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম। পাঠিয়ে দিয়েছিলাম এই কারণে নয় যে সে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছিলো। পাঠিয়ে দিয়েছিলাম কারণ আমাদের এলাকায় তাকে কেউ থাকতে দিচ্ছিলো না। মানুষ বিরক্ত করতো, কুপ্রস্তাব দিতো, রাতে ডাকাডাকি করতো। একসময় সে পুরোপুরি পাগল হয়ে গেলো। এই পাগল অবস্থায় তার একটি বাচ্চা হয়েছিলো। দেশ স্বাধীন হলো ঠিকই কিন্তু তার আর কোন জীবন হলো না। সবাই ছি ছি করে তাকে! কেউ গ্রহণ করে না।

এমন আরও অনেক আদিবাসী নারীদের অনেক কষ্টের আর ত্যাগের ইতিহাস জড়িয়ে আছে এই স্বাধীন বাংলাদেশের সাথে। তাঁদের অনেকের জীবনে একাত্তর এখনও থামে নি। সেই গৌরবময় একাত্তর নিয়ে তাঁদেরকে গৌরবান্বিত হতে দেয় নি আমাদের সমাজ। অনেক বীরাঙ্গনাদের পরিবার তাঁদেরকে মেনে নেয় নি, অনেক স্বামী নিজের অর্ধাঙ্গিনী করে নিতে অস্বীকার করেছিলো কাপুরুষের মতো। তাঁরা বেঁচে আছেন আত্মগোপন করে নিজের পরিচয়ে, অনেকে জীবন্মৃত হয়ে। তাঁদের সাথে ঘটে যাওয়া দুর্বিষহ অতীতকে মুছে দেওয়ার মতো বীরত্বের অনেক অভাব আমাদের সমাজে। তার চেয়ে তাঁদের ‘কলঙ্কিনী’ উপাধি দিয়ে সমাজচ্যুত করে রেখে দিয়ে পাকিস্তানিদের সাধুবাদ দিয়ে তাদের পা চাটার মতো অনেক নির্লজ্জ মানুষের ঢের আধিক্য আজকাল।

পাকিস্তানিদের কাছ থেকে পাওয়া বর্বর নির্যাতনের কষ্ট হয়তো ভুলিয়ে দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিলো না কিন্তু এই কষ্টগুলোকে ছাপিয়ে বীরাঙ্গনার জন্য প্রাপ্য সম্মানটুকু দেওয়ার ক্ষেত্রেও আমাদের কত দীনতা।

৭১-এ পাকিস্তানিদের নির্যাতনের তাণ্ডবে তাঁরা হয়তো সকল কষ্ট বিনাবাক্যে সহ্য করেছিলেন কিন্তু তার পরের সময়টাতেও বেঁচে ছিলেন সমাজের চোখ রাঙানির ভয়ে ভয়ে, কখনও কখনও পরিবার, কাছের মানুষদের অবহেলা, অসম্মান, ঘৃণার কাছে মুখ লুকিয়ে। এখনও হয়তো বেঁচে আছেন অনেকেই।

৭১-এ পাকিস্তানিদের কাছে নির্যাতিত সেসব মেয়েদের পরিচয় ছিল একটাই; ‘বাংলাদেশী’। কিন্তু ৭১-এর পরবর্তীতে আমরা হিসাবের খাতা খুলে বসি কে বাঙালি আর কে সেটা আদিবাসী নিয়ে। পাকিস্তানিরা বিষ ঢুকিয়ে দিয়ে যেতে চেয়েছিলো তাদের বীর্যের মধ্য দিয়ে বীরাঙ্গনাদের শরীরে। যাতে কিছু পাকিস্তানি থেকে যায় আজন্ম এই দেশে। কিন্তু তারা হিসেবে সামান্য ভুল করেছিলো। ‘পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ’ লালনের জন্য পাকিস্তানি বীর্যের প্রয়োজনীয়তা হার মানিয়ে গেছে এই দেশের মানুষদের মানসিকতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি আর ইতিহাসের প্রতি অকৃতজ্ঞতা।

বীরাঙ্গনাদের ৭১-এর গগণবিদারী চিৎকার তখন হয়তো পাকিস্তানিদের কান পর্যন্ত পৌঁছায় নি কিন্তু গত ৪৪ বছরে আমাদের কান পর্যন্ত কতখানি পৌঁছেছে তাঁর হিসাব করতে গেলে বীরাঙ্গনাদের নিয়ে লিখা হাতেগোনা কয়েকটি বই ছাড়া আর তেমন কিছুই খুঁজে পাই না।
তথ্যসূত্র:https://danabarua.wordpress.com/2016/02/17/%E0%A6%86%E0%A6%A6%E0%A6%BF%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A7%80-%E0%A6%AC%E0%A7%80%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97%E0%A6%A8%E0%A6%BE/

No comments

Theme images by 5ugarless. Powered by Blogger.