শীতল গাঁওয়ের মালোরা
মেয়েটির মুঠোফোন বন্ধ। কারণটিও অজ্ঞাত। একদিন আগেও তিনি কথা বলেছেন আগ্রহ
নিয়ে। জানিয়েছেন আদিবাসীদের নানা তথ্য। সে তথ্যের ভিত্তিতেই আমরা ঘোড়াঘাটে
যাওয়ার প্রস্তুতি নিই। কিন্তু যাত্রাকালে তার ফোন বন্ধ পেয়ে আমরা ভাবনায়
পড়ি।
মেয়েটির নাম মারিয়া মালো। মালো আদিবাসী জাতির নারী তিনি। থাকেন দিনাজপুরে। মাস্টার্স শেষে কাজ করছেন একটি এনজিওতে। ঘোড়াঘাটের শীতল গ্রামেই মারিয়ার জন্ম। সেখানে প্রায় দেড়শ’টি মালো পরিবারের বাস। একসময় এ দের পূর্বপুরুষরা বাস করত রংপুরের তাজহাটে। কলেরা ও ডায়রিয়া থেকে মুক্তি পেতে বহুপূর্বে এরা এসে বসতি গড়ে শীতল গাঁয়ে। মুঠোফোনে এমন নানা আলোচনায় আমরা আগ্রহী হই। শীতল গাঁয়ের ঠিকানাটি জানাই ছিল। তাই মারিয়ার আশা ছেড়ে আমরা নিজেরাই রওনা হই দিনাজপুর থেকে।
বৈশাখ মাস। তার ওপর গতরাতে হয়েছে কালবৈশাখী। জল আর হাওয়ার ঝাপটায় প্রকৃতিটাও বেশ সজীব। জমে থাকা ধুলোবালি ধুয়ে মুছে একেবারেই অন্য রকম। রোদের তীব্রতা তেমন নেই। দমকা হাওয়ার ঝাপটায় মাঝেমধ্যেই দুলে উঠছে মনটা। আমরা বাস থেকে নামি ঘোড়াঘাট টিঅ্যান্ডটিতে।
রাস্তার পাশে বড় একটি বটগাছ। বটের ছায়ায় বাসস্ট্যান্ডটি। পাশে গোটা দুয়েক চায়ের দোকান। দোকানে বসে গল্প জমিয়েছে জনাকয়েক লোক। ফাঁকে ফাঁকে ধোঁয়া তোলা চায়ে চুমুক দিচ্ছে তারা। বাঙালি ছাড়াও দু’-একটি আদিবাসী মুখপানে আমাদের দৃষ্টি আটকায়। ঠাওর হয় এখানটায় আদিবাসী-বাঙালির সহ-অবস্থান।
দোকানের সামনে পাঁচ-ছয়টি ভ্যানের ঝটলা। এ অঞ্চলে পথ চলতে ভ্যানই একমাত্র ভরসা। শীতল গ্রামের কথা বলতেই আতর আলী নামের এক ভ্যানচালক এগিয়ে আসেন। ভাড়া দরদাম করে আমরা রওনা হই শীতল গাঁওয়ের উদ্দেশে।
ঘোড়াঘাট ডিগ্রি কলেজ পেরিয়ে আমরা সামনে এগোই। লালমাটির শক্ত পথ। রাস্তার পাশে নানা ভাষাভাষী মানুষের আনাগোনা। দূর থেকে আদিবাসী পাড়ার ছনে ছাওয়া ঘরগুলো দেখতে অন্য রকম লাগে। চারপাশে সবুজ ধানক্ষেত। তার মাঝে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি তালগাছ। বিশাল দেহী আদিবাসীরা দলবেঁদে কাজ করছে মাঠে। গ্রামের ভেতর থেকে ভেসে আসা ঢোল-মাদলের ছন্দ এ অঞ্চলে আদিবাসীদের আধিক্যকেই বারবার মনে করিয়ে দেয়।
ভ্যানচালক আতর আলী জানালো, ঘোড়াঘাটে নাকি একসময় শুধুই আদিবাসীদের বসবাস ছিল। তখন এলাকাটি ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। আদিবাসীরা সে জঙ্গল কেটে চাষাবাদের জমি তৈরি করে। এখনও এখানে পাড়াভেদে বাস করছে সাঁওতাল, ওরাওঁ, মাহালী, মাহাতো, পাহাড়ি প্রভৃতি জাতির আদিবাসীরা। কিন্তু নানা কারণে এদের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে।
কথায় কথায় আমরা পেরোলাম কিলো পাঁচেক পথ। রাস্তার ডানে বাঁক নিতেই চোখের সামনে ভেসে উঠে একটি আদিবাসী গ্রাম। ভ্যান থামিয়ে আতর আলীর কণ্ঠ, ‘স্যার, এইডাই শীতল গ্রাম, মালোপাড়া।’
তখন দুপুর বেলা। রাস্তার পাশে বসে গল্প করছিল মধ্য বয়সী কয়েকজন। মারিয়া মালোর বাড়ি কোনটি? উত্তরে একজন আমাদের দেখিয়ে দেয় গ্রামের শেষ প্রান্তের একটি বাড়ি।
সদর দরজায় কড়া নারতেই বেরিয়ে আসে মারিয়ার ছোট বোন বাসন্তী মালো। নবম শ্রেণীতে পড়ছে সে। কথা বলায় বেশ চটপটে। ছিপছিপে গড়ন। এক চিলতে হাসি যেন তার মুখে আলো ছড়ায়। অভর্থ্যনা জানিয়ে বাসন্তী বাড়ির ভেতরে আমাদের বসতে দেয়। বাড়ির ভেতর বড় একটি উঠোন। দু’পাশে ছনে ছাওয়া দু’টি বড় ঘর। অন্য পাশে ছোট্ট একটি রান্নাঘর। উঠোনের এককোণে ঘাস ফুলের রাজ্য।
বাসন্তীর বাবা ভরত মালো। গ্রামের মাঝি হারাম বা গ্রামপ্রধান তিনি। তার খোঁজ করতেই বাসন্তী আমাদের নিয়ে যায় বাড়ির পেছন দিকটাতে। বড় একটি পুকুর পেরিয়েই একটি শালবাগান। তার ভেতর দিয়ে খানিকটা এগোলেই মিলে উঁচু একটি মাঠ। মাঠের শক্ত মাটিতে কোদাল চালিয়ে হলুদ তুলছিলেন ভরত মালো। বয়স সত্তরের মতো। কিন্তু দেহের গড়ন তা প্রকাশ করে না। গায়ের রঙ কালচে হলেও লম্বা ও সুঠাম দেহী এ মানুষটি যেন আদি মানুষেরই জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। তার সহধর্মিণী ভারতী মালো। হলুদ তোলাতে তাকে সাহার্য করছেন তিনি। কাজ থামিয়ে আমাদের সঙ্গে আলাপ জমায় তারা।
মালো আদিবাসীরা এ অঞ্চলে এসেছে ভারতের রাঁচি থেকে। এদের গানেও মিলে তার সত্যতা- ‘রাঁচি থেকে আসলো ঘাসী, তারপর হলো আদিবাসী।’ কথিত আছে, বৃটিশ আমলে রেললাইনের কাজের সূত্র ধরেই এ অঞ্চলে এদের আগমন ঘটে। ভরত মালোর বাবার নাম প্রতাপ মালো। প্রতাপের বেড়ে ওঠা এ অঞ্চলে হলেও তার বাবা এসেছিলেন রাঁচি থেকে। রাঁচি ও জলপাইগুড়িতে ভরতদের এখনও অনেক আত্মীয়-স্বজন বসবাস করছেন। ভরত মালো জানালেন তাদের জাতির নামকরণের ইতিহাসটি।
একসময় জমিদাররা মালোদের দিয়ে ঘোড়া, মহিষ ও গবাদি পশুর ঘাস কাটার কাজ করাতো। সে কারণে মালোদের ঘাসি বলেও ডাকা হতো। এ ছাড়া এদের অনেকেই বংশানুক্রমিকভাবে জমিদারদের লাঠিয়াল ও বরকন্দাজ হিসেবেও কাজ করতো। স্থানীয়রা এদের চিনে নেয় বুনা বা বুনো হিসেবে। বিহারের মালভূমি ও মালই টিলার অধিবাসীর জীবনযাত্রার সঙ্গে মিল আছে বলেই এদের মালো নামে ডাকা হয়।
মালোদের এক-একটি গ্রাম পরিচালিত হয় তিন সদস্যের পরিষদের মাধ্যমে। মাঝি হারাম বা গ্রামপ্রধানের পদ ছাড়াও রয়েছে পারমানিক ও গুরদিক নামের দুটি পদ। গ্রামের সবার কাছে নানা খবরাখবর পৌঁছানোর কাজটি করেন পারমানিক। আর মাঝি হারামের বিচারের রায় পাঠ করে শোনাতে হয় গুরদিককে। মালো আদিবাসীদের গোত্র বিভক্তি তাদের বংশ পরিচয়কেই তুলে ধরে। গোত্রগুলোর নামগুলো জানতে চাইলে ভরত মালো হরহর করে বলতে থাকেন- পরনদীয়া, এসলোকিয়া, কারচাহা, সরকার, নায়েক প্রভৃতি। এদের একই গোত্রে বিয়ে নিষিদ্ধ। এরা তাদের নামের শেষে টাইটেল হিসেবে মালো ছাড়াও অঞ্চলভেদে নায়েক, রাজ, সরকার ব্যবহার করেন।
মালোরা ভাষাগত দিক থেকে প্রোটো-অস্ট্রালয়েড জাতি। এরা নিজেদের ভাষাটিকে বলে মালো ভাষা বা ঘাসি ভাষা কিংবা বুনেরা ভাষা। তবে বর্তমানে বাংলা ভাষাতেই এরা অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। ভারতীর ভাষায়, ‘হামনি এ ভাষাটা সব সময় কিহে না’।
ভাষা নিয়ে আলাপ উঠতেই বাসন্তী জানালেন পড়াশোনার শুরুতে বাংলা ভীতির কথা। তার লেখাপড়ায় হাতেখড়ি স্থানীয় এক স্কুলে। সেখানে ছিল না কোন আদিবাসী শিক্ষক। বিদ্যালয়ের পড়ানো হয় অজানা বাংলা ভাষায়। যে ভাষায় সে কথা বলে মায়ের সে ভাষাটিকে সে বিদ্যালয়ে খুঁজে পায় না। ফলে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত বাংলা ভাষা বুঝতে তাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। কিন্তু পরে সে হয়ে উঠে ক্লাসের ভাল ছাত্রী। বর্তমানে বিরামপুর পাইলট স্কুলের সব শিক্ষকের কাছে সে একনামে পরিচিত।
আমরা একমনে শুনছিলাম বাসন্তী, ভরত ও তার সহধর্মিণীর কথা। হঠাৎ মাদল-ঢোলের টুংটাং শব্দ ভেসে আসে পাশের একটি বাড়ি থেকে। সেদিকে খেয়াল দিতেই বাসন্তী মালো মুচকি হাসে। সে জানাল, পাশের বাড়ির মেয়ের বিয়ে চূড়ান্ত হয়েছে। তাই বিয়ের আগ পর্যন্ত নানা আচার চলবে ঢোল-মাদলের ছন্দে।
ছন্দ ধরে আমরা ওই বাড়ির দিকে এগোই। আমাদের পথ দেখিয়ে নেয় বাসন্তী।
ছনে ছাওয়া তিনটি ঘর নিয়ে বাড়িটি। উঠোনের এককোণে উঁচু ও ছোট্ট একটু জায়গায় একটি তুলসি গাছ ঠায় দাঁড়িয়ে। তুলসির গোড়াটি মাটিতে লেপা। গাছের পাশেই রয়েছে একটি প্রদীপ। গৃহকর্ত্রী গঙ্গা মালো জানালেন এটি মালোদের ‘তুলসি গড়া’। ভগবানের সন্তুষ্টি লাভের আশায় এখানেই সকাল-সন্ধ্যা এরা ভক্তি বা প্রার্থনা করে। মালো ভাষায় একে ‘গরলাগি’ বলে।
আমাদের বসার জায়গা হয় একটি ঘরের বারান্দাতে। সেখানে এককোণে বসে মাদলের ছন্দ তুলছিলেন নিরমল মালো। মালোদের বিয়ে নিয়ে আমরা আলাপ জমাই। গঙ্গা মালোও আগ্রহ নিয়ে বলতে থাকেন বিয়ের আদ্যপান্ত।
মালোদের বিয়ের পাকা কথা হয় কনের বাড়িতে। এ সময় কনে পক্ষকে ভাল ভাল খাবারের সঙ্গে খেতে দিতে হয় হাড়িয়া। হাড়িয়া মালোদের প্রিয় পানীয়। এটি ছাড়া মালোদের সম্মান রক্ষা হয় না। একসময় এদের বিয়েতে পণপ্রথা চালু ছিল। কিন্তু বর্তমানে সামর্থ্য অনুযায়ী ছেলেকে যৌতুক দিতে হয়। কিন্তু যৌতুক প্রথাকে মালোরা তেমন ভাল চোখে দেখেন না। গঙ্গা মালোর ভাষায়, ‘ডিমেন না নেয়াই ভালো’।
মালোদের বিয়ের পর্ব পাঁচটি। সাজনা সাজা, লগন, কৈইলনী, মারোয়া ও বিহা। সাজনা সাজো পর্বে বরপক্ষ কনেকে সাজানোর জন্য হলুদের শাড়িসহ চিউরা (চিঁড়া), গুড়, তেল, হেরদি (হলুদ), আয়না, ককোই (চিরুনি), দুইটা মাটির পুথুল, চুরি, কানফুলি, নাককুটি, মালা, ফিতা, পানসুপারি, জবা ও গাদা ফুল, কুশ (এক প্রকার জঙ্গলি ফুল), গংগিকা নুুপূর (শামুকের নুপূর), পুতুলের খেটিলা (খাট) পাঠায়। এরা কনের জন্য সাদা রঙের কাপড় হলুদে ডুবিয়ে তৈরি করে বিশেষ ধরনের শাড়ি। মালো ভাষায় এটি, ‘হরদি লেংগন লুগা’।
গঙ্গা থামতেই লগন পর্বের কথা জানান নিরমল। এ পর্বে কনের মা-বাবাকে প্রথমে প্রার্থনা করতে হয় আদিরীতি মেনে। অতঃপর কনেকে ঘরের ভেতর রেখে গায়ে হলুদ দেন তার চাচা-চাচি, মামা-মামি ও নিকট আত্মীয়রা। সবাই মিলে বাড়ির উঠোনে তখন আঁকে নানা রঙের আলপনা। অতঃপর কনেকে এনে উঠোনে বসানো হয় পূর্বমুখো করে। নিয়ম মেনে কনের একপাশে বসে বরের ভাই, অন্যপাশে কনের ভাই। সবার উপস্থিতিতে এরা একজন অন্যজনের বুকে পানপাতা ছোঁয়ায়। অতঃপর একে অন্যকে বিয়াই বলে সম্বোধন এবং বিট বিট (কোলাকুলি) করে। চারপাশে তখন মাদল-ঢোলের বাদ্য বাজে। কনে তখন দাঁড়িয়ে সবাইকে প্রণাম করে।
কৈইলনী পর্বের কথা জানতে চাইলে গঙ্গা মুচকি হাসেন। ছোট্ট একটি বাঁশের ঝুড়িতে কিছু মুড়ি এগিয়ে দেন আমাদের দিকে। অতঃপর বলতে থাকেন।
মালো বিয়েতে গায়ে হলুদের তিন দিন পর হয় কৈইলনী পর্বটি। এ সময় দিনে ও রাতে উপোস থাকতে হয় কনেকে। উপোস অবস্থায় খাওয়া যায় শুধুই দুধ আর রুটি। কৈইলনীর দিন খুব ভোরে উঠে জিগা গজ, বাঁশপাতা, ধান, সুপারি, ১ টাকা, অরপন, সিঁদুর, ছোট ছোট সাদা কাপড়, সুতা, সঙ্গে নিয়ে কনেকে উঠোনে গিয়ে বসতে হয় মায়ের কোলে। ওই অবস্থাতেই কনে মাটি খুঁড়ে গর্ত তৈরি করে। সঙ্গে আনা জিনিসগুলো গর্তে মাটিচাপা দিয়ে তবেই ভাঙতে হয় উপোস।
মারোয়া পর্বের কথা উঠতেই বাসন্তী গান ধরেন-
‘চারকোনা চারখোট
মাঝে মারোয়া...’
বাড়ির উঠোনে মারোয়া সাজানোর সময় মালো আদিবাসীরা ‘লুচকি নাচ’ নাচে। মারোয়া সাজাতে কি কি লাগে? গঙ্গার উত্তর, ‘কলা গাছ লাগে চাইরটে, মইধ্যে একটা বাঁশ, ফুল দেইকে ঘেরেক লাগিলো।’ একটি মাটির কলস রাখার জন্য মারোয়ায় তিন চাক মাটি বসানো হয়। বাড়ির বোহনে (দুলাভাই) ও দিদিরা দলবেঁদে নেচে-গেয়ে মাঠ থেকে কেটে আনে সে মাটি। অতঃপর ঘরের ভেতর রাখা মাটির কলসটা নিয়ে উপোস অবস্থায় বোহনে ও দিদিরা পুকুর বা নদী থেকে কিছু পানি নিয়ে আসে। এটিকে ‘পানিকাটা’ পর্ব বলে। বাসন্তী বলে, ‘এরপর যোগপানি উঘাইতে যাবে।’ বাড়ির বোহনে (দুলাভাই) কনেকে কোলে তুলে নিয়ে যায় বাড়ি বাড়ি। সেখানে ওই বাড়ির মেয়েদের চুল ও কনের চুল একত্র করে পানি ঢেলে সে পানির কিছু অংশ কলসে সংগ্রহ করা হয়। অতঃপর কলসটা রাখা হয় গোপন একটি ঘরে। বাবা-মা ও বোহনে ছাড়া অন্য কেউ ওই ঘরে ঢোকা নিষেধ। মালোরা বিশ্বাস করে এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে কনের অমঙ্গল হবে। বিয়ের দিন সবাই উলুধ্বনি দিয়ে প্রথমে কলসটা নিয়ে মারোয়ার চারপাশে পাঁচ পাক ঘুরে। অতঃপর কলসটিকে রাখা হয় মাটির চাকের বিশেষ জায়গায়।
মালোদের বিয়ের মূল পর্বটিকে বলে ‘বিহা’। ওই দিন বাড়িতে নাপিত ডেকে প্রথমে কনেকে শুদ্ধি করানো হয়। কনের কানি আঙুল সামান্য কেটে আমবা (আম) পাতায় রক্ত নিয়ে তা বেঁধে দেয়া হয় কনেরই হাতে। বরপক্ষ এলে কনের মা ও কাকিরা কুলাতে গোবর গুলি, গুড়ের গুলি, দুর্বাঘাস, আতপ চাল, মিষ্টি, পানি, পানপাতা, প্রদীপ বা বাত্তি নিয়ে উলধ্বনি দিয়ে বরণ করে নেয় বরকে। অতঃপর কনের ভাই বরকে গামছায় টেনে পাঁচ পাক ঘোরায় মারোয়ার চারপাশে। এরপর বর-কনেকে বসানো হয় মারোয়ায়। শুরু হয় দানপর্ব। আত্মীয়-স্বজনরা তাদের আশীর্বাদ করে নানা উপহারে। দান শেষে বর-কনেকে মারোয়ার চারপাশে পাঁচ পাক ঘুরে পূর্বদিকে মুখ করে দাঁড়াতে হয়। এ সময় একটি শাড়ি বা চাদরে ঢেকে দেয়া হয় দু’জনকে। চাদরের আড়ালে থেকে বর-কনেকে সিঁদুর দেয়। গঙ্গার ভাষায়, ‘কনিকাকে সিঁদুর পরাবে দুলা বাবু।’ অতঃপর বর-কনে উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিমে ফিরে সবাইকে প্রণাম জানায়। বিয়ে শেষে রাতভর চলে নাচ-গান আর হাড়িয়া খাওয়া।
বিয়ে শেষে আলাপ ওঠে মালোদের জন্ম-মৃত্যুর নানা আচার নিয়ে। গঙ্গা জানালেন আচারগুলোর কথা।
মালো সমাজে নবজাতক জন্মানোর ৭ দিন পর নুয়া অনুষ্ঠান করা হয়। নুয়া অর্থ নাপিত। ওই দিন ডাকা হয় সমাজের সবাইকে। নাপিত এসে কেটে দেয় সবার চুল-দাড়ি। নুয়া হওয়ার পরই পুরুষরা নবজাতকের ঘরে প্রবেশ করতে পারেন। এ ছাড়াও মালোরা বাচ্চা জন্মানোর ৫ অথবা ১২ দিন পর বোরহির অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ওই দিন বাচ্চার চুল কাটা হয়। সব কাপড়-চোপড় ধুয়ে শুদ্ধ করা হয়। মাটির জিনিস থাকলে তাও ভেঙে ফেলা হয়। মালোদের বিশ্বাস এতে অশুচি দূর হয়ে যায়। বোরহির দিনই এরা নবজাতকের নাম রাখে এবং ওই দিন সবাই তার মুখ দর্শন করেন।
হঠাৎ সবাই চুপ হয়ে যান। গঙ্গা মালোর স্মৃতিতে তখন প্রিয়জনরা। যারা মারা গেছেন অনেক আগেই। একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে তিনি বলতে থাকেন মালোদের মৃত্যুকেন্দ্রিক আচারগুলোর কথা।
মালো আদিবাসীদের মৃত্যু হলে দাহ করা হয়। দাহের আগে মৃতের শরীর এরা ধূপ, গোলাপজল, সাবান দিয়ে গোসল করিয়ে শরীরে মেখে দেয় হলুদ ও সিঁদুর। এদের মরার পর পাঁচ দিন পর্যন্ত মাছ, মাংস ও তৈল দিয়ে রান্না খাবার গ্রহণ নিষিদ্ধ। পাঁচ দিন পর মুরগি দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে এরা কলাপাতায় খাওয়ায় সমাজের পাঁচজনকে। ওই দিন নাপিত এসে ছেলের চুল ফেলে দেয়। মেয়েরা স্নান সেড়ে, নখ কেটে পান করে হলুদের পানি। মালোরা এ দিনটিকে বলে কুয়ারি।
আমাদের কথা থামে প্রভু মালোর পায়ের শব্দে। গঙ্গাদের পাশেই তার বাড়ি। বয়স তার চল্লিশের মতো। পরিচয় হতেই প্রভুর হাসিমাখা মুখে বিনয়ের ছাপ পড়ে। তিনি আমাদের গোটা মালো পাড়াটি ঘুরিয়ে দেখার দায়িত্ব নেন। সঙ্গে থাকে মারিয়ার বোন বাসন্তী।
প্রভু জানালেন, দিনাজপুর, রংপুর, মৌলভীবাজার ও জয়পুরহাট জেলায় মালো আদিবাসীদের বাস। মাছ ধরা এদের জাতিগত পেশা। তবে বর্তমানে মালোরা কৃষিকাজ ও দিনমজুরি করে জীবনযাপন করছে। পোষ মাসে এরা ধুমধামের সঙ্গে পুষনা উৎসব পালন করে। এ সময় তীর-ধনুক নিয়ে এরা শিকারে বের হয়। শিকারের মাংস দিয়ে সবার জন্য রান্না হয় খিচুড়ি। তবে যে শিকার ধরে তাকে একটু বেশি বা বিশেষ অংশ খেতে দেয়া হয়। এ ছাড়া মালো আদিবাসীরা ফসল কাটার পর ইঁদুরের গর্ত খুঁড়ে ধান সংগ্রহ করে। এটি তাদের পূর্বপুরুষদের আচার। ধানের সঙ্গে সঙ্গে এ সময় এরা দলবেঁদে মুসা (ধরে) ইঁদুর ধরে। তবে মালোদের এ আচারগুলো আজ লুপ্তপ্রায়।
কেন? প্রশ্ন করতেই উত্তরে প্রভু জানালেন, শীতল গ্রামের মাত্র নয়টি মালো পরিবার সনাতন রীতি আগলে রেখেছে। বাকিরা ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছে। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে মালোদের ধর্মকেন্দ্রিক সংস্কৃতিগুলো।
কথায় কথায় আমরা থামি ছোট্ট একটি বাড়ির সামনে। প্রভুর হাঁক-ডাকে ভেতর থেকে সাড়া মিলে। অতঃপর সদর দরজা ঠেলে বেরিয়ে আসেন এক বয়ঃজ্যেষ্ঠ লোক।
লোকটির নাম জুয়েল মালো। বয়স ষাটের মতো। ১৯৭১ সালে এ দেশকে মুক্ত করতে তিনি গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। যুদ্ধ করেছেন ৭নং সেক্টরে। আরেক মুক্তিযোদ্ধা ধীরেন মালোর মৃত্যুর পর জুয়েল মালোই এ গ্রামের একমাত্র আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের কথা উঠতেই তিনি বলেন, ‘তখন তো কোনো জাত-ধর্ম-বর্ণ ছিল না। সবাই আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছি। একজন হিন্দু কিংবা আদিবাসী, একজন মুসলমান মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচাতে জীবন দিতেও দ্বিধা করতো না। সবার ওপরে ছিল দেশ। সবাই আমরা এক ছিলাম।’ তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘স্বাধীন দেশ আমাদের ক্ষুদ্র করে দিয়েছে।’
একসময় শীতল গ্রামের মালোদের নিজস্ব অনেক জমি ছিল। অভাবের সময়ে স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে কড়া সুদে এরা টিপসই দিয়ে কর্জ নিত। সে সুযোগে মহাজনরাও ধীরে ধীরে দখল করে নেয় মালোদের জমিগুলো। জমির দখল নিয়ে স্থানীয় বাঙালিদের সঙ্গে এখনও এদের সংঘর্ষ হয়। সেসব কথা বলতে গিয়ে এ আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা দুঃখ করে বলেন, ‘স্বাধীন এ দেশে আমরা তো আজ ক্ষুদ্র জাতি। নিজ দেশে থাকি পরবাসীর মতো। দেশের সংবিধান আছে। কিন্তু সেখানে আদিবাসীদের কোনো স্থান নেই। এর চেয়ে কষ্টের আর কি আছে।’
বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই। আমরা ফেরার প্রস্তুতি নিই। মারিয়ার বাবা ভরত মালো আগ্রহ নিয়ে জানালেন মেয়ের বিয়ের খবরটি। নিমন্ত্রণও করলেন। কয়েক মাস পরই মারিয়ার বিয়ে। ছেলে রংপুরের এক ওরাওঁ পরিবারের। ধর্মান্তরিত হওয়ায় অন্য সম্প্রদায়ে বিয়ে নিষিদ্ধের আদি বিশ্বাসটি টিকে থাকেনি এ মালো পরিবারটিতে। এখন অন্য জাতি হলেও আদিবাসীদের মূল পরিচয় তারা খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত। ফলে বিয়ের সম্পর্ক করতেও নেই কোনো বাধা।
ধর্মান্তরিত হওয়ার ফলে মালো আদিবাসী সমাজে আজ শিক্ষার হার বেড়েছে, বেড়েছে সচেতনতা। এসেছে আর্থিক সচ্ছলতা। পাশাপাশি এরা নিঃশব্দে হারিয়ে ফেলছে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও পূর্বপুরুষদের আদি রেওয়াজগুলো। কিন্তু তবু মালোরা নিজেদের আদিবাসী হিসেবেই পরিচয় দিতেই গর্ববোধ করে। আর নিজের জাতির প্রতি ভালবাসার এ বোধটুকুই মালোদের টিকে থাকার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে।
মেয়েটির নাম মারিয়া মালো। মালো আদিবাসী জাতির নারী তিনি। থাকেন দিনাজপুরে। মাস্টার্স শেষে কাজ করছেন একটি এনজিওতে। ঘোড়াঘাটের শীতল গ্রামেই মারিয়ার জন্ম। সেখানে প্রায় দেড়শ’টি মালো পরিবারের বাস। একসময় এ দের পূর্বপুরুষরা বাস করত রংপুরের তাজহাটে। কলেরা ও ডায়রিয়া থেকে মুক্তি পেতে বহুপূর্বে এরা এসে বসতি গড়ে শীতল গাঁয়ে। মুঠোফোনে এমন নানা আলোচনায় আমরা আগ্রহী হই। শীতল গাঁয়ের ঠিকানাটি জানাই ছিল। তাই মারিয়ার আশা ছেড়ে আমরা নিজেরাই রওনা হই দিনাজপুর থেকে।
বৈশাখ মাস। তার ওপর গতরাতে হয়েছে কালবৈশাখী। জল আর হাওয়ার ঝাপটায় প্রকৃতিটাও বেশ সজীব। জমে থাকা ধুলোবালি ধুয়ে মুছে একেবারেই অন্য রকম। রোদের তীব্রতা তেমন নেই। দমকা হাওয়ার ঝাপটায় মাঝেমধ্যেই দুলে উঠছে মনটা। আমরা বাস থেকে নামি ঘোড়াঘাট টিঅ্যান্ডটিতে।
রাস্তার পাশে বড় একটি বটগাছ। বটের ছায়ায় বাসস্ট্যান্ডটি। পাশে গোটা দুয়েক চায়ের দোকান। দোকানে বসে গল্প জমিয়েছে জনাকয়েক লোক। ফাঁকে ফাঁকে ধোঁয়া তোলা চায়ে চুমুক দিচ্ছে তারা। বাঙালি ছাড়াও দু’-একটি আদিবাসী মুখপানে আমাদের দৃষ্টি আটকায়। ঠাওর হয় এখানটায় আদিবাসী-বাঙালির সহ-অবস্থান।
দোকানের সামনে পাঁচ-ছয়টি ভ্যানের ঝটলা। এ অঞ্চলে পথ চলতে ভ্যানই একমাত্র ভরসা। শীতল গ্রামের কথা বলতেই আতর আলী নামের এক ভ্যানচালক এগিয়ে আসেন। ভাড়া দরদাম করে আমরা রওনা হই শীতল গাঁওয়ের উদ্দেশে।
ঘোড়াঘাট ডিগ্রি কলেজ পেরিয়ে আমরা সামনে এগোই। লালমাটির শক্ত পথ। রাস্তার পাশে নানা ভাষাভাষী মানুষের আনাগোনা। দূর থেকে আদিবাসী পাড়ার ছনে ছাওয়া ঘরগুলো দেখতে অন্য রকম লাগে। চারপাশে সবুজ ধানক্ষেত। তার মাঝে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি তালগাছ। বিশাল দেহী আদিবাসীরা দলবেঁদে কাজ করছে মাঠে। গ্রামের ভেতর থেকে ভেসে আসা ঢোল-মাদলের ছন্দ এ অঞ্চলে আদিবাসীদের আধিক্যকেই বারবার মনে করিয়ে দেয়।
ভ্যানচালক আতর আলী জানালো, ঘোড়াঘাটে নাকি একসময় শুধুই আদিবাসীদের বসবাস ছিল। তখন এলাকাটি ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। আদিবাসীরা সে জঙ্গল কেটে চাষাবাদের জমি তৈরি করে। এখনও এখানে পাড়াভেদে বাস করছে সাঁওতাল, ওরাওঁ, মাহালী, মাহাতো, পাহাড়ি প্রভৃতি জাতির আদিবাসীরা। কিন্তু নানা কারণে এদের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে।
কথায় কথায় আমরা পেরোলাম কিলো পাঁচেক পথ। রাস্তার ডানে বাঁক নিতেই চোখের সামনে ভেসে উঠে একটি আদিবাসী গ্রাম। ভ্যান থামিয়ে আতর আলীর কণ্ঠ, ‘স্যার, এইডাই শীতল গ্রাম, মালোপাড়া।’
তখন দুপুর বেলা। রাস্তার পাশে বসে গল্প করছিল মধ্য বয়সী কয়েকজন। মারিয়া মালোর বাড়ি কোনটি? উত্তরে একজন আমাদের দেখিয়ে দেয় গ্রামের শেষ প্রান্তের একটি বাড়ি।
সদর দরজায় কড়া নারতেই বেরিয়ে আসে মারিয়ার ছোট বোন বাসন্তী মালো। নবম শ্রেণীতে পড়ছে সে। কথা বলায় বেশ চটপটে। ছিপছিপে গড়ন। এক চিলতে হাসি যেন তার মুখে আলো ছড়ায়। অভর্থ্যনা জানিয়ে বাসন্তী বাড়ির ভেতরে আমাদের বসতে দেয়। বাড়ির ভেতর বড় একটি উঠোন। দু’পাশে ছনে ছাওয়া দু’টি বড় ঘর। অন্য পাশে ছোট্ট একটি রান্নাঘর। উঠোনের এককোণে ঘাস ফুলের রাজ্য।
বাসন্তীর বাবা ভরত মালো। গ্রামের মাঝি হারাম বা গ্রামপ্রধান তিনি। তার খোঁজ করতেই বাসন্তী আমাদের নিয়ে যায় বাড়ির পেছন দিকটাতে। বড় একটি পুকুর পেরিয়েই একটি শালবাগান। তার ভেতর দিয়ে খানিকটা এগোলেই মিলে উঁচু একটি মাঠ। মাঠের শক্ত মাটিতে কোদাল চালিয়ে হলুদ তুলছিলেন ভরত মালো। বয়স সত্তরের মতো। কিন্তু দেহের গড়ন তা প্রকাশ করে না। গায়ের রঙ কালচে হলেও লম্বা ও সুঠাম দেহী এ মানুষটি যেন আদি মানুষেরই জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। তার সহধর্মিণী ভারতী মালো। হলুদ তোলাতে তাকে সাহার্য করছেন তিনি। কাজ থামিয়ে আমাদের সঙ্গে আলাপ জমায় তারা।
মালো আদিবাসীরা এ অঞ্চলে এসেছে ভারতের রাঁচি থেকে। এদের গানেও মিলে তার সত্যতা- ‘রাঁচি থেকে আসলো ঘাসী, তারপর হলো আদিবাসী।’ কথিত আছে, বৃটিশ আমলে রেললাইনের কাজের সূত্র ধরেই এ অঞ্চলে এদের আগমন ঘটে। ভরত মালোর বাবার নাম প্রতাপ মালো। প্রতাপের বেড়ে ওঠা এ অঞ্চলে হলেও তার বাবা এসেছিলেন রাঁচি থেকে। রাঁচি ও জলপাইগুড়িতে ভরতদের এখনও অনেক আত্মীয়-স্বজন বসবাস করছেন। ভরত মালো জানালেন তাদের জাতির নামকরণের ইতিহাসটি।
একসময় জমিদাররা মালোদের দিয়ে ঘোড়া, মহিষ ও গবাদি পশুর ঘাস কাটার কাজ করাতো। সে কারণে মালোদের ঘাসি বলেও ডাকা হতো। এ ছাড়া এদের অনেকেই বংশানুক্রমিকভাবে জমিদারদের লাঠিয়াল ও বরকন্দাজ হিসেবেও কাজ করতো। স্থানীয়রা এদের চিনে নেয় বুনা বা বুনো হিসেবে। বিহারের মালভূমি ও মালই টিলার অধিবাসীর জীবনযাত্রার সঙ্গে মিল আছে বলেই এদের মালো নামে ডাকা হয়।
মালোদের এক-একটি গ্রাম পরিচালিত হয় তিন সদস্যের পরিষদের মাধ্যমে। মাঝি হারাম বা গ্রামপ্রধানের পদ ছাড়াও রয়েছে পারমানিক ও গুরদিক নামের দুটি পদ। গ্রামের সবার কাছে নানা খবরাখবর পৌঁছানোর কাজটি করেন পারমানিক। আর মাঝি হারামের বিচারের রায় পাঠ করে শোনাতে হয় গুরদিককে। মালো আদিবাসীদের গোত্র বিভক্তি তাদের বংশ পরিচয়কেই তুলে ধরে। গোত্রগুলোর নামগুলো জানতে চাইলে ভরত মালো হরহর করে বলতে থাকেন- পরনদীয়া, এসলোকিয়া, কারচাহা, সরকার, নায়েক প্রভৃতি। এদের একই গোত্রে বিয়ে নিষিদ্ধ। এরা তাদের নামের শেষে টাইটেল হিসেবে মালো ছাড়াও অঞ্চলভেদে নায়েক, রাজ, সরকার ব্যবহার করেন।
মালোরা ভাষাগত দিক থেকে প্রোটো-অস্ট্রালয়েড জাতি। এরা নিজেদের ভাষাটিকে বলে মালো ভাষা বা ঘাসি ভাষা কিংবা বুনেরা ভাষা। তবে বর্তমানে বাংলা ভাষাতেই এরা অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। ভারতীর ভাষায়, ‘হামনি এ ভাষাটা সব সময় কিহে না’।
ভাষা নিয়ে আলাপ উঠতেই বাসন্তী জানালেন পড়াশোনার শুরুতে বাংলা ভীতির কথা। তার লেখাপড়ায় হাতেখড়ি স্থানীয় এক স্কুলে। সেখানে ছিল না কোন আদিবাসী শিক্ষক। বিদ্যালয়ের পড়ানো হয় অজানা বাংলা ভাষায়। যে ভাষায় সে কথা বলে মায়ের সে ভাষাটিকে সে বিদ্যালয়ে খুঁজে পায় না। ফলে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত বাংলা ভাষা বুঝতে তাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। কিন্তু পরে সে হয়ে উঠে ক্লাসের ভাল ছাত্রী। বর্তমানে বিরামপুর পাইলট স্কুলের সব শিক্ষকের কাছে সে একনামে পরিচিত।
আমরা একমনে শুনছিলাম বাসন্তী, ভরত ও তার সহধর্মিণীর কথা। হঠাৎ মাদল-ঢোলের টুংটাং শব্দ ভেসে আসে পাশের একটি বাড়ি থেকে। সেদিকে খেয়াল দিতেই বাসন্তী মালো মুচকি হাসে। সে জানাল, পাশের বাড়ির মেয়ের বিয়ে চূড়ান্ত হয়েছে। তাই বিয়ের আগ পর্যন্ত নানা আচার চলবে ঢোল-মাদলের ছন্দে।
ছন্দ ধরে আমরা ওই বাড়ির দিকে এগোই। আমাদের পথ দেখিয়ে নেয় বাসন্তী।
ছনে ছাওয়া তিনটি ঘর নিয়ে বাড়িটি। উঠোনের এককোণে উঁচু ও ছোট্ট একটু জায়গায় একটি তুলসি গাছ ঠায় দাঁড়িয়ে। তুলসির গোড়াটি মাটিতে লেপা। গাছের পাশেই রয়েছে একটি প্রদীপ। গৃহকর্ত্রী গঙ্গা মালো জানালেন এটি মালোদের ‘তুলসি গড়া’। ভগবানের সন্তুষ্টি লাভের আশায় এখানেই সকাল-সন্ধ্যা এরা ভক্তি বা প্রার্থনা করে। মালো ভাষায় একে ‘গরলাগি’ বলে।
আমাদের বসার জায়গা হয় একটি ঘরের বারান্দাতে। সেখানে এককোণে বসে মাদলের ছন্দ তুলছিলেন নিরমল মালো। মালোদের বিয়ে নিয়ে আমরা আলাপ জমাই। গঙ্গা মালোও আগ্রহ নিয়ে বলতে থাকেন বিয়ের আদ্যপান্ত।
মালোদের বিয়ের পাকা কথা হয় কনের বাড়িতে। এ সময় কনে পক্ষকে ভাল ভাল খাবারের সঙ্গে খেতে দিতে হয় হাড়িয়া। হাড়িয়া মালোদের প্রিয় পানীয়। এটি ছাড়া মালোদের সম্মান রক্ষা হয় না। একসময় এদের বিয়েতে পণপ্রথা চালু ছিল। কিন্তু বর্তমানে সামর্থ্য অনুযায়ী ছেলেকে যৌতুক দিতে হয়। কিন্তু যৌতুক প্রথাকে মালোরা তেমন ভাল চোখে দেখেন না। গঙ্গা মালোর ভাষায়, ‘ডিমেন না নেয়াই ভালো’।
মালোদের বিয়ের পর্ব পাঁচটি। সাজনা সাজা, লগন, কৈইলনী, মারোয়া ও বিহা। সাজনা সাজো পর্বে বরপক্ষ কনেকে সাজানোর জন্য হলুদের শাড়িসহ চিউরা (চিঁড়া), গুড়, তেল, হেরদি (হলুদ), আয়না, ককোই (চিরুনি), দুইটা মাটির পুথুল, চুরি, কানফুলি, নাককুটি, মালা, ফিতা, পানসুপারি, জবা ও গাদা ফুল, কুশ (এক প্রকার জঙ্গলি ফুল), গংগিকা নুুপূর (শামুকের নুপূর), পুতুলের খেটিলা (খাট) পাঠায়। এরা কনের জন্য সাদা রঙের কাপড় হলুদে ডুবিয়ে তৈরি করে বিশেষ ধরনের শাড়ি। মালো ভাষায় এটি, ‘হরদি লেংগন লুগা’।
গঙ্গা থামতেই লগন পর্বের কথা জানান নিরমল। এ পর্বে কনের মা-বাবাকে প্রথমে প্রার্থনা করতে হয় আদিরীতি মেনে। অতঃপর কনেকে ঘরের ভেতর রেখে গায়ে হলুদ দেন তার চাচা-চাচি, মামা-মামি ও নিকট আত্মীয়রা। সবাই মিলে বাড়ির উঠোনে তখন আঁকে নানা রঙের আলপনা। অতঃপর কনেকে এনে উঠোনে বসানো হয় পূর্বমুখো করে। নিয়ম মেনে কনের একপাশে বসে বরের ভাই, অন্যপাশে কনের ভাই। সবার উপস্থিতিতে এরা একজন অন্যজনের বুকে পানপাতা ছোঁয়ায়। অতঃপর একে অন্যকে বিয়াই বলে সম্বোধন এবং বিট বিট (কোলাকুলি) করে। চারপাশে তখন মাদল-ঢোলের বাদ্য বাজে। কনে তখন দাঁড়িয়ে সবাইকে প্রণাম করে।
কৈইলনী পর্বের কথা জানতে চাইলে গঙ্গা মুচকি হাসেন। ছোট্ট একটি বাঁশের ঝুড়িতে কিছু মুড়ি এগিয়ে দেন আমাদের দিকে। অতঃপর বলতে থাকেন।
মালো বিয়েতে গায়ে হলুদের তিন দিন পর হয় কৈইলনী পর্বটি। এ সময় দিনে ও রাতে উপোস থাকতে হয় কনেকে। উপোস অবস্থায় খাওয়া যায় শুধুই দুধ আর রুটি। কৈইলনীর দিন খুব ভোরে উঠে জিগা গজ, বাঁশপাতা, ধান, সুপারি, ১ টাকা, অরপন, সিঁদুর, ছোট ছোট সাদা কাপড়, সুতা, সঙ্গে নিয়ে কনেকে উঠোনে গিয়ে বসতে হয় মায়ের কোলে। ওই অবস্থাতেই কনে মাটি খুঁড়ে গর্ত তৈরি করে। সঙ্গে আনা জিনিসগুলো গর্তে মাটিচাপা দিয়ে তবেই ভাঙতে হয় উপোস।
মারোয়া পর্বের কথা উঠতেই বাসন্তী গান ধরেন-
‘চারকোনা চারখোট
মাঝে মারোয়া...’
বাড়ির উঠোনে মারোয়া সাজানোর সময় মালো আদিবাসীরা ‘লুচকি নাচ’ নাচে। মারোয়া সাজাতে কি কি লাগে? গঙ্গার উত্তর, ‘কলা গাছ লাগে চাইরটে, মইধ্যে একটা বাঁশ, ফুল দেইকে ঘেরেক লাগিলো।’ একটি মাটির কলস রাখার জন্য মারোয়ায় তিন চাক মাটি বসানো হয়। বাড়ির বোহনে (দুলাভাই) ও দিদিরা দলবেঁদে নেচে-গেয়ে মাঠ থেকে কেটে আনে সে মাটি। অতঃপর ঘরের ভেতর রাখা মাটির কলসটা নিয়ে উপোস অবস্থায় বোহনে ও দিদিরা পুকুর বা নদী থেকে কিছু পানি নিয়ে আসে। এটিকে ‘পানিকাটা’ পর্ব বলে। বাসন্তী বলে, ‘এরপর যোগপানি উঘাইতে যাবে।’ বাড়ির বোহনে (দুলাভাই) কনেকে কোলে তুলে নিয়ে যায় বাড়ি বাড়ি। সেখানে ওই বাড়ির মেয়েদের চুল ও কনের চুল একত্র করে পানি ঢেলে সে পানির কিছু অংশ কলসে সংগ্রহ করা হয়। অতঃপর কলসটা রাখা হয় গোপন একটি ঘরে। বাবা-মা ও বোহনে ছাড়া অন্য কেউ ওই ঘরে ঢোকা নিষেধ। মালোরা বিশ্বাস করে এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে কনের অমঙ্গল হবে। বিয়ের দিন সবাই উলুধ্বনি দিয়ে প্রথমে কলসটা নিয়ে মারোয়ার চারপাশে পাঁচ পাক ঘুরে। অতঃপর কলসটিকে রাখা হয় মাটির চাকের বিশেষ জায়গায়।
মালোদের বিয়ের মূল পর্বটিকে বলে ‘বিহা’। ওই দিন বাড়িতে নাপিত ডেকে প্রথমে কনেকে শুদ্ধি করানো হয়। কনের কানি আঙুল সামান্য কেটে আমবা (আম) পাতায় রক্ত নিয়ে তা বেঁধে দেয়া হয় কনেরই হাতে। বরপক্ষ এলে কনের মা ও কাকিরা কুলাতে গোবর গুলি, গুড়ের গুলি, দুর্বাঘাস, আতপ চাল, মিষ্টি, পানি, পানপাতা, প্রদীপ বা বাত্তি নিয়ে উলধ্বনি দিয়ে বরণ করে নেয় বরকে। অতঃপর কনের ভাই বরকে গামছায় টেনে পাঁচ পাক ঘোরায় মারোয়ার চারপাশে। এরপর বর-কনেকে বসানো হয় মারোয়ায়। শুরু হয় দানপর্ব। আত্মীয়-স্বজনরা তাদের আশীর্বাদ করে নানা উপহারে। দান শেষে বর-কনেকে মারোয়ার চারপাশে পাঁচ পাক ঘুরে পূর্বদিকে মুখ করে দাঁড়াতে হয়। এ সময় একটি শাড়ি বা চাদরে ঢেকে দেয়া হয় দু’জনকে। চাদরের আড়ালে থেকে বর-কনেকে সিঁদুর দেয়। গঙ্গার ভাষায়, ‘কনিকাকে সিঁদুর পরাবে দুলা বাবু।’ অতঃপর বর-কনে উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিমে ফিরে সবাইকে প্রণাম জানায়। বিয়ে শেষে রাতভর চলে নাচ-গান আর হাড়িয়া খাওয়া।
বিয়ে শেষে আলাপ ওঠে মালোদের জন্ম-মৃত্যুর নানা আচার নিয়ে। গঙ্গা জানালেন আচারগুলোর কথা।
মালো সমাজে নবজাতক জন্মানোর ৭ দিন পর নুয়া অনুষ্ঠান করা হয়। নুয়া অর্থ নাপিত। ওই দিন ডাকা হয় সমাজের সবাইকে। নাপিত এসে কেটে দেয় সবার চুল-দাড়ি। নুয়া হওয়ার পরই পুরুষরা নবজাতকের ঘরে প্রবেশ করতে পারেন। এ ছাড়াও মালোরা বাচ্চা জন্মানোর ৫ অথবা ১২ দিন পর বোরহির অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ওই দিন বাচ্চার চুল কাটা হয়। সব কাপড়-চোপড় ধুয়ে শুদ্ধ করা হয়। মাটির জিনিস থাকলে তাও ভেঙে ফেলা হয়। মালোদের বিশ্বাস এতে অশুচি দূর হয়ে যায়। বোরহির দিনই এরা নবজাতকের নাম রাখে এবং ওই দিন সবাই তার মুখ দর্শন করেন।
হঠাৎ সবাই চুপ হয়ে যান। গঙ্গা মালোর স্মৃতিতে তখন প্রিয়জনরা। যারা মারা গেছেন অনেক আগেই। একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে তিনি বলতে থাকেন মালোদের মৃত্যুকেন্দ্রিক আচারগুলোর কথা।
মালো আদিবাসীদের মৃত্যু হলে দাহ করা হয়। দাহের আগে মৃতের শরীর এরা ধূপ, গোলাপজল, সাবান দিয়ে গোসল করিয়ে শরীরে মেখে দেয় হলুদ ও সিঁদুর। এদের মরার পর পাঁচ দিন পর্যন্ত মাছ, মাংস ও তৈল দিয়ে রান্না খাবার গ্রহণ নিষিদ্ধ। পাঁচ দিন পর মুরগি দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে এরা কলাপাতায় খাওয়ায় সমাজের পাঁচজনকে। ওই দিন নাপিত এসে ছেলের চুল ফেলে দেয়। মেয়েরা স্নান সেড়ে, নখ কেটে পান করে হলুদের পানি। মালোরা এ দিনটিকে বলে কুয়ারি।
আমাদের কথা থামে প্রভু মালোর পায়ের শব্দে। গঙ্গাদের পাশেই তার বাড়ি। বয়স তার চল্লিশের মতো। পরিচয় হতেই প্রভুর হাসিমাখা মুখে বিনয়ের ছাপ পড়ে। তিনি আমাদের গোটা মালো পাড়াটি ঘুরিয়ে দেখার দায়িত্ব নেন। সঙ্গে থাকে মারিয়ার বোন বাসন্তী।
প্রভু জানালেন, দিনাজপুর, রংপুর, মৌলভীবাজার ও জয়পুরহাট জেলায় মালো আদিবাসীদের বাস। মাছ ধরা এদের জাতিগত পেশা। তবে বর্তমানে মালোরা কৃষিকাজ ও দিনমজুরি করে জীবনযাপন করছে। পোষ মাসে এরা ধুমধামের সঙ্গে পুষনা উৎসব পালন করে। এ সময় তীর-ধনুক নিয়ে এরা শিকারে বের হয়। শিকারের মাংস দিয়ে সবার জন্য রান্না হয় খিচুড়ি। তবে যে শিকার ধরে তাকে একটু বেশি বা বিশেষ অংশ খেতে দেয়া হয়। এ ছাড়া মালো আদিবাসীরা ফসল কাটার পর ইঁদুরের গর্ত খুঁড়ে ধান সংগ্রহ করে। এটি তাদের পূর্বপুরুষদের আচার। ধানের সঙ্গে সঙ্গে এ সময় এরা দলবেঁদে মুসা (ধরে) ইঁদুর ধরে। তবে মালোদের এ আচারগুলো আজ লুপ্তপ্রায়।
কেন? প্রশ্ন করতেই উত্তরে প্রভু জানালেন, শীতল গ্রামের মাত্র নয়টি মালো পরিবার সনাতন রীতি আগলে রেখেছে। বাকিরা ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছে। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে মালোদের ধর্মকেন্দ্রিক সংস্কৃতিগুলো।
কথায় কথায় আমরা থামি ছোট্ট একটি বাড়ির সামনে। প্রভুর হাঁক-ডাকে ভেতর থেকে সাড়া মিলে। অতঃপর সদর দরজা ঠেলে বেরিয়ে আসেন এক বয়ঃজ্যেষ্ঠ লোক।
লোকটির নাম জুয়েল মালো। বয়স ষাটের মতো। ১৯৭১ সালে এ দেশকে মুক্ত করতে তিনি গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। যুদ্ধ করেছেন ৭নং সেক্টরে। আরেক মুক্তিযোদ্ধা ধীরেন মালোর মৃত্যুর পর জুয়েল মালোই এ গ্রামের একমাত্র আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের কথা উঠতেই তিনি বলেন, ‘তখন তো কোনো জাত-ধর্ম-বর্ণ ছিল না। সবাই আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছি। একজন হিন্দু কিংবা আদিবাসী, একজন মুসলমান মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচাতে জীবন দিতেও দ্বিধা করতো না। সবার ওপরে ছিল দেশ। সবাই আমরা এক ছিলাম।’ তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘স্বাধীন দেশ আমাদের ক্ষুদ্র করে দিয়েছে।’
একসময় শীতল গ্রামের মালোদের নিজস্ব অনেক জমি ছিল। অভাবের সময়ে স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে কড়া সুদে এরা টিপসই দিয়ে কর্জ নিত। সে সুযোগে মহাজনরাও ধীরে ধীরে দখল করে নেয় মালোদের জমিগুলো। জমির দখল নিয়ে স্থানীয় বাঙালিদের সঙ্গে এখনও এদের সংঘর্ষ হয়। সেসব কথা বলতে গিয়ে এ আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা দুঃখ করে বলেন, ‘স্বাধীন এ দেশে আমরা তো আজ ক্ষুদ্র জাতি। নিজ দেশে থাকি পরবাসীর মতো। দেশের সংবিধান আছে। কিন্তু সেখানে আদিবাসীদের কোনো স্থান নেই। এর চেয়ে কষ্টের আর কি আছে।’
বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই। আমরা ফেরার প্রস্তুতি নিই। মারিয়ার বাবা ভরত মালো আগ্রহ নিয়ে জানালেন মেয়ের বিয়ের খবরটি। নিমন্ত্রণও করলেন। কয়েক মাস পরই মারিয়ার বিয়ে। ছেলে রংপুরের এক ওরাওঁ পরিবারের। ধর্মান্তরিত হওয়ায় অন্য সম্প্রদায়ে বিয়ে নিষিদ্ধের আদি বিশ্বাসটি টিকে থাকেনি এ মালো পরিবারটিতে। এখন অন্য জাতি হলেও আদিবাসীদের মূল পরিচয় তারা খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত। ফলে বিয়ের সম্পর্ক করতেও নেই কোনো বাধা।
ধর্মান্তরিত হওয়ার ফলে মালো আদিবাসী সমাজে আজ শিক্ষার হার বেড়েছে, বেড়েছে সচেতনতা। এসেছে আর্থিক সচ্ছলতা। পাশাপাশি এরা নিঃশব্দে হারিয়ে ফেলছে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও পূর্বপুরুষদের আদি রেওয়াজগুলো। কিন্তু তবু মালোরা নিজেদের আদিবাসী হিসেবেই পরিচয় দিতেই গর্ববোধ করে। আর নিজের জাতির প্রতি ভালবাসার এ বোধটুকুই মালোদের টিকে থাকার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে।
No comments
Post a Comment