আদিবাসীরা নেই জাতীয় বাজেটে

সঞ্জীব দ্রং     

বিগত কয়েক বছরে ছোট্ট হলেও বাজেট বক্তৃতায় ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ বিষয়ে একটি প্যারা থাকত। এবার তা নেই। এবারের বাজেটের আকার আড়াই লাখ কোটি টাকার বেশি (দুই লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি)। সংসদ সদস্য উষাতন তালুকদার আমাদের ডেকেছিলেন তাঁর বাসায় বাজেট নিয়ে আলোচনা করতে।
অনেক খঁুজে যখন বাজেটে আদিবাসীদের কী অবস্থা জানার চেষ্টা করেছি এবং পাইনি, তখন নিজে বাজেটের বারো কি তেরো ভলিউম বই কিনে এনেছিলাম নিউমার্কেট থেকে। আদিবাসীদের মধ্যে সংখ্যায় যারা বেশি, পুরো আদিবাসীদের দুই-তৃতীয়াংশের অধিক, সেই ২০ লাখের অধিক আদিবাসীর জন্য বাজেটে তেমন স্থান বা বরাদ্দ নেই বললে চলে। জনসংখ্যানুপাতে সমতলের আদিবাসীদের জন্য কমপক্ষে বাজেট বরাদ্দ হওয়ার কথা চার হাজার কোটি টাকা। পাটিগণিত কষলে এটি পাবেন। আদিবাসী জনসংখ্যা পুরো জনসংখ্যার প্রায় ২ শতাংশ। শতকরা ২ দিয়ে আপনি ২৫০,৫০৬ কোটিকে ভাগ করেন, তাতে আদিবাসীদের জন্য বরাদ্দ হওয়া উচিত অন্তত পাঁচ হাজার কোটি টাকা। সেখানে সমতলের আদিবাসীদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ‘বিশেষ এলাকার জন্য উন্নয়ন সহায়তা’ বাবদ ১৬ কোটি টাকা (এ বরাদ্দ বাজেট দলিলে উল্লেখিত হয়নি, তবে খাতটি আগের মতো আছে)। সমতলের ২০ লাখ আদিবাসীর জন্য ১৬ কোটি টাকা? প্রতিজনের ভাগে বরাদ্দ বছরে ৮০ টাকা। এর বাইরে রুমা উপজেলায় বান্দরবান ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের আঞ্চলিক কেন্দ্র স্থাপনের জন্য এক কোটি ৮৩ লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এ ছাড়া, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ মঞ্জুরি থেকে ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের জন্য পাঁচতলা অফিস-কাম-কমিউনিটি হল নির্মাণের জন্য বরাদ্দ আছে, যার পরিমাণ তিন কোটি ২৪ লাখ টাকা।
তা ছাড়া, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় হালুয়াঘাট, দিনাজপুর ও নওগাঁ জেলায় একটি সাংস্কৃতিক একাডেিমর জন্য বরাদ্দ করেছে ১০ কোটি টাকা। তবে আমি প্রশংসা করব, সরকার সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী, ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন, হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন, দলিত, হরিজন, ভবঘুরে ও বেদে জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কার্যক্রম ইত্যাদি হাতে নিয়েছে। যেটুকু বুঝেছি তাতে বরাদ্দ রয়েছে ১৩৩ কোটি ১৩ লাখ টাকা। এর বাইরে চার লাখ ৫০ হাজার প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর জন্য ভাতা ও শিক্ষা উপবৃত্তি আলাদা রয়েছে। এ দিকটি অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য। আর জেন্ডার বাজেটের ধারণা প্রশংসনীয়।
কিন্তু কী হলো এবার আদিবাসীদের? বিগত বাজেটগুলোতে জাতীয় বাজেট বক্তৃতায় আদিবাসী/ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জনগণের জন্য ছোট্ট পৃথক অনুচ্ছেদ বা প্যারাগ্রাফ থাকলেও এবারের বাজেট বক্তৃতায় আদিবাসীদের স্থান হয়নি। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতার ৩৭ নম্বর পৃষ্ঠায় একটি লাইন স্থান পেয়েছে এভাবে, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও তাঁদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ধরে রাখার লক্ষ্যে এ অঞ্চলের উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দেব।’ সমতলের আদিবাসী, যারা আদিবাসীদের মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ, তাদের সম্পর্কে একটি লাইনও এবারের বাজেট বক্তৃতায় নেই। আদিবাসীদের জন্য এবারের বাজেট বক্তৃতা হতাশাজনক। সামনে এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে কেন উল্টো, ইতিপূর্বে যা ছিল তা-ও বাদ দেওয়া হলো, এ এক প্রশ্ন। যেহেতু বাজেট অধিবেশন চলছে এবং বাজেট সংশোধিত, পরিমার্জিত, সংযোজিত, বিয়োজিত হবে, তাই আদিবাসীদের বিষয়টি ভেবে দেখা অতি জরুরি।
আশার দিক হলো, আদিবাসীবিষয়ক সংসদীয় ককাসের উদ্যোগ। আমি এ ককাসের অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ পড়েছিলাম কয়েক দিন আগে বাজেট ও আদিবাসী বিষয়ে। মন্ত্রীসহ সব সংসদ সদস্য আদিবাসী শব্দ ব্যবহার করেছেন। মিডিয়া ও নাগরিক সমাজ কেউ সরকারের ব্যবহৃত শব্দ ব্যবহার করছে না। তারা জানে, আদিবাসীর সংজ্ঞা নয়, কে আগে কে পরে পৃথিবীতে এসেছে, তা মূল কথা নয়। আদিবাসীদের ওপর মানবসৃষ্ট ঐতিহাসিক শোষণ ও বঞ্চনার কথা আমি বলেছিলাম। এটি মেনে নিলে আদিবাসীদের জন্য বাজেট বরাদ্দ অনেক বেশি হওয়ার কথা।
আদিবাসী জনগণ দেশের সবচেয়ে দরিদ্র ও অনগ্রসর অংশের মধ্যে অন্যতম। জমিজমা, পাহাড় ও বনের অধিকার হারিয়ে তারা বিলুপ্তপ্রায় জাতি এখন। আমি প্রবন্ধে বলেছি, জাতীয় বাজেটে পৃথক অনুচ্ছেদ যুক্ত করে আদিবাসীদের জন্য অর্থ বরাদ্দ রাখতে হবে। এর পরিমাণ হবে কমপক্ষে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। আর বাজেট বক্তৃতায় আদিবাসী বিষয়ে বিবরণী থাকবে। সমতলের আদিবাসীদের বিষয়টি দেখার জন্য যেহেতু কোনো মন্ত্রণালয় বা বিভাগ নেই, সে জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এই থোক বরাদ্দ পরিচালনার জন্য সমতলের আদিবাসীদের সমন্বয়ে একটি উপদেষ্টা কমিটি বা বোর্ড গঠন করতে হবে। থোক বরাদ্দের পরিমাণ হবে কমপক্ষে ১০০ কোটি টাকা। সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয়ের দাবি অনেক দিনের। পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়, আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদসমূহের বাজেট বৃদ্ধি করতে হবে। সব মন্ত্রণালয়ের বাজেটে আদিবাসীদের জন্য সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ রাখতে হবে এবং বরাদ্দের সুষ্ঠু বাস্তবায়নে আদিবাসীদের কীভাবে সম্পৃক্ত করা যায়, সে বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে।
তবে যতক্ষণ পর্যন্ত এমন মন্ত্রণালয় না হচ্ছে, সেই সময় পর্যন্ত সমতলের আদিবাসীদের সব বিষয় দেখার জন্য একটি আলাদা বিভাগ খুলে পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারভুক্ত করার বিষয়ে আমরা ভাবতে পারি কি না, এ প্রশ্ন আমি রেখেছি। যে থোক বরাদ্দ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ‘বিশেষ এলাকার জন্য উন্নয়নসহায়তা (পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্যতীত)’ এ পর্যন্ত চলছে, এখানেও সমতলের আদিবাসীদের প্রকৃত পক্ষে কোনো অংশগ্রহণ নেই। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রবেশাধিকার নিশ্চয় সমতলের আদিবাসীদের জন্য অত সহজও নয়। আদিবাসীদের উন্নয়নে সরকারকে ইতিবাচক বিশেষ কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে। বাজেট কার্যক্রমে আদিবাসীদের কোনো অংশগ্রহণ আছে বলে মনে হয় না। অংশগ্রহণ থাকলে সরকারই লাভবান হতো।

সঞ্জীব দ্রং: কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী|

No comments

Theme images by 5ugarless. Powered by Blogger.