দেশ ছেড়ে আমি কোথাও যাব না

অরুণ বসু | আপডেট: ০০:০৭, জানুয়ারি ১৪, ২০১৪ |
সেই ধ্বংস, শিশুর সেই কান্না আর মায়ের অসহায়ত্ব যেন একই ফ্রেমে বাঁধা ছবিছবিটা প্রথম দেখি প্রধান বার্তা সম্পাদক লাজ্জাত এনাব মহছির কম্পিউটারে। সেদিন সন্ধ্যায়, প্রতিদিন যেমন হয়, পরের দিনের পত্রিকার জন্য ছবি বাছাবাছির কাজ চলছিল বার্তাকক্ষে। কম্পিউটারে ছবি দেখতে দেখতে লাজ্জাত বলছিলেন, দেখা যায় না এসব ছবি, কান্না পায়। ওঁর পেছনে দাঁড়িয়ে ছবিটি দেখতে পাই। বুকের মধ্যে ছ্যাঁৎ করে ওঠে।
পরদিন ৭ জানুয়ারি প্রথম আলোর প্রথম পাতার প্রধান ছবি হিসেবে সেটি ছাপা হয়। অভয়নগরের চাঁপাতলা গ্রামে মালোপাড়ার ঘরদোর ভাঙচুর করে লুটপাট চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। বাড়ির ভিটায় ধ্বংসস্তূপে মায়ের কোলে বসে খাবারের জন্য কাঁদছে ক্ষুধার্ত শিশু বিপাশা বর্মণ। সন্তানের সঙ্গে কাঁদছেন অসহায় মা সঞ্চিতা বর্মণ। সকালে কাগজ খুলে হূদয় দীর্ণ করা ছবিটির দিকে আরেকবার তাকাই। চোখ ভিজে যায়। ছবিটি আমাকে বুঝি একটু বেশিই তছনছ করে দেয়।
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাস। ফরিদপুর শহরে পাকিস্তানি সেনারা ঢুকেছে। আমরা গ্রামে চলে যাই। আমাদের গ্রামের বাড়ি কৃষ্ণনগর। তিন শরিকের বিরাট গেরস্ত বাড়ি। সে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে শহর থেকে পালিয়ে আসা হিন্দু সম্প্রদায়ের বেশ কিছু মানুষ। একদিন খবর পাওয়া গেল, শহর থেকে বিহারি সম্প্রদায়ের কুখ্যাত কিছু গুন্ডার নেতৃত্বে একদল দুর্বৃত্ত আমাদের বাড়ি আক্রমণ করতে আসছে। আশ্রিতদের নিয়ে আমরা তড়িঘড়ি মুসলমান প্রতিবেশীদের বাড়িতে আশ্রয় নিই। বাড়িতে লুটপাট হয়। দুর্বৃত্তরা চলে গেলে আমরা বাড়ি ফিরি। সবাই ক্ষুধার্ত। ঢেঁকিঘরে স্তূপীকৃত মিষ্টি আলু সেদ্ধ করে সবার ক্ষুন্নিবৃত্তির ব্যবস্থা হয়। পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য আমার ছোট বোন রিনা। একটা সেদ্ধ আলু ওর হাতে তুলে দেন মা। ওই আলু খাওয়ার তো ওর অভ্যাস নেই। সেটি হাতে ধরে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু হলো তার।
কোনো কোনো দৃশ্য মানুষের চোখে খুব গাঢ় হয়ে লেগে থাকে। এই দৃশ্য কোনো দিন ভুলিনি আমি। রিনা তখন এই বিপাশা বর্মণেরই সমবয়সী। ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসের এই নিদারুণ চিত্র আর একাত্তরের সেই ধ্বংস, সেই লুটপাট, শিশুর সেই কান্না আর মায়ের অসহায়ত্ব যেন একই ফ্রেমে বাঁধা ছবি। রিনা আর বিপাশার মুখ একাকার হয়ে যায়। হুহু করে মন।
দুই
একরাম আলির সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয়নি। তাঁর লেখা পড়েছি। ওই লেখা পড়ে একরাম আলি আমার চৈতন্যের ভেতরে উজ্জ্বল হয়ে আছেন, হয়ে উঠেছেন আপনজন। ১৯৯২ সাল। ভারতের দুর্বৃত্ত হিন্দুরা ধ্বংস করেছে বাবরি মসজিদ। ভারতজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প। সেখানে মুসলমান নিগ্রহ তখন নৈমিত্তিক ঘটনা।
একরাম সে সময় কলকাতার একটি কাগজে কাজ করেন। যেহেতু তিনি মুসলমান, তাই তাঁর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত তাঁর হিন্দু বন্ধুরা। তাঁরা একরামের খোঁজ নিচ্ছেন। রাতে বাড়ি ফিরতে মানা করছেন, তাঁকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইছেন। শুভবুদ্ধির এই বন্ধুরা তো যথার্থই বন্ধুকৃত্য করছেন। কিন্তু একরাম আলি দেখছেন, মুসলমান বলে, সংখ্যালঘু বলে তিনি সবার থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছেন। তিনি কি অন্যের করুণার পাত্র হয়ে উঠছেন? এই জিজ্ঞাসা, এই অন্তর্জ্বালা একরামকে ক্ষতবিক্ষত করে। মর্মস্পর্শী বর্ণনায় সবিস্তারে সে কথাই লিখেছিলেন একরাম। ওই লেখাতে তিনি বলেছেন, সংখ্যালঘুর কোনো জাত নেই। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, কালো-সাদা—কোনোটাই নয়। সংখ্যালঘুর একটাই জাত, তার নাম সংখ্যালঘু।
বাবরি মসজিদের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল বাংলাদেশে। দেশজুড়ে তখন মন্দির ভাঙা আর হিন্দু নিগ্রহের মচ্ছব। সেই তাণ্ডবের কালে এই ঢাকা শহরে বিষণ্ন মনে ঘুরে বেড়াই। প্রায় প্রতিদিনই হাজির হই অসীমদার (কবি অসীম সাহা) ছাপাখানা কাম আড্ডাখানায়। গুণদাও (কবি নির্মলেন্দু গুণ) আসেন মাঝেমধ্যে। সারা দেশ থেকে নানা সূত্রে প্রতিদিন মন-খারাপ করা খবর আসে।
ফরিদপুরে আমাদের বাসার কাছের মন্দির আক্রমণের খবর পাই। রাতে ঘুমাতে পারি না। বন্ধুরা, বলা বাহুল্য, মুসলমান বন্ধুরা নিয়মিত খোঁজখবর করেন। আমাকে ও আমার পরিবার নিয়ে তাঁরা চিন্তিত। তাঁরা আমার প্রকৃতই বন্ধু এবং সজ্জন। কিন্তু আমার হয় ওই একরামের দশা। আমার সত্তা নড়ে ওঠে, আমি কি তবে আলাদা হয়ে যাচ্ছি? একই সংকটে আপন্ন বলেই অদেখা একরাম আলি হয়ে ওঠেন আমার আপনজন।
তিন
২০০১ সালে নির্বাচনে বিজয়ী হলো বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট। শুরু হলো সংখ্যালঘু নির্যাতনের তাণ্ডব। সে এক পৈশাচিক ক্রিয়াকাণ্ড। সেই দুর্যোগকালে প্রথম আলোতে ‘সংখ্যালঘুরা কি শুধুই ভোট, মানুষ নয়?’ শিরোনামে নিবন্ধ লিখেছিলাম। ২০১৪ সালেও সেই লেখা কী নির্মমভাবেই না প্রাসঙ্গিক।
সেদিন লিখেছিলাম, ‘অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সংখ্যালঘুরা মানুষ নয়, ভোট। রাজনৈতিক দলগুলো সম্ভবত লাজলজ্জার মাথা খেয়ে সংখ্যালঘুদের মানুষ মনে করতে ভুলে গেছে। কোনো সংখ্যালঘুর দিকে তাকিয়ে তারা একজন “মানুষ”-এর বদলে একটি “ভোট” দেখতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আর সেই সুযোগে মওকা পেলেই লম্পটেরা, দুর্নীতিবাজেরা, মাস্তানেরা সংখ্যালঘুদের ভিটেছাড়া করে সর্বস্ব লুটে নেওয়ার তাড়নায় মত্ত হয়ে ওঠে।’
শুধু ভোট নয়, সংখ্যালঘু নির্যাতনের আরও বড় কারণ তাদের সম্পত্তি। ‘সংখ্যালঘুরা দেশে থাকলে ভোট, না থাকলে সম্পত্তি।’ নির্লজ্জ প্রকাশ্য সাম্প্রদায়িকতার পাশাপাশি বছরের পর বছর চলমান নীরব সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের শিকার তারা। পাকিস্তান আমল থেকেই চলছে এই ধারা।
দলে দলে কিংবা গোপনে-নিভৃতে দেশ ত্যাগ করতে হয়েছে লাখ লাখ সংখ্যালঘুকে। আর কখনো জোর করে দখল, কখনো সামাজিক বা রাজনৈতিক প্যাঁচে ফেলে আদায়, কখনো আপসের ছলে জলের দরে তাদের সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। আর এই দখলদারি পাকা করতে অর্পিত সম্পত্তি আইন সংশোধনের নামে সরকারের বাহারি চাতুরীপনা বেশ দেখার মতোই ভেলকি বটে। দেখেই যাচ্ছি।
১৯৭৪ সালেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ছিল দেশের মোট জনসংখ্যার ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ, ২০১১ সালে সেটা ৮ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে (সূত্র: বিবিএস)। দেশে হিন্দু কমেছে, আরও বেশি করে কমেছে তাদের সম্পত্তি। কিন্তু আমাদের লুটপাটের আর কেড়ে খাওয়ার অর্থনীতির যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, সেটা হয়েছে আরও রমরমা। সংখ্যালঘু সম্পত্তিতে এখন বুঝি আর খাঁই মেটে না। তাই বুঝি ক্ষমতাধারীরা সরকারি (নাকি জনগণের) সম্পত্তি লুটপাটের প্রতিযোগিতায় মত্ত হয়ে উঠেছে।
চার
মুক্তিযুদ্ধে শুধু ধর্মীয় সংখ্যালঘু বলে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে সেদিনও আক্রমণ-নির্যাতনের বিশেষ টার্গেট করা হয়েছিল। সম্প্রদায় হিসেবে সেদিন তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ও নির্যাতিত হয়েছিল। অথচ এ সত্য কোথাও জোরেশোরে বলতে শুনি না। এ আমাদের জাতীয় হীনম্মন্যতা, জাতীয় মানসচেতনার এক কুলক্ষণ। আজ যখন একাত্তরের সেই দুরাচারদের বিচারের রায় হচ্ছে, ফাঁসি কার্যকর হচ্ছে, তখনো কিন্তু তার চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে সংখ্যালঘুদের। সেই অপশক্তির হাতেই নিগৃহীত হচ্ছে তারা।
২০১২ সালে রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর চালানো হলো নারকীয় সহিংসতা। দেখা গেল, জামায়াত, আওয়ামী লীগ, বিএনপি—সব রাজনৈতিক দলের দুর্বৃত্তরাই এ ‘মহাবীরত্বপূর্ণ’ কাজে বীরবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আমাদের নাকি জাতীয় ঐক্যের বড়ই অভাব। সংখ্যালঘু নির্যাতনের সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের দুর্বৃত্তদের ঐক্য থেকে শিক্ষা নিতে পারেন নীতিনির্ধারক রাজনৈতিক নেতারা। তাহলে তো ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে আগুনে পোড়া এত নিষ্করুণ মৃত্যু দেখতে হতো না আমাদের।
কোনোকালেই দেশের সরকার ও বড় বড় রাজনৈতিক দল সংখ্যালঘুদের বিপর্যয়ে বিন্দুমাত্র আন্তরিকতা দেখায়নি। বরং তাদের নিয়ে হীন রাজনীতি করেছে। বছরের পর বছর ধরে কত সহিংস আক্রমণের ঘটনা ঘটল, কিন্তু আজ পর্যন্ত একজন অপরাধীকেও শাস্তি পেতে দেখিনি। রাজনীতিকেরা যখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে নিয়মরক্ষার বুলি আওড়ান, তখন তাঁদের মুখের দিকে তাকিয়ে ‘মুখ’ নয়, মুখোশ দেখি।
আমি বিশ্বাস করি, দেশের বেশির ভাগ মানুষ এই সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সমর্থন করে না। আমি দেখতে পাই, দায়িত্বশীল নাগরিকেরা এই অনাচারের বিরুদ্ধে সভা-সম্মেলন করছেন, চিৎকার করে প্রতিবাদ করছেন। দল বেঁধে অকুস্থলে যাচ্ছেন বহুজন। অত্যাচারিতের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। এঁরা কোনো প্রতিরোধ হয়তো গড়ে তুলতে পারছেন না। এঁদের হয়তো গণ্যই করছেন না দেশের কর্ণধার আর বৃহৎ রাজনৈতিক দলের নেতারা। তবু দেশের মধ্যে সভ্যতার আর মনুষ্যত্বের সলতেটা জ্বালিয়ে রাখছেন এঁরাই। এটা তো ভরসারই কথা। আমি আরও এক ভরসার দিকচিহ্ন দেখতে পাই—আসছে এক ঝলমলে অন্য রকম প্রজন্ম, যারা এই কলুষতার লক্ষণহীন।
এই মাটিতে আমি জন্মেছি। দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছি। শরীরে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসরদের নির্যাতনের চিহ্ন আজও আমি বয়ে বেড়াই। এ দেশ আমার। এখানে আমার ভিটে আছে। ঘন কালিতে মোটা হরফে তাই লিখে দিতে চাই—দেশ ছেড়ে আমি কোথাও যাব না।

No comments

Theme images by 5ugarless. Powered by Blogger.